বই: হেজাযের কাফেলা
মূল: কাফেলায়ে হেজায(উর্দু)
লেখক: নসীম হিজাযী
অনুবাদক: আবদুল হক
সম্পাদনা: আসাদ বিন হাফিজ
হাসান। আরব কৃষকের ছেলে। থাকে বিশাল ইরান সাম্রাজ্যভুক্ত ইরাকে। তার এলাকার জমিদার ‘কোব্বাদ’ অন্যসব ইরানী জমিদারদের মত আরব কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত না, সে ছিল রহমদীল। ঘটনাক্রমে জমিদারপুত্র ‘জাহাদাদ’ এর সাথে গরীব কৃষকপুত্র হাসানের দারুন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তখন ইরানী ইতিহাসের সেই অধ্যায়, যখন খসরু পারভেজের বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরে আঘাত হানছিল আর বসফরাসের পূর্ব উপকূলে নিজ প্রাসাদে বসে ইরানী ফৌজের তাবু দেখছিল রোমের কাইজার। বন্ধুর সহায়তায় হাসান ইরান সালতানাতের বিশাল ফৌজে যোগ দেয়, যেখানে বন্ধু জাহাদাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরমিয়ায় রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে হেরে যায় ইরানীরা। হাসান আর জাহাদাদ কয়েক বছর দুঃসহ বন্দীজীবন কাটায় রোমের কারাগারে আর বদ্ধ জাহাজে খালাসী হয়ে। হাসান পালিয়ে গেলেও তার আগে জাহাদাদ অনেকদিন অসুস্থতায় ভুগে মারা যায় বন্ধুর কোলে মাথা রেখে, পালাবার ঠিক আগে। বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে নয় বছরের সৈনিক আর বন্দীজীবন শেষে সে ফেরার হয় নিজ গ্রামে। এসে দেখে, তার বাড়ির জায়গায় ছাইয়ের স্তুপ জমা হয়ে আছে। গ্রামের লোকজন তাকে বলে যে কোব্বাদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে উক্ত ইরাকী প্রদেশের নতুন অত্যাচারী গভর্নর তারই আত্মীয় ‘তুরজ’ কে হাওলা করে দিয়েছে। সে কৃষকদেরকে মজলুম বানিয়েছে, অতিরিক্ত কর আদায় করছে আর আরব কৃষকদের ফসল লুটপাট করছে। গ্রামবাসীরা জানায়, বিদ্রোহ দমনে হাসানের পিতা ও বড় ভাইকে তুরজ হত্যা করে, বোনকে নির্যাতন করায় সে তুরজের ছাদ থেকে পড়ে লাফিয়ে আত্মাহুতি দেয়। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হাসান। যে সালতানাতের জন্য জীবন বাজি রাখে, বন্দীর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে, সে সালতানাত তাকে তার জানবাজীর পুরষ্কার হিসেবে দেয় পিতা,ভাই ও বোনের লাশ। কী করতে পারে হাসান?
নসীম হিজাযীর আরেকটা মাষ্টারপিস। একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার মত এক ঐতিহাসিক উপ্যাখ্যান। উপন্যাসটায় আছে মুসান্না বিন আমর, খালিদ বিন ওয়ালীদ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, কা’কা বিন আমরের মত ইসলামের গৌরবান্বিত বীর ও বিশিষ্ঠ সাহাবিদের নাম আর বীরত্বগাঁথা।
তখন নবী (সাঃ)-এর ওফাতের অবব্যহিত পরের সময়। বাহরাইনসহ আরব মুল্লুকে ভন্ড নব্যুয়তের দাবিদারেরা ইসলামের সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ধর্মচ্যুত আর আরব বেদুইনদের কবিলা। আরবে-আরবে যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতির সময়। যৎসামান্য মুসলিম সিপাহি নিয়ে বৃহৎ ফৌজের ইসলামের ধ্বংসকামীদের মুখোমুখি মুসান্না (রাঃ)। তারপর যা যা ঘটেছিল, আরবের সীমানা পেরিয়ে অনারব ইরানী আর রোমানদের ভাব প্রকাশের জন্য ছিল একটিমাত্র শব্দ- অবিশ্বাস্য! ত্রিশ হাজার মুসলিম সেনা, দেড়লাখ পারস্য সেনা, নাহাওন্দের ময়দান। একলাখ ত্রিশ হাজার ইরানী সিপাহী মহাবীর রুস্তমের নেতৃত্বে, সাথে একশ হাতি- সা’দ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বিশহাজার মুসলিম সেনা, কাদিসিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র। কাদিসিয়ার যুদ্ধে এসেছিল ঐতিহাসিকদের মতে ‘বিষাদ রজনী’। হাজার বছরের পুরোনো ইরানী ঐতিহ্যের নতুন গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল হেজাযের কাফেলার সওয়ারীদের রক্তে। যাকে প্রকাশ করার একমাত্র শব্দ বাকী ছিল ইরানীদের এবং ভবিষ্যতের অবিশ্বাসীদের কাছে-‘অবিশ্বাস্য’। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম যোদ্ধা আর অনাগত বিশ্বাসীরা জানত, জেনেছে আর জানবে এর কারন। অথচ, গুটিকয়েক সৈনিক নিয়ে দুঃসাহসী মুসান্না (রাঃ) যখন বিশাল ইরান সালতানাতের অন্তর্গত ইরাক সীমান্ত আক্রমণ করেন, কিসরার মাথারা একে ছেলেখেলা ভেবেছিল।
ইরানের পরাজিত সিপাই আর শহরবাসীদের প্রতি কেমন ছিল মুসলিমদের আচরণ? কেনইবা আরবের সীমান্ত ছেড়ে অনারবদের দিকে এগিয়ে এসেছিল আরব মুসলিমরা? সব উত্তর বিস্তারিত জানতে হলে আপনাকে ‘হেজাযের কাফেলা’র সাথে ঘুরে আসতে হবে বিশাল ইরান সাম্রাজ্যে।
শুধু এতটুকুই যথেষ্ট ছিল ‘হেজাযের কাফেলা’ কে মনে রাখার জন্য। কিন্তু এখানে আছে প্রাসাদ চক্রান্ত, কাপুরুষতা, পাহাড় টলানো দাম্ভিকতা এবং পবিত্র প্রেম।
অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম এরকম মনোমুগ্ধকর লেখনির দ্বারা ফুটিয়ে তোলা সত্য ঐতিহাসিক উপ্যাখ্যানের জন্য। অবশেষে অপেক্ষার সমাপ্তি!
কাহিনীর শতকরা দশভাগ উল্লেখ করার চেষ্টা করলাম। প্রায় সবটাই বাকী। যুদ্ধক্ষেত্রে দু’দলের তৎপরতার বর্ণনা ছিল অসাধারণ। ঘটনা উভয়পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধের বাইরেও। মনোমুগ্ধকর, হৃদয়গ্রাহী এক সত্যাশ্রয়ী উপন্যাস। ইতিহাসকে রঙ চড়িয়ে উপস্থাপন করা হয়নি। আমাদের মীর মশাররফ হোসেনের সাথে লেখকের পার্থক্য এখানেই। একই ঘরানার লেখক হলেও স্যার ওয়াল্টার স্কট, বঙ্কিমচন্দ্রের সাথেও হিজাযীর তফাৎও একই কারনে। তার উপন্যাসের ঐতিহাসিক সত্যতা প্রশ্নাতীত।
প্রিয় তালিকায় যুক্ত হল আরো একটা বই।