ডক্টর সরিতা তিশনিওয়াল
গল্প ১:
টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে অন্যমনষ্কভাবে সারিতা দুই হাত মেলে ওর আঙ্গুলগুলো দেখতে লাগলো। ওর আঙ্গুল সরু আর লম্বা, আঙ্গুলের মাথায় নখগুলোও সরু আর লম্বা। কোথায় যেন পড়েছিল আঙ্গুলের আকার অনুযায়ী নাম দেয়া যায়, যেমন ওর মতো লম্বা আঙ্গুলের নাম আর্টিস্টিক ফিঙ্গার- শৈল্পিক আঙ্গুল, সাধারণত চিত্র শিল্পীদের এমন আঙ্গুল দেখা যায়। সারিতা অবশ্য চিত্র শিল্পী হয়নি, ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু বারো বছর বয়স থেকেই মা হাতের আঙ্গুলের নখের বিশেষ যত্ন নেয়া শিখিয়েছেন, সূচালো আগার নখগুলো সবসময় ঝকমক করে, একেবারেই শৈল্পিক আঙ্গুল! ভাগ্যিস মা শিখিয়েছিলেন...
অন্যমনষ্কতা কেটে গেল আইসিইউর মেঝেতে পড়ে থাকা ওয়ার্ড বয় বাবুলের কান্না মাখা চিৎকারে, "ম্যাডাম মাফ করে দেন, আমাকে বাঁচান"! একবার বাবুলকে দেখে নিয়ে সারিতা দরজা দেখল, ঠিকমতো লক করা আছে কিনা; তখনই মনে পড়ে গেল আইসিইউতে ঢুকেই বাবুল দরজা লক করে দিয়েছিল, আপাতত এ ঘর থেকে বাবুলের আর্তনাদের শব্দ বাইরে যাবেনা। নিশ্চিন্ত হয়ে ভেজা টিস্যু দিয়ে ঘষে ঘষে নখ থেকে রক্তের দাগ মুছতে লাগলো।
অনেক দিন পর মনে পড়ল জাফর মামার কথা। মায়ের খালাতো ভাই, কী একটা কাজে ঢাকায় এসে ওদের বাসায় উঠেছিলেন। খুবই মজার মানুষ, অনেক রকম গল্প করে মাতিয়ে রাখতেন। সারিতা সারাদিন বই পড়ত দেখে বলতেন, "এত পড়িস না, বেশি পড়লে বদরুদ্দোজা হয়ে যাবি।" বদরুদ্দোজার গল্পটাও বলেছিলেন; বদরুদ্দোজা ছিল উনার ক্লাসের ফার্স্ট বয়, মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার এত পড়তে লাগলো যে পড়তে পড়তে পাগল হয়ে গেল। তখন সারিতা পড়ে মোটে ক্লাস সেভেনে, পড়ার বই যত পড়ে তার পাঁচ গুণ পড়ে গল্পের বই। বদরুদ্দোজার গল্প শুনে মোটেও ভয় পেল না, আগের মতই গোগ্রাসে গল্পের বই পড়তে লাগলো। সেদিন দুপুরেও সারিতা তন্ময় হয়ে একটা বই পড়ছিল বিছানায় শুয়ে, কোন কারণে স্কুল বন্ধ কিন্তু মা-বাবার অফিস খোলা, তারা দু'জনেই অফিসে, সব কাজ শেষ করে এই সময়টায় বুয়াও তার ঘরে ঘুম দেয়। হঠাৎ তন্ময়তায় ছেদ পড়ল, দেখল জাফর মামার তার ঘরে ঢুকেছেন। "কী মামা, কিছু লাগবে?" সারিতার প্রশ্নের উত্তরে মামা বললেন, "হ্যা, লাগবে তো...", বলতে বলতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সারিতার বিছানায় উঠে এলেন। "মামা মামা, কী করছ তুমি, সরে যাও, নাহলে মাকে বলে দেব..." জাফর মামা মনে হয় কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না, তার মুখটা একটা হিংস্র পশুর মতো দেখাচ্ছিল। সারিতা কিছু না ভেবেই সেই পশুর মুখে আক্রমণ করেছিল, একহাতে মাথার চুল ধরে আরেক হাতের লম্বা নখ সোজা চোখে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। একটা আর্তচিৎকার, জাফর মামা ওকে ছেড়ে হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরলেন, সারিতা দেখল জাফর মামার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নামছে। প্রচন্ড ভয়ে ও বুঝতে পারছিল না কী করা উচিত। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে চিৎকার করে বুয়াকে ডাকতে লাগলো...
সারিতার মা-বাবা যখন বাসায় পৌঁছালেন ততক্ষণে বুয়া মামাকে নিজের ঘরে পৌঁছে দিয়ে একটা বরফের পোঁটলা করে দিয়েছে চোখে চাপা দেবার জন্য। সেটা চোখে চেপে ধরে মামা মাঝে মাঝে আর্তনাদ করছিলেন। এই অবস্থায় সারিতার বাবা মামাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন, আর মা গম্ভীর মুখ করে দীর্ঘ সময় সারিতাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। বুয়া একবার পানি দিতে এসে বলল, "নউখ যে এমুন কাজে লাগে..."
ডাক্তারি পড়ার সময় হোস্টেলে বন্ধুরা হাসাহাসি করত নখ নিয়ে সারিতার বাড়াবাড়ি দেখে। পড়াশোনার চাপে যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, এরমধ্যেও দেখা যায় সারিতা সময় নিয়ে নখের পরিচর্যা করছে; নখ মজবুত রাখতে নাকি ওর মা আমেরিকা থেকে বায়োটিন নামের একটা ওষুধ আনিয়ে দেন! আসলে এভাবে নখের যত্ন করা সারিতার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, কেন এটা শুরু করেছিল সেকথা হয়তো আর মনেই পড়তো না যদি না আজকে রোগী দেখতে আইসিইউতে আসত...
সারিতার নাইট ডিউটি পড়েছিল আইসিইউতে, কিন্তু আইসিইউতে কোনো রোগী না থাকায় সারিতা আইসিইউর পাশে ডাক্তারদের রুমে টেবিলে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুম ভাঙল ওয়ার্ড বয় বাবুলের ডাকে, আইসিইউতে একজন রোগী এসেছে। আইসিইউতে ঢুকে দেখে সব বেড খালি, বাবুলকে জিজ্ঞেস করার জন্য পিছন ফিরতেই দেখে বাবুল দরজা বন্ধ করছে। প্রায় ভুলে যাওয়া জাফর মামার কথা অনেক দিন পর মনে পড়ল সারিতার; চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো... ডাক্তারি পড়ার সুবাদে ও এখন জানে চোখের কোন জায়গাতে এক খোঁচা দিলেই চোখ গলে যাবে। হাসিমুখে বাবুল যখন এগিয়ে এলো ওর দিকে, ও হাত বাড়াবার আগেই সারিতা তার দুহাত বাড়িয়ে দিল বাবুলের চোখ বরাবর...
নখ পরিষ্কার করা শেষ। আড়মোড়া ভেঙ্গে সারিতা উঠল, এক কাপ চা খাওয়া দরকার।
=================================
সারিতা কাল্পনিক চরিত্র। বাস্তবে ঢাকার এক হাসপাতালের এক ওয়ার্ড বয় ডিউটিরত ডাক্তারকে ধর্ষণের পর খুন করে। আমি সেই খবরটার জন্য সার্চ দিয়ে পাইনি, বদলে পেলাম ধর্ষণ করতে গিয়ে ডাক্তারের নখের আঁচড়ে আহত হয়ে ভারতের হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় ডাক্তারকে খুন করেছিল, সেই কাহিনী। এই যে সেই কাহিনীর লিঙ্ক view this link আর ডাক্তার সরিতার ছবি উপরে দেয়া আছে। সরিতা ধর্ষণ ঠেকাতে গিয়ে ওয়ার্ড বয়ের হাতে খুন হয়েছিল, আমার গল্পের সারিতা ধর্ষণ ঠেকিয়ে ধর্ষককে ভালো মতন শাস্তি দিয়েছে... অবশ্য এটা কাল্পনিক...
গল্প ২:
এই ধর্ষনের ঘটনার কাল প্রায় ত্রিশ বছর আগের, ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৯২, স্থান দুবাই। ভারতীয় ব্যাংক অফিসার রাজেশ সাগর সপরিবারে দুবাইতে থাকতেন। পরিবারে ছিল চাকুরিজীবী স্ত্রী রাজৌরী, তের বছরের মেয়ে জ্যোতি, এগারো বছরের ছেলে জয়েশ, রাজেশের মা মালিবাই আর বারো বছর যাবত কাজ করা বিশ্বস্ত কাজের লোক মনু পভর। একদিন জ্যোতি তখন স্কুল থেকে ফিরে এসেছে, মালিবাই তার ঘরে রামায়ণ পড়ছেন, সেসময় পভর জ্যোতিকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। জ্যোতি যখন বলে যে সে সবাইকে এটা বলে দেবে, তখন পভর জ্যোতিকে হত্যা করে। এরপর সে একটা ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মাথার পিছনে বাড়ি মেরে মালিবাইকে হত্যা করে। জয়েশ স্কুল থেকে ফিরলে দরজা খুলে দিয়ে তাকেও মাথায় ব্যাট দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে। এরপর একইভাবে প্রথমে রাজৌরী আর তারপর রাজেশকে দরজা খুলেই মাথায় ব্যাটের বাড়ি মেরে হত্যা করে। পাঁচ জনকে খুন করে পভর বাসা থেকে চলে যায়... দুবাই পুলিশ যখন রাজেশের পরিবারের এই পরিনতি জানতে পারে ততক্ষণে পভর ভারতে চলে গেছে। দুবাই পুলিশের অনুরোধে ভারতীয় পুলিশ পভরকে গ্রেফতার করে, তারপর দীর্ঘ বিচার কাজ শেষে এলাহাবাদ হাইকোর্ট পভরের মৃত্যু দন্ড দেন। সেটা কার্যকর হয়েছে সেই খবর পাইনি!! খবরের লিঙ্ক: view this link
গল্প ৩:
খেলার মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কয়েকটা সিড়ি দিয়ে একটা গ্যালারির মত বানানো আছে, ক্লাস না থাকলে দিবা তার ক্লাসের বাকি ছয়জন মেয়ের সাথে এখানে বসে আড্ডা দেয়। সেদিনও সাত বান্ধবী বসে আছে, দেখে মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হনহনিয়ে একজন হেঁটে আসছে, হাঁটার ভঙ্গি দেখে বুঝল এটা হেলাল।
- ও আবার এদিকে আসছে কেন?
- নিশ্চয়ই মাথায় নতুন কোন আইডিয়া এসেছে, আমাদের শেখাতে আসছে।
ততক্ষণে হেলাল ওদের কাছে পৌঁছে গেছে। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, কিছু একটা শেখানোর জন্য ওদের খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছেছে।
- এই যে মেয়েরা, এভাবে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে ক্যারাটে শিখলে তো পারো। চলো, তোমাদের ক্যারাটে শেখাবো।
- ক্যারাটে!! ওটা শিখে কী হবে? তোমার মাথায় এত অদ্ভুত আইডিয়া আসে কেন হেলাল? খুব বিরক্ত হয়ে তাসনিম বলল। একটুও না দমে হাসিমুখে হেলাল বলল,
- আরে ক্যারাটে শেখা খুব সহজ। চলো এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি কত সহজ! শেখা থাকলে দেশ বিদেশে কত কাজে লাগবে...
- দ্যাখো হেলাল, এমনিতেই সেসনালে হাবিজাবি অদরকারি জিনিস শিখতে শিখতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এইপর আবার ক্যারাটে ম্যারাটের মত অদরকারি জিনিস শিখতে হবে? কেন বলতো??"
- কি যে বলো! অদরকারি জিনিস কেন হবে। আমার বড় আপা ডাক্তার আর ছোট আপা মেজিস্ট্রেট। ওদেরকেও তো ক্যারাটে শেখালাম, কখন কী কাজে লাগে ঠিক আছে নাকি!!
- এ্যাই!! আমরা কি তোমার বড় আপা না ছোট আপা? আমরা তোমার ক্যারাটে শিখবো না... কিছুতেই শিখবো না। এখন ইচ্ছা হলে আমাদের সাথে বসে গল্প করতে পারো, না হলে ভাগো... নো ক্যারাটে ম্যারাটে।
হেলালের অবশ্য গল্প করার কোন ইচ্ছা দেখা গেল না। হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ফিরে গেল। মেয়েদের গল্প ঘুরে গেল হেলালকে নিয়ে।
- কয়দিন আগে সবাইকে কম্পিউটার শেখানোর বাতিক উঠেছিল। এখন উঠেছে ক্যারাটে শেখানোর বাতিক, পাগলা দাশু...
ক'দিন পর আবার হাসিমুখে হেলাল হাজির, এবার ক্লাসের সামনের বারান্দায়।
- এই শোনো, তোমাদের একটা দরকারি জিনিস শেখাবো, এক মিনিট লাগবে...
- এক মিনিট! আচ্ছা শেখাও দেখি।
- ধরো কেউ তোমাকে আক্রমণ করল, তুমি করবে কি, তার চোখের এই কোনায় এইভাবে বুড়ো আংগুল দিয়ে জোরে চাপ দেবে, চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসবে...
- আরে থামো থামো, কী বলছ এসব! মানুষের চোখ ওপড়াবো!! কেন? কে আবার আক্রমণ করতে যাবে? যত ফালতু ভাবনা তোমার মাথায় গিজগিজ করে... হিজিবিজবিজ...
- আহা, ফালতু ভাবনা কেন হবে! কেউ যদি আক্রমন করে তাহলে সোজা তার চোখে এইভাবে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিও!! আরেকবার হেলাল দেখিয়ে দিল।
- ভাগো তো হেলাল! অদ্ভুত কথা বলে মেজাজ টাই খারাপ করে দিলে...
হেলালের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, আজ পত্রিকায় চার রকমের ধর্ষণের ঘটনা পড়ে ত্রিশ বছর পরে তাসনিম সুলতানার মনে পড়লো হেলালের কথা। হেলাল এখন অটোয়ায় থাকে। নিউরণের কোন্ কোণে স্মৃতি অনেক দিন লুকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ কোনদিন জেগে ওঠে... চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে তাসনিম সুলতানা ভাবলেন, হেলালের মতো ছেলেরা সবাই কি দেশ ছেড়ে চলে গেছে!!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:০৬