দ্বিতীয় দুপুরে হংসরাজ নদীর পাড়ে যখন আমরা ফরেস্টের পরিত্যক্ত টহল ফাঁড়িতে গোসল করার জন্য থেমেও নামলাম না কাদাপানির জন্য। নৌকায় দাঁড়িয়েই ছবি তুলতে লাগলাম আইলাঝড়ে ভাঙা গাছে-গোলপাতায় বানানো ফরেস্ট ছাউনি আর নদীর পাড়ে কাঁকড়া ধরতে চেষ্টা করা সাদা বিড়ালটার; যাকে লোক বসতির অংশ বানিয়ে লোকালয় থেকে কেউ একদিন ছাউনিতে এনেছিল। কিন্তু ছাউনি ছাড়ার সময় আর ফিরিয়ে নেয়ার কথা মনে হয়নি কারো। বিড়ালটা তবু ভাঙা ছাউনির কাছাকাছিই থাকে এই আশায় যে- হয়ত একদিন কেউ তাকে আবারও ডাক দেবে ঘরে...
কেউ বিড়াল। কেউ সুন্দরবনকে ফ্রেমে ধরি আমরা। নৌকার লোকজন কাদা ভেঙে পানির জার নিয়ে নেমে যায় ভাঙা ছাউনির পুকুরের দিকে। এবং ডানে- দূরে ছোট্ট একটা নৌকা আমাদের ক্যামেরায় ঢুকে পড়ে। ফ্রেমে আটকাতে আটকাতে দুই মানুষের নৌকাটা এসে ভিড়ে আমাদের নৌকার কাছে। একই ঘাটে
তিন মাথাওয়ালা এক মানুষ এমাথায় বসা। মাথাটা ঢুকে গেছে দুই হাঁটুর ভেতর কিংবা হাঁটু দুটো মাথা হয়ে উঠে গেছে মূল মাথার পাশে। অন্যপাশে বেঁটেখাটো একটা গোঁয়ারমুখো তরুণ; তাগড়া আর ক্ষ্যাপাটে শরীর। দুজনেই বড়ো বড়ো বঁড়শিতে চিংড়ি আর ছোটমাছের টোপ পরাচ্ছে নদীতে ফেলার জন্য
ঠিক তখনই আমাদের নৌকা থেকে কেউ একজন আওয়াজ দেয়- এই তোমরা কোন জায়গার?
তিনমাথাওয়ালা আমাদের দিকে না তাকিয়েই গ্রামের নাম বলে। তখন পর্যন্ত আমাদের সাথের ফরেস্টাররা কেউ লুঙ্গি পরে কেউ খালি গায়ে দাঁড়ানো ছিল। নৌকা দেখেই লুঙ্গির উপর খাকি শার্ট পরে এসে দাঁড়ায়- পাস আছে তোমাদের?
তিন মাথাওয়ালা এবার চমকে তাকায় আমাদের দিকে। পটাপট ছবি তুলছে সবাই; মাঝি নৌকা মাছের টোপ বঁড়শি... আর আমাদের পাশে খাকি পোশাকে ফরেস্টের গার্ড। নৌকায় বনবিভাগের সবুজ পতাকা। মুহূর্তে ঘোলা হয়ে যায় লোকটার চোখ। পরিষ্কার আতঙ্ক নিয়ে লোকটা একটু হাসার চেষ্টা করে- আছে স্যার। পাস আছে আমাদের
- কোন জায়গার পাস?
বিনীত ভয়ে লোকটা কোনো এক ফরেস্ট ফাঁড়ির নাম বলে। জোর করে হাসে- পাস ছাড়া আমরা বনে আসি না স্যার। সেরম লোক না আমরা
তারপর মুখের মধ্যে বঁড়শিগাঁথা মাছের মতো হা ঝুলিয়ে আমাদের প্রত্যেকের দিকে আলাদা আলাদা করে তাকায়। নিশ্চয়ই আমরা সবাই ফরেস্টের কোনো কর্তা কিংবা অফিসারের শালা সম্বন্ধী ভায়রা ভাই
- তোমরা একাই না আরো নৌকা আছে?
- স্যার আমরা মোট তিন নৌকা। দুইটা পেছনে আসতেছে
- এই আতিয়ার একটা পাতিল দে দেখি। কিছু চার নেই
মাছের টোপকে বলে চার। বাপ্পী ভাইর গলা শুনে তিন মাথা চমকে উঠে বাপ্পী ভাইর দিকে তাকিয়ে না শোনার ভান করে আবার চার গাঁথতে থাকে। অতক্ষণ যেখানে সে একেকটা আঙুল সাইজ চিংড়ি কিংবা ছোট মাছ পটপট বঁড়শিতে গেঁথে সাজিয়ে রাখছিল ঝুড়িতে। এবার দেখলাম তার হাত ফসকাল কয়েকবার...
- দেও দিকিনি। এইটাতে কিছু চার দেও তো
বাপ্পী ভাই একটা গামলা ছুঁড়ে মারল লোকটার নৌকায়। গামলাটা তার কোলের কাছে পড়লেও অনেকক্ষণ সেদিকে তাকালই না লোকটা। হাঁটুতে মাথা গুঁজে থাকলেও বাপ্পী ভাইর তার দিকে তাকিয়ে থাকা অনুভব করছিল সে। এবার বাপ্পী ভাইর দিকে তাকিয়ে গামলাটা টেনে নিজের গামলা থেকে বেছে বেছে কেজি দেড়েক চিংড়ি আর বারোয়ারি মাছ তুলে দিয়ে বাপ্পী ভাইর হাতে দেবার জন্য যখন উঠে দাঁড়াল তখনই- অ্যাহ। এইটাতে কী হবে? ওর ওখান থেকেও কিছু দেও...
লোকটা হাত গুটিয়ে বসে পড়ার আগেই আমরা তাকে গামলা ধরে পোজ দিতে বললাম। জেলের হাতে তরতাজা মাছ। দারুণ সমৃদ্ধির প্রতীক... ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে দিয়ে ছবির পোজ দেয়ালাম। তারপর ছেড়ে দিলে লোকটা নিজের জায়গায় বসে গামলাটা নৌকার ভেতর দিয়ে ঠেলে দিল অন্য গলুইয়ে বসা গোঁয়ার ছেলেটার দিকে- দ্যাও। কী দেবা দেও। স্যাররা কিছু চার চায়...
একটু পরে আরো কিছু মাছ নিয়ে গামলাটা তিন মাথার কাছে ফিরে এলে সে বাড়িয়ে দিলো বাপ্পী ভাইকে। খেঁকিয়ে উঠল বাপ্পী ভাই- কী দিলা এইসব? আরো কিছু দেও। আমারাও তো মাছ ধরব...
লোকটা নিজের গামলা থেকে আরো কয়েকটা মাছ তুলে দিলো আমাদের গামলায়। বাপ্পী ভাই অতগুলা মানুষের মাছ ধরার জন্য আরো কিছু চার চায়। লোকটা এবার আর নড়ে না। আমাদের গামলা আর তার নিজের গামলার দিকে তাককায়। তার গামলায় টোপের পরিমাণ আমাদের গামলার অর্ধেক। লোকটা মরিয়া হয়ে উঠে আতঙ্কে- স্যার। আর দিলি আমাগের চার হবে না স্যার...
বহুক্ষণ সে আর নিজের বঁড়শিগুলোতে চার গাঁথার সুযোগই পায় না। নৌকা সামনে নিয়ে- পেছনে ঠেলে- সোজা-ব্যাঁকা বানিয়ে চাহিদামতো পোজ দিতে থাকে আমাদের ছবির...
- মাছ নাই তোমাদের সাথে?
সুন্দরবনের মাঝির বৈঠাধরা হাতও কি কেঁপে উঠে এবার?
লোকটা চমকে উঠে একটা হাসি দেয় শুধু
- কই দেখি। কী মাছ দেখাও তো?
লোকটা মুখের বঁড়শিগাঁথা হা-টাকে আরো বড়ো করে এবার- এই নৌকায় নাই স্যার। পেছনের নৌকায়
- ওরা কই?
- এখানেই আসবে স্যার...
ওর কাছ থেকে পাওয়ার মতো সবগুলো ফ্রেম শেষ হয়ে যাওয়ায় ফটোগ্রাফাররা ওকে ছাড়ে আর আর বাপ্পী ভাইর চোখ পড়ে আইলাভাঙা ফরেস্ট ছাউনির দিকে- এই ওহাব। যা তো দেখি ওখান থেকে কিছু জ্বালানি কাঠ নিয়ে আয়
আব্দুল ওহাব কুড়াল নিয়ে ছাউনির আড়াল থেকে একটা ঘুণে ধরা শুকনো খুঁটি ভেঙে নিয়ে আসে
- বাড়া একটা ভূতে চুদা তুই। কী নিয়া আসছিস এইটা?
ওহাব বেক্কলের মতো তাকায়। বুঝতে পারে না চুলায় জ্বালানোর জন্য এইখানে এর চেয়ে ভালো আর কোন কাঠ?
- যা ওইটা নিয়া আয়
বাপ্পী ভাই আঙুল তুলে শক্ত বড়ো এবং ভেজা কয়েকটা গাছের গুঁড়ি দেখায়। ওহাব বুঝতে পারে জ্বালানি কাঠ মানে কী? শুকনা গাছটা পানিতে ফেলে সে এবার এগিয়ে যায় ছাউনির দিকে...
- কতদিন থেকে আপনারা নদীতে আছেন?
অতক্ষণে আবার চার গাঁথার সুযোগ পাওয়া তিন মাথাওয়ালা আকাশের দিকে তাকিয়ে হিসাব করে- আজকের দিন গেলি আটাশ দিন হবি...
- কতদিন থাকবেন আর?
- আমাদের পারমিট দেড় মাসের
এমন সময় অনেক দূরে জোড় বেঁধে আসা দুটো নৌকাকে ক্যামেরাগুলো কামড়ে ধরে নদীর মাঝখানে। ক্যামেরায় বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে আসে আমাদের ট্রলার পর্যন্ত। জোড় ভেঙে একটা নৌকা এসে যোগ দেয় তিন মাথার নৌকার কাছে। আরেকটা উল্টোদিকে গিয়ে ভিড়ে বিড়াল পাড়ের কাছে
- মাছ কোন নৌকায়?
কেউ উত্তর দেয় না। তিনমাথা নতুন নৌকায় ইশারা দেয়। একটা ছেলে নামে। দীর্ঘ সুঠাম আর টানটান। কালো টিশার্টের নিচে প্রায় স্কিনটাইট একটা শর্টস। ছেলেটা কাছে এলে তিনমাথা কানে কানে কিছু বলে। একটা গামলা নিয়ে ছেলেটা এগিয়ে যায় বিড়ালের পাশে ভেড়ানো অন্য নৌকার দিকে...
শুনেছি বাঘের গতিকে ক্ষিপ্রগতি বলে। গামলা হাতে ছেলেটা যখন ঝপাস ঝপাস পানি ভেঙে এগোচ্ছিল তখন একবারও মনে হয়নি তার পায়ের নিচে পা কামড়ানো কাদাও আছে হাঁটু সমান। একটু সামনে ঝুঁকে ছেলেটার এগিয়ে যাওয়া আমাকে মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলায় পড়া গালিভারের গল্প। আমি পরিষ্কার দেখি বিপক্ষ দেশের যুদ্ধ জাহাজগুলোকে সুতায় বেঁধে হাঁটুপানি সমান সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গালিভার। সুন্দরবনের সব নদীই এই টানটান ছেলের হাঁটুপানি সমান...
কিন্তু বিড়াল নৌকার পাশে গিয়ে হঠাৎ ছেলেটা তিনমাথা হয়ে যায়। শরীরটাকে মুচড়ে কুঁকড়ে গামলা হাতে ঢুকে পড়ে ছইয়ের ভেতর
কিছুক্ষণ পর গামলাসহ একটা হাত বের হয় নৌকার বাইরে। হাত দেড়েক লম্বা চারটা আইড় জাতীয় লোনাপানির মাছ। দুই থেকে আড়াই কেজি ওজন একেকটা অনুমান। বরফের বাষ্প উড়ছে মাছগুলো থেকে। খোলের ভেতরে বরফ দিয়ে রাখ ছিল মাছগুলো
- এইটা কী দিলা। অতগুলান মানুষ আমরা...
ছেলেটা বের হতে হতে আবার ঢুকে যায়। আরেকটু বড়ো সাইজের আরেকটা মাছ রাখে গামলায়। সেখানে বসেছিল আরেকজন। একটু মোটাসোটা কিন্তু চেহারা সেই তিন মাথাওয়ালার। কিছুই দেখছিল না সে অতক্ষণ। এবার কোঁকিয়ে উঠে- স্যার মাছ পাই নাই তেমন। মাহাজনের ট্রলার আসলি দিতি পারব না কিছুই...
ঠিক তখনই কেউ আবিষ্কার করে বিনিমাগনায় মাছগুলো উঠছে আমাদের ট্রলারে...
- এই মাছগুলোর দাম কত?
বোকার মতো তাকায় মোটা তিনমাথা। গামলাটা সেখানেই রেখে সেই ছেলেটা ঝপঝপ পানি ভেঙে আবার চলে গেছে নিজের নৌকায়। কিন্তু মাছের দাম বলে না কেউ
- এই মাছ আমরা খাবো না। বলেন মাছের দাম কত?
- আপনারা এইসবে নাক গলান কেন? পয়সা দিতে হলে আমি দেবো। আপনারা আপনাদের ছবি তোলেন
নেংটি পরা শরীরের উপর আধা সেকেন্ডের জন্য ঝিলিক দিয়ে চোখদুটো আবার মরা ইলিশের চোখ হয়ে যায়। হাতদুটোকে জোড়হাতে মাপ চাওয়ার মতো প্রশ্নকারীর দিকে তুলে মুখ খোলে- না না দাদ-দাদ-দাম ককককিসের? এই মাছ আপনাগের পাপ-পাপ-পাওনা। ফফফরেস্টারের পাপ-পাওনা এই মাছ
হয়ত বা লোকটা এমনিতেই তোতলা। অথবা তোতলাচ্ছে সে। তোতলাতে তোতলাতেই যোগ করল- এই মাছের দাম নেয়া তাদের জন্য পাপ। তারা গিয়ে মহাজনকে বলবে আমাদের মাছ দেয়ার কথা। কারণ ফরেস্টের লোক হিসেবে এই মাছ আমাদের পাওনা...
মাছের দাম নেয়া পাপ। সততার এই শব্দগুলো শুনতে পায় সবাই। কারো ফ্রেমেই ধরা পড়ে না দাম জিজ্ঞেস করার সময় জেলেটার দিকে বাঘের চোখ রাঙানি করা দুইজোড়া চোখের ছবি। ফরেস্টারের কাছে টাকা চাইলে সুন্দরবনে জেলের জীবন কতটা পানির নিচে ডুবতে পারে জেলেটার সেই ভয় পড়তেও পারে না কেউ। জানতেও পারে না ওজন করে ট্রলারে তুলে দেবার আগে পর্যন্ত কোনো মাছের হিসাবই উঠে না মহাজনের খাতায়। এই মাছ দাদনে বান্ধা খাওয়া জেলের বাঘ- কুমির- কামটের ঘর থেকে তুলে আনা মাছ। এই মাছ দিয়ে দাদনের দায় শোধ হয় তার...
- গোসলটা সেরে আসি
ফরেস্ট গার্ড গাজী ভাই হঠাৎ প্যান্ট শার্ট খুলে লুঙ্গি পরে গামছা কাঁধে নিয়ে নিলো
- যাবেন কেমনে? অনেক কাদা তো
- এই যে এই নৌকায় উঠে যাব। ...নৌকাটা কাছে আনো তো
- কিন্তু গোসল করতে করতে তো ওরা চলে যাবে। ফিরবেন কেমনে?
- নাহ। যাবে আবার কই? পরে যাবে
তিনমাথাওয়ালা গাজী ভাইকে গোসল করার জন্য পাড়ে তুলে বসে থাকে চুপ। বিড়াল পাড়ের নৌকা থেকে আরেকজন নামে একটা খালি কলসি নিয়ে। খোঁপা করা দীর্ঘ চুল। কিন্তু রুক্ষ শুকনা রংচটা। হয়ত লোকটা একজন শিল্পী। হয়ত জেলেপাড়ার ফকির আলমগীর কিংবা কবি নজরুল কিংবা মুস্তাফিজ
শিল্পী জেলে ধীরে ধীরে পানি আনতে পুকুরে যায়। ...ভরা কলসি ঘাড়ে করে ফেরে। বঁড়শিতে চার গাঁথা শেষ। কিন্তু হুকুম না হলে যেতে পারবে না তারা। আমাদের একজন তার হাতে একটা রেডিও ধরিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয় সুন্দরবনের জেলে রেডিও শুনছে সেই পোজ কীভাবে দিতে হবে। সুন্দরবনেও পৌঁছে গেছে টেকনলজির সুবাস। জিন্দাবাদ ডিজিটাল বাংলাদেশ; অনেকগুলো ছবি উঠে; ডানহাতে বৈঠা- বামহাতে রেডিও। বামহাতে বৈঠা ডানহাতে রেডিও। ফটোসেশন শেষ হলে নৌকাটা জায়গায় নিয়ে পাড়ে উঠে একটা দুটো কাঠের টুকরা কুড়ায়। ছোট ছোট শুকনা কাঠের টুকরা। কুড়িয়ে এনে নৌকায় চুলার পাশে রাখে। আর কোনো কাজ পায় না সে। বসে থাকে আমাদের হুকুমের অপেক্ষায়...
বহুক্ষণ হয় গাজী ভাই গোসল করে ফিরেছেন। রোদ পড়তে শুরু করেছে সুন্দরবনে; আমরা আমাদের ক্যামেরায় মগ্ন। হঠাৎ একটা মিনমিনে আকুতি শোনা যায়- আমাগের যে এবার বিদায় দিতি হয় স্যাররা। চার দেবার বেইল চলি যাচ্ছে...
- আরে এরা বসে আছে কেন? এদের কাজতো শেষ... যাও যাও। চলে যাও তোমরা
মুহূর্তে জেলেদের হাতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠে বৈঠায়। কিন্তু তিন মাথার সঙ্গী গোঁয়ার ছেলেটা গোঁ গোঁ করে কী যেন বলে। তিনমাথা বোকার মতো আমাদের দিকে তাকায়। আমরা একটা ভিক্ষুকের মতো আওয়াজ শুনি- খাবার কিছু থাকলি আমাগের দুই এক মুঠো দেন গো স্যারেরা। পোলাপান মানুষ বনের মইদ্যি বহুদিন ভালোমন্দ খাতি পায় না কিছু...
খেঁকিয়ে উঠে বাপ্পী ভাই- এইটা খাবারের টাইম নাকি মিয়া? এখন খাবার পাবা কই?
নৌকা ঘুরিয়ে ওরা রওয়ানা দেয়। যেতে যেতেও আমাদের দিয়ে যায় আরো কিছু ছবি...
সন্ধ্যা নেমে এলে ভদকার বোতল খুলে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি রান্নার। খাবার তৈরি হলে ভাতের সাথে আসে সব্জি। সবজির সাথে আঙুল সাইজের চিংড়ি। ছোটমাছ। আমরা খাই। বড়ো বড়ো টুকরো মাছ আসে। আমরা খাই। খেতে খেতে লোনা পানির মাছের টেস্ট শরীরের চর্বি আর মাছেদের নাম নিয়ে আলাপ করি আমরা। তারপর মদে ভাতে একাকার হয়ে ঘুম...
পরেরদিন সকালে শুরু হয় গণ-ডায়রিয়া। দুবার টয়লেট-প্যারেড করে ঘুম দিয়ে উঠে দুপুরে ভাত খেতে বসি। এখনও সেই গতকালের মাছ। এক কোষ ভাত মুখে তুলেই প্লেট রেখে দিয়ে দৌড়ে চলে যাই নৌকার কোনায়- ওয়াক...
ভেতর থেকে বের হয়ে এলো নাড়িভুঁড়ি ছেঁড়া বমি- ওয়াক...
গতকালের যা কিছু সকালেই তা অবিরল ধারায় কমোড বেয়ে সুন্দরবনের নদীতে গেছে। বাকি যে গন্ধটুকু ছিল তাও বের হয়ে এলো। কিন্তু আমি বুঝলাম না কিছুই। কুলি করে আবার এসে খেতে বসলাম। পাশের টুলে রেখে গিয়েছিলাম ভাতের প্লেট। প্লেটটা তুলতে গিয়ে দেখি প্লেটটা ওখানে নেই। পড়ে গেছে। বোকার মতো আমি জিজ্ঞেস করলাম- প্লেটটা কি আমিই ফেলেছি?
আমি ছাড়া আর ফেলবে কে। এটাই ছিল সবার চোখের উত্তর। কিন্তু আমি জানি টুলের ওপরে রাখা প্লেটটায় আমার স্পর্শও লাগেনি একবার...। প্লেটটা আমি ফেলিনি। সুন্দরবন ফেলেছে এই প্লেট। এই ডায়রিয়া- এই বমি- এই ভাতের পাত ফেলে দিয়ে সুন্দরবন আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে- মাছ নয়; মাছ নয়; মাঝিদের মাংস এইসব খাবার...
দুপুরের শেষে নৌকা এসে দাঁড়ায় ভুলে যাওয়া নামের আরেকটা ফরেস্ট ফাঁড়ির সামনে। প্রায় আট দশ ফুট বেজের উপরে ইটের বাংলো টাইপ দালান। ওখানে মোবাইলের অ্যান্টেনা আছে। ফোন করার জন্য হুড়মুড় করে নেমে গেলো সবাই। কেউ ফোন করল আর কেউ বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে গেলো যাদের ফোনের তাড়া নেই। আমিও বসলাম বারান্দায়। এবং এক দৌড়ে নেমে গেলাম নিচে। ঘাসের কাছে- ওয়াক...
দ্বিতীয়বারে খাওয়া পুরো ভাত ঢেলে দিলাম ঘাসে। তখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভাষা। প্রকৃতি তার নিজের ভাষায় আমাকে দুবার নিষেধ করলেও আমি অনুবাদ করতে পারেনি বনের শব্দমালা। আমি আবারও ভরপেট সেই মাছ খেয়ে বাংলোর ব্যালকনিতে বসে বিড়ি খাই। যতদূর চোখ যায় সামনে নিজের নিয়মে সাজানো সুন্দরবন। জোয়ারের পানি তখন সন্ধ্যার আগে পা ধুইয়ে দিচ্ছে বৃক্ষরাজির...
তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পাশে বসা কাউকে দেখতে পাই না আমি। আমার চোখ আটকে আছে নদীর অন্যপাড়ে দূরের একটা বিশাল কেওড়া গাছে। প্রথমে কেওড়া গাছটা তার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু নড়ে উঠে। তারপর এক ঝটকায় মাটি থেকে নিজের শেকড়গুলো খুলে নিয়ে নদীর উপর দিয়ে হাঁসের মতো ভাসতে ভাসতে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। একটুও নড়তে পারছি না আমি। হাতের বিড়িতেও পারছি না টান দিতে। একজন ঋষি মানুষের মতো ঝাঁকড়া কেওড়াগাছটা নদী পার হয়ে এসে বাংলোর ব্যালকনির নিচে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ায়। আমি তাকিয়ে আছি। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে গাছটা একটা দীর্ঘ ডাল বাড়িয়ে ব্যালকনিতে বসা আমাকে পেঁচিয়ে ধরে গলায়। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না তখন। গাছটা আমাকে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায় তার গোড়ায়। তারপর আমাকে ধরে রেখেই হরিণে পাতা খাওয়া কাঠির মতো আরেকটা ডাল সোজা এনে নলের মতো ঢুকিয়ে দেয় আমার মুখের ভেতর। মুখ থেকে গলা বেয়ে পাকস্থলীতে গিয়ে থামে ডালটা। তারপর পেটের ভেতরে ডালের মাথাটা বাঁকিয়ে হঠাৎ এক হ্যাঁচকা টানে প্যান্টের পকেট ঝাড়ার মতো করে আমার পুরো পাকস্থলীটাকে বের করে নিয়ে আসে মুখের বাইরে। হুড়মুড় করে গাছের গোড়ায় ছিটকে পড়ে পেটের ভেতর যা কিছু ছিল সব। ...চাবানো মাছ। পানি। গলে যাওয়া ভাত...
তারপর অনেকগুলো ছোট ছোট পাতাওয়ালা ডাল এগিয়ে এসে পুরো পাকস্থলীটা মুছে দিতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেখানে একটা টুকরো মাছের গন্ধও থাকে। তারপর আবার এক ধাক্কায় পাকস্থলীটা ভেতর ঢুকিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গাছটা নদী পার হয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে এক ঝটকায় আবার সাধারণ গাছ হয়ে যায়। আর ঘোর ভেঙে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বাংলোর সিঁড়ির নিচে বমিতে মাখামাখি। ... আর ঠিক তখনই আমি আবারও শুনতে পাই- মাছ নয়। মাছ নয়; মাঝিদের রক্তের দলা এই সব;
এই উপলব্ধি কোনোদিনও বুঝবে না সেইসব জেলেরা। শতবার বললেও সেই মাঝিদেরকে বোঝানো যাবে না যে ডাকাতরা নৌকা প্রতি পাঁচশো করে টাকা নিয়েছে তাদের থেকে আমরা সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। নৌকায় বনবিভাগের পতাকা থাকলেও ফরেস্টের কারোই শালা সমুন্দি না আমরা কেউ
এই কথাগুলো কোনোদিনও বুঝবে না সেই জেলেরা। হয়ত দেড় মাসের বনযাত্রা পুরা করার আগেই বাঘ কিংবা কুমিরের পেটে চলে যাবে কেউ। হয়ত ডাকাতের গুলিতে পড়ে থাকবে চরায়। হয়ত সত্যি সত্যি দাদনের টাকা শোধ করে গিয়ে উঠবে আইলাভাঙা গ্রামে। হয়ত অন্যদের থেকে একটু বেশি গল্প তারা নিয়ে যাবে ছেলেমেয়ের কাছে; কামানের মতো ক্যামেরা কান্ধে একদল অন্যরকম ডাকাত। এরা মাছ খায় না বেশি। ক্যামেরা তাক করে খেয়ে ফেলে মাছ ধরা সময়...
আইলাভাঙা ছাউনির সামনে সেই বিড়ালটা চোখে ভাসে আমার। একটা গৃহবাসী বিড়াল কত বছর বনে থাকলে বনবিড়াল হয়? কিংবা কত শতাব্দীর রক্তখাওয়া ইতিহাস থাকলে আমরা নিষ্পাপ মুখেই খেয়ে ফেলতে পারি মানুষের লউ?
সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর
সাকিন সুন্দরবন ৩। মরণখোর
সাকিন সুন্দরবন ৪। ভাতারখাগী