চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে আসলে আমার নতুন করে বলার কিছুই নেই। একটা সাধারণ ছাত্র আন্দোলন কি করে এই কিছুদিনের মধ্যে গোটা একটা দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলল সেটা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। একই সাথে টলে উঠেছে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার গদি।
কথা হচ্ছে দেশের পরিস্থিতিটা আজ এমনই যে শুধুমাত্র সরকারের কিছু অন্ধ-দলকানা দাসানুদাস ছাড়া কেউই আজ এই শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে নেই। বছরের পর বছর ধরে চলা অন্যায়-অনাচার আর অন্যায্য ব্যবস্থা দেশের ছাত্র-জনতাকে আজ পথে নেমে দাবি আদায় করতে বাধ্য করেছে। স্বৈরাচার তো কম দেখেনি এদেশ। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার আগ থেকে বরাবরই লড়ে এসেছে এদেশের মানুষ। সেই ধারায় এবারের ছাত্র আন্দোলন নতুন আরেক অধ্যায় যোগ করলো। সেটা করার সুযোগ করে দিল এই ছাত্রদের প্রতি দেশের সরকার প্রধানের অতি উন্নাসিকতা, দম্ভ আর অহঙ্কার। ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত সবাইকে ঢালাওভাবে “রাজাকার” উপাধি যখন দিয়েই ফেললেন তখনও তিনি হয়তো বুঝতেই পারেন নি যে আগুনে কিভাবে ঘি ঢেলে দিলেন!! ফরাসি বিপ্লবের সময় সেদেশের রানী মেরী আঁতোয়ানেত যখন তাদের শাসনে শোষণে অতিষ্ঠ খিদের জ্বালায় পুড়ে মরা বিক্ষুব্ধ সাধারণ ফরাসীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন “রুটি খেতে পারেনা তো ওরা কেক খায়না কেন”, তখনও রানী বুঝেন নি যে এটা বলে তিনি আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন!! যদিও এটা কখনোই বলবো না যে এখন এদেশে ঐ ফরাসী বিপ্লবের মতোই আরেক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তবে আজ এটা অবশ্যই বলা যাবে সরকারের গদি কিন্তু টলে উঠেছে ভালোমতোই। হতবিক্ষুব্ধ, দীর্ঘ পনেরো বছরের ওপরে বয়ে চলা এক স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ আর নানামুখী অন্যায় অত্যাচারে নিষ্পেষিত মানুষ আজ পরিবর্তন চায়। বছরের পর বছর ক্ষমতাসীনদের শোষণে শোষণে নিষ্পেষিত হতে হতে যে আগুন এতকাল ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল সাধারণ মানুষের ভেতর, এই ছাত্র আন্দোলন সেই আগুনকে ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশজুড়ে। সরকারের একটি দম্ভোক্তি (আন্দোলনরত সবাইকে ঢালাওভাবে রাজাকার বানিয়ে দেয়া) সেই আগুনকে ভালোমতোই উস্কে দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ভাবতেও পারেনি এই আগুন কিভাবে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা দেশজুড়ে।
ক্ষমতায় আরোহণের পর দেশে ফ্যাসিবাদী একটি শাসনব্যবস্থা কার্যকর করে সেসময়ের প্রধান বিরোধী দলসহ বিরোধী সমস্ত শক্তিকে কোণঠাসা করে, প্রশাসনের সমস্ত জায়গায় নিজেদের দলীয় লোকজন ক্ষমতায় বসিয়ে, বারেবারে ইলেকশন রিগিং করে আর বড় বড় শক্তিধর দেশগুলোকে তুষ্ট করে তাদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীনরা হয়তো ভেবেছিলো দিন তাদের কখনো ফুরোবে না। অকথ্য দুর্নীতি, নিদারুণ স্বেচ্ছাচারীতা, অগণিত গুম-খুন, ভয়াবহ রকমের লুটপাট, সীমাহীন চুরিচামারি আর সর্বত্র সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থের নোংরা রাজনীতির উপদ্রব দেখতে দেখতে মানুষ আজ ক্লান্ত।
যদিও একথা অস্বীকার করা যাবেনা যে আওয়ামী লীগের এই আমলে দেশের অগ্রগতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে বেশ। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীনরা জগদ্দল পাথরের মতো যে জুলুমের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে দেশের ওপরে বছরের পর বছর তাতে করে দেশের উন্নতি করা স্বত্বেও এ উন্নতি কোনোভাবেই মানুষের মন যোগাতে পারবেনা এবং পারেও নি। যতো উন্নতিই হোক না কেন মানুষ শেষ বিচারে জুলুম সহ্য করতে পারে না কোনওভাবেই। উন্নতি তো পাকিস্তান আমলেও হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানীদের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে এদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো। আজ প্রায় সেই একই ইতিহাস নতুন করে রচিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ আজ ফুঁসে উঠেছে, বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় দমন-পীড়ন, ভাঁওতাবাজি আর পুলিশ দিয়ে অত্যাচারের ষ্টীমরোলার চালিয়ে এই ফুঁসে ওঠা রোধ করা যাবেনা কিছুতেই। ক্ষমতাশালী আওয়ামী লীগ ঠিক সেই কাজটাই আজ করছে যা যুগে যুগে বিশ্বের সব স্বৈরাচারই করে এসেছে। দমন পীড়ন দিয়ে জন-বিক্ষোভ কখনো রোধ করা যায়না।
এ আগুন সহজে নিভবে না।
কারণ, মানুষ আজ মুক্তি চায়- নিষ্কৃতি চায়, এইটাই চূড়ান্ত কথা।
কিন্তু, এখন কথা হচ্ছে, চলমান এই আন্দোলন কি আরব বসন্তের মতো রূপ নেবে?
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি আরব বসন্তের সময় অনেকগুলো আরব দেশের স্বৈরাচারের গদি উল্টেপাল্টে গেছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু দেশে এখনো গৃহযুদ্ধ চলমান।
এইবারে মিলিয়ন ডলার এর কোয়েশচেন, বাংলাদেশ কি তবে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?
এই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থে এর সদুত্তর দেয়া কঠিন।
তবে পরিস্থিতি যেরকম দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে এটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
ভেবে দেখুন, দেশের সরকার এমনভাবে চলেছে যে এই মুহূর্তে তারা জনপ্রিয়তার তলানিতে অবস্থান করছে। মনে হচ্ছে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে আওয়ামী লীগ এর সরকার। এখন, এই অবস্থায় যদি তারা ক্ষমতায় টীকে থাকতেই চায় তবে তাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় টীকে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে সেটা করতে গেলে আগুনে আরও ঘি ঢালার মতোই ব্যাপার হবে সেটি। পরিস্থিতি এতোটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে সেটা এখন ওরকম কিছু করতে গেলেই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আওয়ামী সরকারের সমালোচনা শুরু হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন, আওয়ামী সরকারের শক্তির উৎস ভারতেও কিন্তু নানামুখী সমালোচনা শুরু হয়েছে। ভারতের মিডিয়া আওয়ামী সরকারকে খুব একটা সমর্থন কিন্তু দিচ্ছে না, বরং সমালোচনাই করছে বেশী। বলা বাহুল্য, এই মিডিয়াগুলোর বড় একটা অংশই কিন্তু তাদের ক্ষমতাসীন বিজেপি নিয়ন্ত্রিত। একইসাথে, ভারতের বেশীরভাগ জনসাধারণ কিন্তু ছাত্রদের এই আন্দোলন সমর্থন করছে তো বটেই, এই আন্দোলন তাদের দেশেও তাদের কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। চীন বলছে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এর বেশী কোনও বক্তব্য তারা দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রও আওয়ামী সরকারকে বলার মতো কোনও সমর্থন দিচ্ছে না। খবরে দেখা গেছে মার্কিন সিনেটররা বরং ছাত্রদের পাশেই আছে। আর এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন খুব সম্ভব কঠোর কোনও পদক্ষেপ নিতে চলেছে। ইতিমধ্যেই সরকারের সাথে একটি বোঝাপড়া তারা স্থগিত করেছে। এখন সরকার যদি এজ ইউজুয়াল বলপ্রয়োগ করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেয়, সেক্ষেত্রে একাট্টা হয়ে ই . ইউ যদি একটা স্যাংশন দিয়ে বসে তাহলে দেশের অর্থনীতি কই যাবে ভেবে দেখেছেন?
এখন অনেকেই হয়তো বলে বসতে পারেন সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার কথা।
দেখুন সেটা হতে গেলে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্মরত আছে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে জাতিসংঘের সাথে হওয়া বোঝাপড়া অনুযায়ী। ঐসব মিশনে গিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভালো মাইনে উপহার পাচ্ছে। ক্ষমতা হাতে তুলে নিয়ে সেসব পথ বন্ধ করে তারা দেশে ফিরে আসবে এমনটা হওয়া খুবই অসম্ভব ব্যাপার। দৈবাৎ কোনোভাবে যদি সেই অসম্ভব ব্যাপার ঘটেও থাকে তাহলে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী হয়তো আর কখনোই কোনও দেশে কোনও মিশনে যেতে পারবে না। এমন পরিস্থিতি সেনাবাহিনী কখনোই চাইবে না। যেকারনে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
এখন কথা হচ্ছে, বিকল্প কে ক্ষমতায় আসতে পারে?
আওয়ামী সরকার দীর্ঘ এক যুগের ওপরে ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দলকে (বি এন পি – জামাত জোট) যেভাবে দমন পীড়ন করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তাতে করে সত্যিকার অর্থে এই বিরোধী দল এখন আর সেরকম অবস্থায় নেই যে (যদি কোনোভাবে নির্বাচন ম্যানেজ করে জিতে আসতে পারে) ঠিকমতো দেশ চালাতে পারবে। ইন ফ্যাক্ট, যদি এরপর (অনেক ঝড় ঝঞ্ঝার পর) কোনোভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে এরা সব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো লোক পাবে কিনা সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিরোধী দল দমন পীড়ন করতে করতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের রাজনীতির এমন হাল করেছে যে তাদের বিরোধী কোনও শক্তি দাঁড়াবার মতো কোনও অবস্থায় নেই।
গায়ের জোরে করে ফাঁকা ময়দান তৈরি করে ইচ্ছেমত গোল দিয়ে গেছে তারা দীর্ঘসময়।
কিন্তু দেশের মানুষ তাদের আর কোনোভাবেই ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
শুধুমাত্র কিছু অন্ধ দলকানা সমর্থক ছাড়া কেউই তাদের চায় না।
দেশ এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।
এইরকম অবস্থায় বিকল্প নেতৃত্ব উঠে আসা যে ভীষণ রকম জরুরী সেটা বলাই বাহুল্য । এখন দেখা যাক, বিকল্প নেতৃত্ব সত্যিই গড়ে ওঠে কি না!!
সেটা যদি না হয় তাহলে ব্যাপক নৈরাজ্য আর গৃহযুদ্ধের দিকে পরিস্থিতি গোড়ানোর সম্ভাবনাই বেশী।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৪ রাত ৮:০৪