দুবলার চর। সুন্দরবনের অস্থায়ী পুরুষ বসতি। এক অস্থায়ী গ্রাম। ঘোরেপ্যাঁচে কোনো নারী সেখানে পৌঁছে গেলে দিনে দিনে তাকে ছেড়ে আসতে হয় চর। এটাই নিয়ম। ভাসান নদীর বুকে সাগরের মুখে এই চরে পুরুষেরা বছরের শুকনা মৌসুমে পাঁচ মাসের গ্রাম বেঁধে থাকে। দুশো বছর ধরে সেখানেই বসে রাসপূজার আসর। রাসমেলা। দূরান্ত থেকে শতশত নারী পুরুষ তীর্থযাত্রী সেখানে গেলেও মেলা শেষে ফিরে আসে সবাই। থেকে যায় শুধু সমর্থ পুরুষেরা যারা সেখানেই যায়। তারা সেখানে যায়- থাকে আর বড়ো বড়ো মহাজনের নামে মাছ ধরে- শুঁটকি বানায়- নৌকায় শুঁটকি তুলে দেয়। তারপর আবার ফিরে আসে নিজেদের গ্রামে। যাবার সময় তারা রাস্তা থেকে- বিধবাদের গ্রাম থেকে- দরিদ্র পল্লি থেকে জোর করে কিংবা ফুসলিয়ে কিংবা টাকার কথা বলে সাথে নিয়ে যায় অসংখ্য কিশোর। তাদের কাজ বেশি নেই। শুঁটকি শুকাবে- শুঁটকি তুলবে- রান্নাবান্না করবে- খাবেদাবে ঘুমাবে এই তাদের কাজ। কিন্তু সেই কিশোরেরা চরে পা দিয়েই দেখে চারপাশে থৈ থৈ জল। চরে পা দিয়েই দেখে মহাজনের নৌকা ছাড়া বাড়ি ফিরবার আর কোনো পথ নেই। চরে পা দিয়েই মুখোমুখি হয় কিল থাপ্পড় ঘুসির। তারপর তাদের যেতে হয় দূর সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে। তাদের যেতে হয় ভয়ানক খালে মাছ ধরে আনতে। তাদের টানতে হয় নৌকা- বাছাই করতে হয় মাছ। সামলাতে হয় শুঁটকি। কাঁধে করে নৌকায় তুলে দিতে হয় ভারী ভারী শুঁটকির বোঝা। এবং যদি অসুস্থ কিংবা মৃত হয়ে পড়ে কেউ। তবে তার লাশ ভেসে যায় সুন্দরবনের যে কোনো খালে কুমির কিংবা কামটের খাদ্য হয়ে। এবং তারপরও যদি টিকে থাকে কেউ তবে মৌসুম শেষ হবার আগে পর্যন্ত নারীবিহীন দুবলার চরে তাদেরকে মেটাতে হয় সমর্থ পুরুষদের নারীদেহের ক্ষুদা...
দুবলার চর ঘেঁষে আমাদের ট্রলার যখন যায় তখন আমাদের চোখ আটকে ছিল বিশাল একটা বানর পরিবারে। কেউ আগায় কেউ পিছায় আর সবাই ধরা পড়ে ক্যামেরায়। দুটো কিশোর তাকিয়ে ছিল আমাদের নৌকার দিকে। বিস্ময়ে আমরাও তাকাচ্ছিলাম তাদের দিকে। তারা কাদায় হাত ডোবায় আর মাছ তুলে এনে লুঙ্গির কোঁচড়ে রাখে। মাছ ধরা এতো সহজ। বিস্ময় কাটে না আমাদের। দুবলার চরে এতো মাছ। কাদায় হাত দিলেই মাছ। কিন্তু আমাদের জানা হয় না এই মাছ নদীর মাছ নয়। জাল থেকে পড়ে যাওয়া কিংবা ফেলে দেয়া কাদায় আটকে থাকা মাছ। এই মাছ সেদ্ধই হয়তো দুই কিশোরের আজকের খাবার কিংবা কালকে সকালেরও। তারাও আমাদের দিকে তাকায় আর মাছ ধরে। আমরা নদী দেখি আর তারা ফিরে যায় গ্রামে...
ততক্ষণে আমাদের অনেকেই অন্য ট্রলারে করে নেমে গেছে দুবলার চরে। শহরের দশভাগের একভাগ দামে নিখুঁত শুঁটকির আশায় অনেকেই হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেছে চরের অনেক ভেতরে। আমরা চারপাশ ঘুরে এসে যখন চরে নামি তখন প্রায় সন্ধ্যার শেষ বিকাল। মাছধরা সেই দুটো কিশোর এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। একজনের আছে দুইশো টাকা আরেকজনের আছে তিন শো। এই টাকা তারা আমাদের দিতে চায়। বিনিময়ে শুধু আমাদের জাহাজে করে তাদেরকে নিয়ে কোনো লোকালয়ে ছেড়ে দিতে হবে...
দুটো কিশোরের বাড়ি কক্সবাজার। শুঁটকি মহাজনের সাথে গিয়ে আব্দুল ওহাব সেখানে তাদের সাথে খাতির জমায়। তারা তখন বাজারে এটা ওটা করে আর ঘুরে বেড়ায়। আব্দুল ওহাব তাদের দুবলার চরের কথা বলে। লাখে লাখে মাছ আর হাজারে হাজারে মণ শুঁটকি। যত মাছ ধরবা তত শুঁটকি। যত শুঁটকি বানাবা তত টাকা...
দুই কিশোরের চোখ টাকার লোভে চকচকে হয়ে উঠলে মহাজনের নৌকায় উঠে তারা এসে ভিড়ে দুবলার চরে। এবং তারপর আজ আমাদের সাথে দেখা...
আমাদেরকে খুচরা টাকার লোভ দেখিয়ে অনুনয় করে দুই কিশোর। আমরা তাদের অনুনয়ের ছবি তুলি। আমরা বিস্তারিত জানতে চাই আব্দুল ওহাব তাদের সাথে ঠিক কোন কোন কাজ করে। আমরা জানতে চাই আব্দুল ওহাবের শাস্তির ধরন। কিশোরেরা মুখ কাঁচুমাচু করে বর্ণনা দেয় রাতের আর দিনের আব্দুল ওহাবের। আমরা শুনি আর ছবি তুলি আর দুবলার চর দেখি। আমাদের সাথে দুই কিশোর একটু একটু হাঁটে আর গলা নিচু করে অনুনয় করে। অনুনয় করতে করতে যখন তাদের চোখে সুন্দরবনের খাল বয়ে আসে তখন আমরা- যাবার সময় দেখা যাবে বলে তাদেরকে ঘাটের কাছে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে যাই চরের ভেতর। আমরা দেখি শুঁটকি বানানোর কৌশল। আমরা দেখি কোন মাছ শুঁটকি হলে কেমন দেখায়। আমরা দেখি মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসা কাঁকড়া...
এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে আমাদের গার্ড। জাহাজ থেকে নেমে আসে জাহাজের লোক। তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি সবাই ফিরে চলেন বোটে। ডাকাত পড়েছে ডাকাত। সত্তর জনের নতুন এক ডাকাতদল নেমেছে চরে। এরা মানুষ মারে। মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়। মানুষ ধরে নিয়ে আদায় করে মুক্তিপণ...
আমরা কেউ বিশ্বাস করি- কেউ করি না। ফরেস্ট আর টুরিজমের লোকদের কাজই হলো ভয় দেখিয়ে ছোট এক জায়গায় সবাইকে আটকে রাখা। তাতে তাদের কষ্ট কম। ঝামেলা কম। তাই আমরা কেউ এগিয়ে যাই চরের ভেতরে- কেউ ভয় পেয়ে দৌড়াই নৌকার কাছে। আর কেউ এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে এলোমেলো হাঁটি। এর মধ্যেই গলায় মাফলার- মাথায় টুপি দিয়ে বাজার থেকে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসে আব্দুল ওহাব। দ্রুতপায়ে আমাদের পাশ কাটাতে কাটাতে আওয়াজ দেয়- ওদিকে যাবেন না আপনারা। ফিরে যান নৌকায়
- কেন কী হয়েছে?
আব্দুল ওহাব গতি কমায় না। আমরা তার গতি ধরে হাঁটি। আব্দুল ওহাব ডানে বামে তাকিয়ে গলা নামায়- কারে বিশ্বাস করা যায় কারে না; জানি না। তবু বলি নতুন একটা দল নেমেছে ওই পাশে। আপনারা ফিরে যান
আব্দুল ওহাবের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা জিজ্ঞেস করি- আপনি কোথায় যান?
আব্দুল ওহাব থামে না। হাঁটতে হাঁটতে বলে- ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ব আমি। আপনারা ফিরে যান
আব্দুল ওহাবের সাথে আমরা ফিরে আসতে থাকি নৌকার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে জেনে যাই সে ঘরে গিয়ে কিছু টাকা বাইরে রেখে বাকিগুলো লুকিয়ে রাখবে কোথাও। সন্ধ্যা নামার আগেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা এসে হানা দেবে প্রতিটি অস্থায়ী ঘরে। আসার আগে রাস্তায় কিছু মারধর করতে করতে আসবে জানান দিয়ে। তারপর ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে চাইবে নির্দিষ্ট অংকের টাকা। টাকা আসতে দেরি হলে কিংবা দরদাম করলে কিংবা যদি কোনো ট্যা-ফে বের হয় মুখ থেকে তবে মারধর আর আস্তানা জ্বালিয়ে দেয়া তো নগদ তার সাথে একটা বুলেটও জুটে যেতে পারে পেটে। তাই আব্দুল ওহাব আগেভাগে বাড়ি যায় টাকা বের করে রাখতে....
আমরা উঠে আসি নৌকায়। হয়তো ডাকাতের ভয়ে। হয়তো আব্দুল ওহাবকে দেখে অথবা হয়তো আমাদের উপর বিশ্বাস হারিয়ে সেই দুইটা কিশোর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে আর নেই। কোস্টগার্ড আর ফরেস্টের লোকজন যারা দুবলার চরে পাহারায় ছিল তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমাদের উপর- এক্ষুনি এই জায়গা ছেড়ে যান। সমস্যা- সমস্যা- অনেক সমস্যা হবে এখানে। চলে যান। তাড়াতাড়ি যান। জাহাজের লোকজনও অস্থির হয়ে উঠে জাহাজ ছাড়তে। কিন্তু আমরা ছাড়তে পারি না। ছবি তুলতে তুলতে চরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া তুষারেরা এখনও ফেরেনি ঘাটে
আমরা সবাই উঠে আসি জাহাজে। জাহাজের লোকজন জানিয়ে দেয় মাত্র ঘণ্টাখানেক থাকবে সূর্যের আলো। ঠিক ততক্ষণই অপেক্ষা করবে তারা। তারপর কেউ এলো না এলো না দেখেই জাহাজ ছেড়ে দেবে তারা...
ফরেস্টের লোক আর কোস্টগার্ড বারবার এসে তাড়া দেয়। জাহাজ নোঙর উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নদীর মাঝ বরাবর। আমরা জাহাজের ছাদে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে থাকি ডাকাত কিংবা চিৎকার কিংবা গোলাগুলি কিংবা তুষারদের দেখার অপেক্ষায়। অন্ধকার হয়ে আসছে চর। এর মাঝে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি চরের ঘাটে ছোট নৌকায় দাঁড়িয়ে আছে দুইজন মানুষ। একজন বাপ্পী ভাই আরেকজ ফরেস্টের সেই তরুণ গার্ড সুমন
জনমানবহীন চরে দুটো মানুষ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ডাকাত পড়া দুবলার চরে নিখোঁজ তুষারদের। জাহাজ থেকে বারবার তাদের ডেকে বলা হচ্ছে চলে আসার জন্য। কিন্তু সব ডাক উপেক্ষা করে দুজন মানুষ আলাদাভাবেই একা একা দাঁড়িয়ে থাকে দুবলার চরের অন্ধকারে...
আমি জানি শ্যাম নগরের গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পীকে বনের সকলেই চেনে। তাকে ঘাঁটাবে না কেউ। কিন্তু সত্তরজনের এক ডাকাতদলের সামনে একা একটা চাইনিজ গান হাতে দাঁড়ানো সুমন বড়োই বেমানান। যেখানে কোস্টগার্ড চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। যেখানে স্থানীয় ফরেস্টের লোকজন সরে গেছে নৌকা নিয়ে। সেখানে একটা বন্দুক নিয়ে এরকম বেয়াড়া লিকলিকে তরুণের দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই বেয়াদবির সমান
গত কয়দিন সুমনের বেয়াড়াপনায় বিরক্ত আমাদের সবাই- ওখানে যাওয়া যাবে না মানে যাবে না। আর কোনো কথা নেই। আপনাদের সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার...
এরকম চটাং চটাং কথাগুলোকে চূড়ান্ত বিরক্তিকর মনে হয় আমাদের কাছে। সুন্দরবনে আনাড়ি কেউ নেই এই দলে। আমরা আমাদের মতো চলতে থাকি। সুমন ফিরে যাবার হুমকি দেয়। ফিরে গিয়ে আমাদের নামে রিপোর্ট লেখার হুমকি দেয়। আমরা পাত্তা দেই না কারণ আমরা জানি সুমন আমাদের বিরুদ্ধে বন আইন ভঙ্গের রিপোর্ট দেবার আগেই নেটওয়ার্কে ঢুকে আমাদের অনেকের একটা ফোনই সুমনকে তার চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবার জন্য যথেষ্ট। তাই তাকে আমরা উল্টো ধমক লাগাই। সিনিয়র গার্ড তাকে বোঝায়। সুমন গজগজ করে আর রাইফেল বাগিয়ে তাকায় গাছের গোড়া বরাবর। সে জানে বাঘ কোন দিক থেকে আসে। তাই ছবি তোলার জন্য ডাকলে তাকায় না সে। সে তাকিয়ে থাকে তার যেদিকে তার তাকাতে ইচ্ছা করে সেদিকেই...
হয়ত সুমন তার নিজের জন্যই তাকায়। সে জানে বাঘের গায়ে গুলি করার অধিকার নেই তার। তার বন্দুক শুধু শব্দ করে বাঘকে ভয় দেখানোর জন্য। তাই সে যদি আগে দেখতে পারে তবে সে বেঁচে যাবে। দেখতে দেরি হলে থাবা দেয়া বাঘকে সরানোর জন্য কোনো গুলি ছোঁড়ার ক্ষমতা থাকবে না তার। কিন্তু সুমনতো ডাকাতদের জানে। আব্দুল ওহাব যেমন জানে না আশেপাশে ছদ্মবেশে ডাকাতদের কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে কি না। তেমনি সুমন কি জানে না যে অন্ধকারে তাকে দেখছে না কেউ? সুমন তাকাচ্ছে না কেন ডাকাতদের দিকে? সে কি অনুমান করতে পারছে না ডাকাতেরা কোন দিকে আসতে পারে?
সুমন হয়তো জানে। জানে সত্তরজনের একটা দল এলে কী হবে তার। তাই কোনো দিকেই সে তাকায় না। পাটখড়ির মতো শুকনা হাতে শরীরটা টানটান করে রাইফেল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে- আসবি যদি আয়। পারব না জানি তবু কয়েকটা তো ফেলা যাবে মরবার আগে....
আমার ইচ্ছা করে সুমনকে ডাক দিয়ে বলি- সুমন উঠে আয় জাহাজে...
কিন্তু তাকে আর ডাকি না আমি। সে থাকুক তার অহংকার নিয়ে। সে অপেক্ষা করুক তুষারদের প্রতি তার দায়িত্ব জেনে। সত্তরজন ডাকাতের বিরুদ্ধে সে একাই দাঁড়িয়ে থাকুক দুবলার চরের অন্ধকারে তার সাহসে ভর করে...
সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর
সাকিন সুন্দরবন ২। বনপর্যটক
সাকিন সুন্দরবন ৩। মরণখোর
সাকিন সুন্দরবন ৪। ভাতারখাগী
১. ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১২:১২ ০
সুন্দরবনের গহীনে গিয়েছিলাম দু'বার...আর একবার করমজল পর্যন্ত