ছোটবেলায় আমাদের একটা সাধারণ দৃশ্য হল, কোন দাদী/নানির কাছে ছোট সব ভাইবোন মিলে তাদের ঘিরে ধরে চমকপ্রদ কিছু ভূতের গল্প শোনা আর ভয়ে গল্পের অর্ধেক শুনেই ঘুমিয়ে পড়া। সাহসীদের সংখ্যা খুব বেশি থাকেনা যারা পুরো গল্প শেষ করেই ঘুমাতে যেত।
অন্তত আমাদের ভাইবোনদের বেলায় সেরকমই ঘটত। আমি সেরকম সাহসী ছিলাম কিনা জানিনা। কিন্তু অদ্ভূত একটা মোহে পুরো গল্পটা শুনেই ঘুমাতে যেতাম।
লক্ষীরাম কাকা আমাদের এরকম ভূতের গল্প শোনাতেন। তিনি আমাদের বহুদিনের পারিবারিক কাজের লোক। দাদা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি আমাদের সাথে থাকতেন। আমরা ছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে। শীতের রাতে মাঝে মাঝে আমরা তার ঘরে গিয়ে তার বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে তাকে গল্প বলার জন্য ধরতাম। আমাদের এই কাকা কিছু নিজের অভিজ্ঞতা আর কিছু অন্যের কাছে শোনা গল্প শুনিয়ে আমার দাদী-নানির অভাব ভালই পূরণ করতেন।
’৮৫ সালের এক শীতের রাতে কাকা প্রথম গল্পটা বলা শুরু করলেন। গল্পটা তার কাছেই পরবর্তিতে আরোও অনেকবার শুনেছিলাম বলে অনেকটা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে শোনা ঘটনাটা সবাইকে জানানোর জন্য লিখছি-
আমাদের গ্রামের পাশেই বসত এক বিশাল হাট। আশেপাশের এলাকার মধ্যে সবচাইতে বড় হাট ছিল সেটা। হাটের মধ্যে বিশাল মাছের বাজার বসত। অনেক লোক মাছ কিনত। কাকা তখন ছিলেন দারুণ অভাবী। মাছ কেনার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য ছিলনা।
একদিন এক হাটবারে তিনি বাজার করতে এলেন। একজনের মাছ কেনার সময় খেয়াল করলেন, লোকটা বাজারের সবচাইতে বড় মাছটা কিনলেন কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনরকম কোন দামাদামি করলেন না। অথচ বড় মাছ কেনার সময় লোকজন অনেকক্ষণ ধরে দামাদামি দরকষাকষি করে এবং এই ব্যাপারে কথাকাটাকাটি থেকে শুরু করে বিবাদ পর্যন্ত হয়ে যেত।
কিছুটা লোভ আর কিছুটা কৌতুহল নিয়ে কাকা লোকটার পিছন পিছন যেতে শুরু করেন। ব্যাপারটা বর্তমান শহুরে সমাজে খারাপ শোনালেও তখনকার গ্রামাঞ্চলে সেটা কিছুটা স্বাভাবিকই ছিল। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করা অনেক কঠিন। সাথে ‘খায়েশ’ বলেও একটা কথা আছে।
যাইহোক, আমাদের এলাকা দিয়ে একধরণের সরু খাল বয়ে গেছে, বর্ষাকালে দূর-দূরান্তের বৃষ্টির পানি ঐ খাল সহ আশেপাশের অনেক নিঁচু জমিকে প্লাবিত করে ঐ খাল ধরে অনেক দূরে বয়ে চলে যায়। শীতকালে পানি অনেক কম থাকে। কাকা দেখলেন ঐ লোকটি সেই খালের গায়ে ঘেঁষা এক গর্তের কাছে এসে দাঁড়াল। গর্তে ঢুকবার মুখে লোকটা মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে যখন তাকিয়ে দেখল, তখনই লোকটা কাকাকে দেখে ফেলল। কিন্তু তাকে দেখেও লোকটা খুব স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে এগিয়ে এল আর কাকাকে সালাম দিল। কাকা লোকটার আচরণে আর কর্মকান্ডে দারুন অবাক হলেন। যে গর্তটার দিকে লোকটা তাকে মেহমানের মত অনেক খাতির করে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে তিনি কোন মানুষকে কোনদিনও ঢুকতে বা বের হতে দেখেননি, বরং গর্তগুলো ছিল শেয়ালের। রাতে শেয়াল শিকারে বের হয়। কিন্তু এইসব খালের পাড়ে তিনি এবং তার মত অনেক রাখালই গরু চরাতে আসত বিধায় এলাকাটা তার ভালই চেনা ছিল। কয়েকবার দিনের বেলায় ঐসব গর্ত থেকে বের হয়ে আসা কয়েকটা শেয়ালও মেরেছিলেন অন্যান্য রাখালদের নিয়ে। ঠিক ঐরকমই একটা গর্তের মধ্যে লোকটা কাকাকে নিয়ে গিয়েছিল। কাকা ইতিমধ্যে একটা দৌড় দেয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু কোনমতে একটা মানুষ ঢোকা যায় এরকম একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে তিনি যা দেখেন, তাতে তার দৌড় দেয়ার চিন্তাটাই মাথা থেকে দৌড় দিয়ে পালায়। গর্তের মধ্যেকার স্বাভাবিক অন্ধকারের পরিবর্তে তিনি দেখেন আলোঝলমলে প্রাসাদের মত একটা কক্ষ। অনেক লম্বা লম্বা লোকজন সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। একে অপরকে তাদের কাজে সাহায্য করছে কিন্তু সবাই অত্যন্ত নিঁচুস্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। তাদের কাজের ধরণ দেখে কাকার মনে হয়েছিল যেন তিনি অদ্ভূত কোন বিয়েবাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সবকিছু দেখে যখন তিনি থ মেরে বসে আছেন, তখন লোকটা ইশারায় কর্মরত লোকদের মধ্যে একজনকে ডেকে বিশাল মাছটা দিয়ে পাঠালেন। কয়েক মিনিট পরই লোকটা কিছু অদ্ভূত ধরণের থালায় কী একটা নিয়ে আসে আর সেটা তার সামনে রাখে। কাকাকে নিয়ে আসা লোকটা তাকে ইশারাতে খেতে বলে। কাকা প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালায় সবকিছু ভুলে খেতে বসে লক্ষ করেন বিশাল বড় কয়েকটা মাছের চাকা তাকে দেয়া হয়েছে। সম্ভব-অসম্ভব কিছু বিবেচনা না করে তিনি খাওয়া শুরু করেন। ঐ খাওয়ার স্বাদের বিবরণ তিনি এভাবে দেন যে, খাওয়ার ফলে তার ক্ষুধা নাকি আরও বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তি ঘটনার কোনকিছুই তার কাছে পরিষ্কার ছিলনা। শুধু তিনি একথা মনে করতে পারেন যে, তাকে একটা অনেক নরম বিছানায় শোয়ানো হয়েছিল। তারপর কখন, কিভাবে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আসেন, তার কিছুই তার কাছে ষ্পষ্ট নয়। আমার চাচা-চাচীদের কাছে শুনতে পাই, ঐ ঘটনার পর তার শরীর-স্বাস্থের অনেক উন্নতি হয়েছিল।
হাদিসে আমরা পাই, জ্বিনদের সমাজ আছে, তারা পানাহার করে। কুরআনে ষ্পষ্টভাবে আমরা জ্বিনদের বংশবৃদ্ধির ব্যাপারেও ইঙ্গিত পাই। মানুষের মতই জ্বিনদের মধ্যেও খারাপ-ভাল আছে, যাদের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি। কিজানি,হয়তো কাকা সেই দূর্লভ ভাল জ্বিনদের সাক্ষাতই পেয়েছিলেন।
সবাই ভাল থাকুন। আর যারা জ্বিনের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন, তাদেরকে বলি, আমার আপনার বিশ্বাস/অবিশ্বাসে কোন সত্য বাতিল হবে না বা মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হবেনা। সত্য প্রমাণের অপেক্ষা করেনা। কারণ, প্রমানের আগেও সেটা সত্যই ছিল।