somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাকিন সুন্দরবন ৪। ভাতারখাগী

২১ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'রাত দুপুরে ঘরের চালে
প্যাঁচায় দেলে ডাক
বেনবেলা কেন মাথার পরে
কা কা করে কাক।
শোনো তুমি মা বনবিবি
বলি গো তোমারে
অভাগিনি শরণ নেলে
তোমারই চরণে॥
(ওমা) তোমারই চরণে'


এক নারীর কান্নায় খেঁকিয়ে উঠে অন্য নারী- খা-নকি মা-গি। প্যাঁচা আর কাউয়ার মুখে তুমি তোমার নিজের কম্মের কথা শোনো? নিজের কম্ম তুমি নিজে জানো না? তোমার নিজের কম্ম থেকে বনবিবি এসে বাঁচাবে তোমারে? বনবিবির আর কাজ নাই? তোমারেই বাঁচাতে ঠেকায় আছে সে? কিন্তু নিজের কর্মদোষে তোর মরদটারে যে আইজ বাঘের পেটে দিলি তার কী হবে?

কান্না থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় নারী। এখন আর বিলাপ করে কোনো লাভ নেই। বাঘে খাওয়া মরদের বৌয়েরা সকলের জন্যই অপয়া। অলুক্ষুণে কুলক্ষণে মেয়েছাওয়ালের বিলাপ যে শোনে কুলক্ষণ তারেও ধাওয়া করে সুন্দরবনে। যে নারী এই অলক্ষ্মীর মুখ দেখে ও রাক্ষুসি হয়ে গিলে খায় তার মরদের কপাল। তাই অতদিনের সংসারের চারপাশ থেকে আজ একই আওয়াজ- ভাগ হারামজাদি। নরকে গিয়ে পেরাশচিত্তি কর নিজের...

নিজের নারীর যদি কোনো কর্মদোষ না থাকে তবে কোনো মর্দাপোলাই জীবন দেয় না সুন্দরবনে। মা বনবিবি সর্বক্ষণ দেখে রাখেন তারে। বাঘের সাপের থাবা থেকে তিনি আড়াল করে রাখেন তার সকল জোয়ান ছাওয়ালকে। তিনি দেখে রাখেন বাঘ। বাঘের থাবার সামনে হাজির রাখেন হরিণ। তিনি দেখে রাখেন বনের নদী- জোয়ার ভাঁটা- জল- প্লাবন সব। তিনি আলাদা করে দেন সাপের পথ মানুষের পথ। তাই তার সকল সন্তানই তার নাম নিয়ে পা দেয় সুরক্ষিত বনে। তার নামে কৃতজ্ঞতায় বছরে শামিল হয় পূজায়। কেননা তিনি ছাড়া এই বনে সকলেই অসহায়। তাই তিনি সব সময় তাদের পাশে পাশে থাকেন। কী নৌকায়। কী ডাঙায়...

এই বনে আছেন শত পীর আউলিয়া দরবেশ। সফেদ পোশাক আর দাড়ি নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ান বন থেকে জলে। এক ফোঁটা জলও ছোঁয় না তাদের। এক কণা কাদাও লাগে না তাদের গায়ে। তারা ঘুরে ঘুরে বেড়ান আর সবাইকে মনে করিয়ে দেন বনের নিয়ম। সে নিয়ম মানে গাছ। সে নিয়ম মানে জলের কামট-কুমির। সে নিয়ম মানে ঝড়-ঝঞ্ঝা সাপ আর সুন্দরবনের বাঘ। সে নিয়মের ব্যত্যয় করে না কেউ। সে নিয়মের ব্যত্যয় করে যদি কেউ তবে অপঘাতে নির্ঘাত মৃত্যু তার। তারা ঘুরে ঘুরে বেড়ান আর সব নিয়ম ঠিক করে এসে নদীর মোহনায় জায়নামাজ পেতে শুকরানা করেন এই বন এই বাঘ আর এই মানুষের জীবনের জন্যি। তারা প্রার্থনা করেন যেন একে অন্যেরে দেখে রেখে বেঁচে থাকে সুন্দরবনের বাঘ কুমির সাপ আর মানুষ। তাই তাদেরই নির্দেশে বনসন্তানেরা বাঘের খাদ্যের জন্য বনে মানত করে মুরগি-ছাগল। তাদেরই নির্দেশে বনসন্তানেরা বনকে পবিত্র রাখে নিজেদের পেশাব পায়খানার উচ্ছিষ্ট থেকে। মানুষের পয়মাল বড়ো অপবিত্র জিনিস। তা ব্যাঘাত ঘটায় পীর দরবেশের সাধনায়। তা ব্যাঘাত ঘটায় সুন্দরবনের পবিত্রতায়। তাই সকল বনসন্তানই পয়মাল পাতায় নিয়ে ভাসিয়ে দেয় সুন্দরবনের খালে। এইসব দরবেশেরা পবিত্র জুম্মাবারে বনকে স্বাধীনতা দেন বনের নিয়মে চলতে। বাঘকে স্বাধীনতা দেন বাঘের নিয়মে চলতে। কুমিরকে ডেকে বলেন তার নিজের নিয়ম মানতে আর মানুষকে বলেন- আজ জুম্মার দিন। আজ তোরা ঘরে থাক। আজ মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা কর। আজ খুলে দিয়েছি বনের সকল বাঁধন তাই বনের দিকে ভুলেও পা দিস না জুম্মার দিনে। আজ আমরাও বসব প্রার্থনায় তাই এই বনে আজ তোদেরকে আগলে রাখার আর থাকবে না কেউ...

বনের সকল সন্তানই মানে এই শুক্রবারের রীতি সুন্দরবনে। চোর ডাকাতেরাও মানে সুন্দরবনের নিয়ম। শুক্রবারে সুন্দরবনের বাঘেরা থাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন- বেসামাল। তাই শুক্রবার দিনে বনে পা দেয় না কেউ। যারা দেয়। তারাই বেঘোরে মারা পড়ে বাঘের থাবায়। এখন পর্যন্ত যত মানুষ বাঘের পেটে গেছে; সকলেই গেছে অরক্ষিত শুক্রবারের দিনে...

কিন্তু মানুষের ছাওয়াল বাড়ে বাঘেদের থেকে দ্রুত। বাড়ে মুখ। বাড়ে খাবারের পেট। সপ্তায় একদিন বনে না ঢুকলে চুলায় উঠে না হাঁড়ি। সেই কথা বিবেচনা করে বনের পীর আউলিয়া দরবেশেরা এখন কিছুটা সদয়। এখন শুক্রবারের সারাদিন তারা ছেড়ে রাখেন না বনের শিকল। মানুষের ক্ষিদার কথা ভেবে জুম্মার পরে এসে আবার বনকে নিয়ে নেন নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে। তাই শুক্রবারের দিনে জুমার নামাজের পরে কিছু কিছু মানুষ এখন বনে ঢোকার ভরসা পায়। কিন্তু জুম্মার নামাজের আগে সুন্দরবন মানুষের জন্য নিষিদ্ধ হারাম...

কিন্তু কেউ কেউ নিজের কপাল খায় অন্যের দোষে। যে বৌ ঘরে রেখে আসে সে বৌ কী করে বাউলি না জানুক জানতে পারেন এইসব দরবেশ আর বনবিবি নিজে। তখনই তারা সাপ-কুমির-কামট আর বাঘেরে ডেকে বলেন- এ মাগির বাড় বাড়ছে খুব। যা তোরা খুলে আন ওই মরদের জান...

সেই মরদটা তখনই জান দেয় বনে। আর তার নারী টের পায় কর্মদোষের ফল। এমন অলুক্ষুণেরে গ্রামে রাখা দায়। এমন রাক্ষুসিরে ঘরে রাখা দায়। এমন রাক্ষুসিরে মেয়ে বোন ভাবা দায়। তাই সবাই খেদায় তারে। ঘর থেকে- গ্রাম থেকে- সকলের দৃষ্টির সীমানা থেকে....

ঘরে খাবার নেই; দুটো মাছ ধরে আনলে বাচ্চাটা বিকালে কিছু খেতে পায়। এই যুক্তিতে নিজের স্বামীকে সে বনে পাঠিয়েছিল দুইদিন আগে। দুইদিন আর ফিরেনি সে। ভেবেছিল পাস-পারমিট ছাড়া বনে ঢোকায় ভেবেছিল ফরেস্টের লোকজন পুলিশে দিয়েছে তারে। কিন্তু বনে পড়ে থাকা তার লুঙ্গি দেখে অন্য জেলেরা ফরেস্টের লোক নিয়ে তার লাশ ছাড়িয়ে আনে আজ...

এক শিশু হাতে ধরে আর এক শিশু পেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নারী। তার গন্তব্য সুন্দরবনের বিধবাপল্লি। সুন্দরবনের সকল বিধবারা ওখানে থাকে। সকলেই অপয়া। সকলেই রাক্ষুসি। হাতে আর পেটে দুই শিশু নিয়ে আজ ওখানেই গিয়ে দাঁড়াবে সে কারো ছাপড়ার দাওয়ায়। হয়তো পরিচিত পাওয়া যাবে কেউ। পাওয়া না গেলে অপরিচিতদের সাথে নিজের ভাগ্যের মিল দেখিয়ে অনুনয় করবে রাতের জন্য ছাউনির নিচে একটু ঠাঁই দিতে। হয়তো বা দেবে কেউ...

তারপর চেয়ে চিন্তে সরকারি জমিতে একটা ছাপড়া সে নিজেই উঠিয়ে নেবে। তারপর মাঝে মাঝে সরকারি রিলিফ- মাঝে মাঝে রাস্তার মাটিকাটা- মাঝে মাঝে নদী সাঁতরে কাঠ কুড়িয়ে আনা- মাঝে মাঝে কেওড়া কুড়িয়ে বাজারে বেচা- মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল কিংবা ছোট জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরে সে বড়ো করে তুলবে তার পেটের এবং কাঁখের ছাওয়ালগুলারে যতদিন পর্যন্ত না সেই ছাওয়ালরাও বড়ো হয়ে তারে রাক্ষুসি গালি দিয়ে বিধবাপল্লি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে জঙ্গলে না হয় ডাকাতের দলে না হয় দুবলার চরে কয়েদখানায়...

- মা তুমি রাক্ষুসি?
হাতে ধরা ছেলের প্রশ্নে শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে গ্রামের বাইরে পা বাড়ায় নারী- না রে বাপ। তোর বাপ নাই; তোরে-আমারে এখন আর কেউ খাওয়াবে না তাই রাক্ষুসি নাম দিয়ে তারা বের করে দিলো...


সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর

সাকিন সুন্দরবন ২। বনপর্যটক

সাকিন সুন্দরবন ৩। মরণখোর
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×