শৈশব নিয়ে লেখা সিরিজের প্রথম অংশ এখানে পড়তে পারেন
কেয়া পাতায় নৌকা ভাসানোর দিনগুলো
পিতল মাজা ঝকঝকে লাল ইট সুরকীর দিন পদ্মার পাড় হয়ে মানিকগঞ্জের তাল পুকুরে অথৈ ডুবে নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছিল সাথে ছিল তিতির আর অজানাতে হারানোর সুখ !!
___পুরনো ঢাকায় আমাদের বাসা আর ভিক্টোরিয়া পার্কের মাঝে ছিল কবি নজরুল কলেজ,কলেজের পিছনের লুকানো দরজা পার হয়ে এখন তখন খেলতে যেতাম সেখানে। গলির শুরুর বাসা আমাদের আর শেষ বাসাটা যতদূর শুনেছি কলেজের অধ্যক্ষ্য;র বাস ভবন হিসেবে ব্যবহত হত একসময় আমারা বাগান বাড়ি নামে ডাকতাম । অত রকমের ফুল আর ফলের বাগান সহ চমৎকার বাড়ি তখন ও অনেক কম দেখা যেত পুরনো ঢাকায়।গায়ে গা লাগানো , আশে পাশে গাড়ির গ্যারাজ ধোলাই খাল এর বয়া নিয়ে এই পরিবেশ ছিল আমার জন্য একেবারেই ভিন্নতর ;ভাষা সহ ওদের রঙে রাঙাতে সময় লাগে নি একেবারেই ।
১৩৬ কাজি আব্দুল রউফ রোড কলতা বাজার ঢাকা ; এই ঠিকানায় কেটেছে আমার লম্বা একটা শৈশব।একদিন ঘুম ভেঙে দেখি আমি নৌকাতে শুয়ে আছি ,চোখ মেলে জানালায় দেখলাম কচুরিপানা আর পানির শব্দ ;বিছানা থেকে নেমে বুঝেছি এক ঘুমে আমি মানিকগঞ্জ থেকে কেরানী গঞ্জের বাসায় । পাটাতনের ঘড় ছিল বিধায় জানালা দিয়ে পানি দেখা যেত , একেবারেই অল্প সময় ছিলাম সেখানে ।
এক কাল বৈশাখী ঝড়ে বাসার সামনের কলা গাছ বিশাল কলার কাঁদি সহ পানিতে পরে গিয়েছিল এবং বাড়ির মালিক সাতার কেটে সেই কলার কাঁদি কেটে নিয়ে এলেন এমন একটা দৃশ্য চোখে কোনে আছে শুধু আর আছে বাসার আলমিরার মাঝের শোকেসে সাজিয়ে রাখা মায়ের জমানো সমস্ত চীনা মাটির কাঁচের সংগ্রহ (আলমিরার চূড়ায় চড়তে যেয়ে, বেয়ে উঠার সময় ) ভেঙ্গে ফেলার স্মৃতি __
কাঠের পাটাতনের মেঝে ছিল বলে আলমিরা সব দিক সমান ভাবে মেঝেতে বসত না।ফেলে দিয়েই খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে গিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম ,আব্বা অফিস থেকে আসবার পর সবাই মিলে খুঁজে পেয়েছে সেখানে । বড় ভাই বোনদের স্কুলের সমস্যার জন্য কয়েকমাস এর মাঝেই কলতা বাজার চলে আসি। নতুন বাসায় আসবার ভয়াবহ আনন্দের দিক ছিল একটা আমার মামা তখন সবে মাত্র ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন যাকে দেখলে বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। আমি আর আমার সহোদরা ভেবে বের করলাম মামা যেহেতু নতুন বাসা চিনেন না জীবনে ও আসতে পারবেন না সুতরাং এই যাত্রা সকাল সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসা থেকে বেঁচে গেলাম।
আমার মামার পরিচয় দেই একটু_
স্বল্পভাষী ভীষন রসিক আপত দৃষ্টিতে নিরিহ দেখতে এই মামা ছোট বেলায় ছিলেন আমাদের কাছে সাক্ষাৎ যম এর অপর নাম ।
সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সমাজ কল্যান বিষয়ের ভর্তি হয়ে মহসিন হল এ উঠার অপেক্ষায় ,বিশ্ব বিদ্যালয়ে বছর শেষে যে টাইটেল দেয়া হয় সেখানে " নো গ্যান্জাম " উপাধি তে ভূষিত !!! ব্যক্তি জীবনে চরম ডিসিপ্লিনড সাস্থ্য সচেতন একজন, সর্বসাধারনের কাছে ছিলেন পারফেক্ট এবং ঠিক এই জন্যই আমাদের ভয়।সবজী পাতে না নিয়ে খাবার শুরু করা যাবে না প্রতিদিন প্রচুর পানি পান , সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পরে বই নিয়ে বসতে হবে এবং প্রতিদিন স্কুলের পড়ার সাথে মামার দেয়া বাড়ির কাজ ও করতে হবে ।
আমার তখন ও স্কুল শুরু হয় নি ,আমার হোম ওয়ার্ক ছিলো বাসায় রাখা অবজারভার পেপারের হেড লাইন পড়ে শোনানো । বাকিদের কথা আর না ই বা বললাম । সালাদ ছিল মামার সবচাইতে প্রিয় , শসা পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ শীতে ধনেপাতা আর রমজানে পুদিনা পাতা।
হায়রে পুদিনা পাতা !!! এর গন্ধের ভয়ে আমি অন্য রুমে ইফতার করতাম । অথচ অনেক বছর পর যখন ঢাকা আসি বিশ্ব বিদ্যালয়ের কোচিং করতে ,তখন এই নিউ মার্কেট শাহাবাগের পুদিনার ঘ্রাণ ই আমাকে সব চাইতে আনমনা করেছে।
এখন মনে হয় আর কিছুদিন মামা কে পেলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্যভাবে লেখা হত ।
পুরানো ঢাকা ছিল আমার কাছে এক বিষ্ময়ের অপর নাম ,প্রতিদিন অল্প অল্প করে আমার কাছে প্রকৃতি র সব আশ্চর্য রহস্য দুয়ার খুলে যাচ্ছিল ।স্কুলের নতুন বই খাতার ঘ্রাণ ,বই এর পাতার নতুন গল্প ছড়া কবিতা । প্রানের সই এর বন্ধুতার ও ছোট্ট একটা বীজ থেকে অবাক সারল্যে যেমন দুটি পাতা চোখ মেলে ঠিক তেমনি এক রত্তি পৃথিবী বদলে যাবার গল্প ।
আশে পাশের সব মিলিয়ে জনা কুরি সমবয়সী মিলে ; সন্ধ্যার সূর্য ডোবার আগতক চলত রহস্যভেদ। কাঁদামাটিতে অল্প পানি মিশিয়ে ঠিক কতটুকু ছানলে তীব্র মসৃন এক চমৎকার পুতুল বানানো যায় , জংলা পাতার মাঝে কোন আকৃতির পাতায় ভাত , টমেটো বেগুন হিসেবে রান্না করা যায় । নানী দাদীর জন্য পান সুপারি র পাতা সব চাইতে ভাল জন্মে পুরানো নোনা ধরা স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে সব চাইতে ভালো জন্মে সেই অজানা কে জানা। প্রচন্ড ঝড়ে উড়ে আসা চড়ুই পাখির ছানা কে মা' য়ে র পুরনো শাড়ি টুকরো তে ম্যাচ বক্সে কবর দেয়া সাথে দোয়া পাঠ এমনি সব কত কি__
আমারা পিঠাপিঠি দু' বোন ছিলাম সবচাইতে ভালো বন্ধু ;প্রতিদিন ফজরের সময় ঘুম ভেঙে সূর্য উঠা র আগে পর্যন্ত চলত আমাদের গল্প
ভাবনার বিনিময় আর স্বপ্নের বুনন ; আব্বার নামাজের তাকবির, মা' এর সুললিত কোরআন তেলোয়াত এর সাথে আমাদের প্রতিদিনের ভোর আসতো ; মিউনিসিপালটির কলে পানি আসার মত করে ।
শরত এর শুরু থেকে কয়েক গজ দূরের কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা "ছাতিম গাছাটা " সমস্ত গা ' উজাড় করে ফুল ফোটাত ; কি যে তুমুল সুবাস দিত সে মোহগ্রস্তের মত পায়ে পায়ে ফুল কুঁড়াতে যেতাম ,ছাতিমের ছায়া সঙ্গী ছিল দেয়ালের ও'পাড়ে থাকা "শিউলি গাছ" সাথে কিছু জংলী লতা মিলে বুনো গন্ধের ঐক্যতান । ফিরতাম কোঁচড়ে অগণিত ফুলের ঝাঁপি নিয়ে ,দরজায় আসা ফেরিওয়ালার
সময় ধরে ।
কলমি শাক নিয়ে আসত একজন ,পাঁচমিশালী সবজীর ঝাঁকা আলাদা ; কালা সাবান , সিলভারের হাড়ি পাতিলের ফেরিওয়ালা আসতো দু'পাশে দুই ঝুড়ি নিয়ে পুরনো জামা শাড়ির বিনিময়ে চকচকে সব জিনিস পাওয়া যেত ; স্পেলিং বুক , সুর করে গান গেয়ে চলা
strepsil পাতার লজেন্স ওয়ালা (উচ্চারন টা আমি আজও বুঝতে পারি নি) " পিপারমিন্ট স্টেপ , এ ক টা দশ পাই ,তি ন টা চাইর আনা " সর্দি কাশি রইবে না , মাথা ব্যথা রইবে না ।
এদের সবার সবার জিনিস বিক্রি করার আকুল সেই ডাকের মাঝে ও লুকিয়ে আছে আমার এক টুকরো শৈশব !!!!
বাসায় ফিরে অজু করে কায়দা নিয়ে আরবী পড়তে যাওয়া ,মসজিদে অজু করার পানির হাউস ভর্তি লাল সাদা মাছের বাহার মাঝে কিছু লাল শাপলা ; ঈদের দিন মসজিদের সামনের রাস্তা সহ আশের পাশের সমস্ত যায়গা জুড়ে ঈদের জামাত হত আমি ছাদে না হয় বাসার পাশের বারান্দায় অপেক্ষা করতাম সবাই মিলে একসাথে সেজদা দেয়ার সেই মহার্ঘ সফেদ ফুল ফোঁটার দৃশ্য দেখার ।
রোজার ঈদ এর সাত দিন আর কুরবানির ঈদ এর তিনদিন জুড়ে ধুপখোলা মাঠে ঈদ মেলা হত ,কি খেতাম ঈদে কিচ্ছু মনে নেই ;কিন্তু মেলায় যেয়ে সবার আগে কিনতাম কাঁচের সবুজ,লাল বাহারি চুড়ি ,মাটির বাসন কোসন অথবা ব্যাংক পরের মেলায় আসবার জন্য সেখানে পয়সা জমা রাখতাম । বাসার গায়ে লাগানো ছিল চৌধুরীর মুদি দোকান মনে হত আফ্রিকা মহাদেশের ঘন জঙ্গল ; কি ছিলো না সেখানে ? মাঝে মাঝে মা যদি কখনো কালি জিরা বা তেজপাতা ধরনের কোন মশলা আনতে দিতেন ভয়ে ভয়ে ঢুকতাম ,মনে হত গেলেই বুঝি চিরতার ডাল দিয়ে দিবে কিছু সাথে ।
চয়নিকা বই এর ছেলেবেলা ছিল আমার , "পাঠে আমার মন বসে না ,কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে" র মত উস্কানি দেয়া চমৎকার সব বাক্যের সমাহারে । এই চয়নিকা বই নিয়েই লিখে ফেলা যায় দিস্তার পর দিস্তা অবিরাম !!
হাট্টিমা টিম টিম ,মামুদ মিয়া বেকার , কালে খাঁ'র কামান , চক বাঁজারে 'র গোস্ত রুটি , সফদর ডাক্তার , "মেজাজ ছিল তিরিক্ষি তাঁর।
(আমার বড় বোন আমার চাইতে ছয় বছরের বড় ,নতুন বছরের নতুন বই নিয়ে সে প্রায়শই আমাদের ছড়া কবিতা পড়ে শোনাত,তাই স্কুল শুরুর আগেই আমি " তুমি যাবে ভাই ,যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয় " সহ বেশ কিছু মনে দাগ রেখে যাওয়ার মত কবিতা ছড়ার
রূপ রসে ধন্য ছিলাম )
এক বর্ষার পুরাটা সময় কলেরার ভয়ে বা পা'য়ের ছোট আঙুলের সাথে কোন এক ঔষধি গাছের আঁশ জড়িয়ে রেখেছিলাম ,এক বন্ধু বলেছিল " যার পেটে এক টুকরো লাউ থাকবে তার কখনো কলেরা হবে না " যতনে বিশ্বাসে লালন করেছিলাম সে সত্যি কে ।মা এর রান্না লাউ ডাল অথবা শোল মাছের লাউ ঝোল সোনা মুখ করে খেয়ে নিতাম সে'কদিন ।
আগেরদিন কুঁড়িয়ে পাওয়া রক্তজবার কলি টা কে চা'এর কাপে পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঘুমিয়েছিলাম,সেই দিনের ভোর ছিল আমার জন্য আদতেই আলাদা ;সকালে সদ্য ফোটা এক রক্তজবা আমাকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে সুপ্রভাত জানিয়েছিল ।
তখন ও জানতাম ফুল ক্যাবল গাছেই ফোটে ।
ও হ্যাঁ বলা 'ই তো হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসা চিনে আসতে পেরেছিল কিনা ?
লুকোচুরি খেলার জন্য সবগুলো স্পট খুঁজে পাবার আগেই ,মামা তার ক্লাস শেষ করে ফিরে এসছিলেন ;ভগ্ন হৃদয় সেদিন আর কিছুতেই উৎসাহ পায় নি ,পরের দিন সকালের পেপার আসছে না এই আনন্দটুকু ছাড়া ।
আব্বার ফজরের তাকবীর মা এর কোরআনের সূর একটা চয়নিকা বই ছাতিম শিউলির তুমুল সুবাস আমার ছেলেবেলা টাকে ভীষণ মমতায় আঁকড়ে রেখেছে ; এক দৌড়ে চলে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাঠ গোলাপের বিনিসুতার মালায় গেঁথেছে উচ্ছলতার উচ্ছ্বাস। কবি নজরুল কলেজের জঙ্গলের বুনো ফুলের রঙে ,ধুপ খোলা মাঠের কোরবানির হাট আর ঈদ মেলার কাঁচের চুড়ি নাগর দোলার আনন্দে লেখা আছে আজন্ম সুখের ছোঁয়া । ছোট গা'য়ে যাবার নিমন্ত্রণ কবিতা আর সাথে কিছু খেলা ঘড়ের তৈজসপাতি;
প্রানের বন্ধুর সব অযৌক্তিক কথা বিশ্বাসের সারল্যে গুলো এমনকি পুদিনা 'র ঘ্রাণ আর পুরানো ঢাকার ভাঙা গ্যারেজের মোবিল গ্রিজ ও সযত্নে মাখা থাকে ভাই বোনের হৃদ্যতা মা বাবা ও মামা র আহ্লাদে !!!
ছবি - গুগল সংগহ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৮