এ গল্পের সব ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কোন জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত ব্যক্তির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
(১)
সেক্টর সাতের এক খ্যাতনামা হাসপাতালে দক্ষ চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে জন্ম নিল কিরি। কিরির বাবা সেক্টর সাতের সুপ্রিম অথোরিটির সেবক। মা স্কুল শিক্ষক। কোন রকম কাটাছেড়া ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই সে ভূমিষ্ঠ হল। মা, ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে।
রুয়ের বাবা-মা দুজনেই বেসরকারি এক কোম্পানির কর্মী। তার জন্ম সেক্টর সাতের এক প্রাইভেট ক্লিনিকে। ডাক্তারের কোন বালাই নেই। তারা ঘরে বসে কমান্ড দেয় বাকি কাজটুকু অস্ত্রোপচারকারী রোবটরা সেরে ফেলে। সিজারিয়ান বেবি তাই রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, মাকেও সারাজীবন সিজারের ঝক্কি পোহাতে হবে।
(২)
কিরির জন্মের ছয়মাস পর তার মা স্কুলে যাওয়া শুরু করল। কিরির বাবার প্রতিপত্তিতে প্রিন্সিপাল সাহেব স্কুলে ডে কেয়ার সেন্টার খুলতে বাধ্য হলেন। শুধুমাত্র টিচারদের সন্তানরাই সেখানে থাকার সুযোগ পায়। কিরি সেখানে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করে সময় কাটায়। মা একঘণ্টা পরপর এসে দেখে যায়। বাচ্চাদের সামলানোর জন্য দুজন প্রশিক্ষিত আয়া রাখা হয়েছে।
ছয়মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে রুয়ের মা পড়ল মহাবিপদে। জীবনযাত্রার যে খরচ তাতে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আবার যে রোজগার তাতে বাচ্চা দেখাশোনা করার জন্য উচ্চ বেতনে প্রশিক্ষিত আয়া রাখাও সম্ভব না। অনেক খুঁজে স্বল্প বেতনে একজন আয়া পাওয়া গেল। তার কাছেই রুকে রেখে রুয়ের মা নেমে গেল সংসারের ঘানি টানতে। আয়া ছোট্ট রুকে খাওয়াতে খাওয়াতে বাচ্চাদের দেখা উচিৎ না এমন টিভি অনুষ্ঠান দেখে। রুয়ের সামনেই চলে অশ্লীল ফোনালাপ।
(৩)
সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন স্কুলে ভর্তি হল কিরি। শিক্ষকরা অনেক অমায়িক আর বন্ধুবৎসল। বুদ্ধিমান, মেধাবী ছাত্র হিসেবে কিরি বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। তার অনেক বন্ধু। ছেলে বড় হচ্ছে এসময় বাড়তি খেয়াল প্রয়োজন, কিরির মা তাই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে কিরির দুজন ভাইবোনও হয়েছে। স্কুল থেকে ফিরে কিরি ভাইবোনের সাথে খেলে, মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটায়।
রু ভর্তি হল শহরের মোটামুটি মানের এক স্কুলে। প্রাইভেট না পড়ার কারণে বেচারাকে শিক্ষকরা প্রতিক্লাসেই অপদস্ত করে। পিছিয়ে পড়া ছাত্রের সাথে কেউ মিশতে চায় না। বাবা-মায়ের সাথে খুব একটা কথা হয় না। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে বাবা বাসায় এসে ঝিমান, মা রান্নাঘরে ছুটেন। শুধু রেজাল্টের পর “তোমার লেখাপড়ার পিছনে কতো ইউনিট খরচ হয় জানো?” টাইপের কথাবার্তা শুনতে হয়।
(৪)
সেক্টর সাতে মানসম্মত ভার্সিটি আছে মাত্র কয়েকটা। অল্পকিছু সিটের জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে কামড়াকামড়ি চলে। অনেক সংগ্রাম শেষে একটায় চান্স পাওয়ার পর দেখা যায় প্রায় অপ্রয়োজনীয় কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়া লাগবে। কিরির বাবা সন্তানকে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতেই দেবে না। সেক্টর দুই আর তিনে অনেক ভালো ভালো ভার্সিটি আছে। সবগুলিতে আবেদনের পর একটায় কিরি পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল।
কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নফাস, জালিয়াতির মহাসমুদ্র পেড়িয়ে রু সেক্টর সাতের প্রথম সারির একটা ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। চোখে তার রঙিন স্বপ্ন। তবে অল্পদিনেই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল। তার মতো হাজার হাজার রুয়ের মধ্য থেকে গুটিকয়েক সুপ্রিম অথোরিটির সেবক হবার সুযোগ পাবে। বাকিদের বেছে নিতে হবে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেনের জীবন।
(৫)
কিরি এখন নামী ভার্সিটি থেকে পাস করে আসা দামী চাকুরে। শীর্ষস্থানীয় এক বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে আছে। তাকে নিয়ে বাবা-মার গর্বের শেষ নেই। সুপ্রিম অথোরিটি পরিবারের এক মেয়ের সাথে তার বিয়ের কথা চলছে।
রু চার বছর ধরে সুপ্রিম অথোরিটির সেবক হওয়ার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। দুবার খুব কাছে গিয়েও খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। এখন সে এক বেসরকারি কোম্পানির কর্মী।
পরিশিষ্ট
টিভিতে সেক্টর সাতের সুপ্রিম লিডারের ভাষণ চলছে – “৫৫ বছর আগে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেক্টর সাতের জন্ম হয়। সে লক্ষ্য পূরণে আজ আমরা অনেকাংশেই সফল”। টিভির সামনে বসে আছে রু। কিন্তু সুপ্রিম লিডারের কথা তার মাথায় ঢুকছে না। চাকরিতে এবছরের টার্গেট পূরণ হয়নি, স্ত্রী গর্ভবতী, মা শয্যাশায়ী; সামনে অনেক খরচ। এতোকিছু কিভাবে সামলাবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:২৪