প্রথমেই নিজের বৃত্তান্ত দিচ্ছি... অনেকেই না-বুঝে বা না-পড়েই মন্তব্য করে ফেলেন... তাদের জন্য এবং সবার জন্য-ই ~~~
আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা (উনি বলতেনঃ সরকারে কামলা আর জনগনের চাকর... বিসিএস নয়- ইপিসিএস-এর লাস্ট ব্যাচ) আর মা বাংলার ঐতিহ্যগত গৃহবধূ। বাবার কাছ থেকে শেখা সততা আর নৈতিকতা-ই আমার একমাত্র সম্বল। অতি অল্প বয়সেই শিক্ষকতাকেই ১ম পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়ে বিসিএস-এর মাধ্যমে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছি (৩২ বছর চাকুরী করবো!!!) শুধুমাত্র মানুষকে সততা আর নৈতিকতা শেখানোর জন্য-ই। ক্লাসে রচনা লিখতাম আর স্বপ্ন দেখতাম "শিক্ষক হবো"... হয়েছি-ও। বাবার বদলীর চাকুরীর বদৌলতে ১৯ টি জেলার মানুষের সাথে পরিচয়, সাথে দেশের সেরা সেরা সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ... আমার মন মানসিকতা গঠনে এবং চিন্তাচেতনা বিকাশে সহায়ক হয়েছে। অনেক কাট-খড় পুড়িয়ে বিয়ে করেছি ভালোবাসার মানুষটিকে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে... পৃথিবী সেরা নারীটিকে পাবার জন্য অবশ্য এতটুকু করা-ই যায়! কন্যা সন্তানের পিতা বলে কোন হীনমণ্যতা নেই।... সব মিলিয়ে সুখী আর পরিপূর্ণ একজন মানুষ বলে ভাবি নিজেকে।...
............................................................................
একজন শিক্ষকের কথকতা~~~
সামগ্রিকভাবে মানুষের দুটি দিক আছেঃ জৈবিক (biological) আর সমাজগত (sociological)। জৈবিক চাহিদা পূরণের হাতিয়ারগুলোর মধ্যে আছে- খাদ্য, প্রজনন, অনুভূতির প্রকাশ ইত্যাদি; যা কেবল মানুষই নয় সমস্ত প্রাণীকূলেরই আয়ত্তাধীন। কিন্তু সমাজগত চাহিদার হাতিয়ার "শিক্ষা" কেবল মানুষই ব্যবহার করে; যার দ্বারা সে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাহিদা পূর্ণ করে।
১. শিক্ষা শব্দের মূল ও তার অর্থঃ
বাংলা ''শিক্ষা'' শব্দটির সাংস্কৃতিক মূল ''শাস'', যার অর্থ শাসন / নির্দেশ / আজ্ঞা / নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। কিন্তু ব্যবহারগত দিক থেকে এর যথার্থ প্রতিশব্দ "বিদ্যা", যা ''বিদ্'' ধাতু হতে এসেছে; অর্থ হলোঃ জানা, যা দ্বারা জ্ঞান আহরণকে বোঝায়।
ইংরেজী ''education'' শব্দটির ল্যাটিন মূল ৩ টি পাওয়া যায়ঃ ''educare'', ''educere'' এবং ''educatum''। "educare'' শব্দের অর্থঃ লালন পালন করা (to bring up) / পরিচর্যা করা (to nourish) / প্রতিপালন করা (to rear up)। অর্থাৎ, শিশুকে আদর-যত্নের মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। আবার, ''educere'' শব্দটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত; প্রথম অংশ ''edu'' শব্দের অর্থঃ মধ্য হতে (out of বা from) এবং দ্বিতীয় অংশ ''cere'' শব্দের অর্থঃ বাইরে আনা (to lead out) / বাইরের দিকে পরিচালিত করা (to draw out)। অর্থাৎ, মানুষকে তার বিকাশে সহায়তা করা; তথা তাঁর অন্তর্নিহিত শক্তি বা গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে স্বকীয়তার উম্মেষ ঘটানো। আর, ''educatum'' শব্দটির অর্থঃ শিক্ষক (teacher) / শিক্ষা সংক্রান্ত (teaching); যার অর্থ দাঁড়ায়ঃ শিক্ষকের সহায়তায় কিছু বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের সার্বিক বিকাশ ঘটানো।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, "শিক্ষা"-র দুটি রূপ / মূলঃ সংকীর্ণ আর ব্যাপক।
সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা হচ্ছেঃ
বিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে রেখে এক বা একাধিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে শিশুকে শাসন আর নিয়ন্ত্রণের দ্বরা আচার-আচরণ ও অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে বিদ্যা দান করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে দাতা আর গ্রহীতার, যেখানে শিক্ষার্থীর নিজস্বতা কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই এবং সে শিক্ষকের আয়ত্ত্বের মধ্যে থাকবে। এক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিত্ব্যের পূর্ণ-বিকাশের প্রতি কোন লক্ষ রাখা হয়না। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে শিক্ষার এই অর্থটি সাধারণ মানুষের শিক্ষা বিষয়ক ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও এতে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি বা গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে স্বকীয়তার উম্মেষ ঘটানো সম্ভব হয়না বলে আধুনিক শিক্ষাবিদদের নিকট সংকীর্ণ অর্থ নির্দেশক।
অপর দিকে, ব্যাপক অর্থে শিক্ষাঃ
মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পলমান জীবনের পথে তার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে / প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে / ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় / আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের অবিরাম প্রক্রিয়া-ই শিক্ষা। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে সহায়তাকারী / পথ প্রদর্শনকারী আর পথিক / অভিজ্ঞতা অর্জনে সচেষ্ট ব্যক্তি; যেখানে শিক্ষার্থীর নিজস্বতা এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার মাধ্যমে শিক্ষকের সহায়তায় তার ব্যক্তিত্ব্যের পূর্ণ-বিকাশ ঘটাবে। শিক্ষার এই অর্থটি আমাদের শিক্ষা বিষয়ক ধারণার সাথে ঠিক ততটা সামঞ্জস্যপূর্ণ না-হলেও এতে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি বা গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে স্বকীয়তার উম্মেষ ঘটানোর প্রচেষ্টা করা হয় বলে এটিই আধুনিক শিক্ষাবিদদের নিকট শিক্ষার সঠিক অর্থ নির্দেশক।
......................................
ধন্যবাদ (চলমান)~~~