আমাদের ক্লাশে একটি নূতন ছাত্র আসিয়াছে। সে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, "আমি পোইট্রি লিখতে পারি !" একথা শুনিয়া ক্লশের অনেকেই অবাক হইয়া গেল; কেবল দুই-একজন হিংসা করিয়া বলিল, "আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।" নতুন ছাত্রটি বোধহয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থুল পড়িয়া যাইবে এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হা হা করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মতো সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল—
ওহে বিহঙ্গম তুমি কিসের আশায়
বসিয়াছ উচ্চ ডালে সুন্দর বাসায়?
নীল নভোমণ্ডলেতে উড়িয়া উড়িয়া
কত সুখ পাও, আহা ঘুরিয়া ঘুরিয়া।
যদ্যপি থাকিত মম পুচ্ছ এবং ডানা
উড়ে যেতাম তব সনে নাহি শুনে মানা-
কবিতা শেষ হইতে না হইতে, ভবেশ তাহার মতো সুর করিয়া মুখভঙ্গী করিয়া বলিল-
আহা যদি থাকত তোমার
ল্যাজের উপর ডানা
উড়ে গেলেই আপদ যেত-
করত না কেউ মানা!
নূতন ছাত্র তাহাতে রাগিয়া বলিল, "দেখ বাপু, নিজেরা যা পার না, তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া ভারি সহজ। শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের গল্প শোনোনি বুঝি?" একজন ছেলে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, "শৃগাল এবং দ্রাক্ষাফল! সে আবার কি গল্প?" অমনি নূতন ছাত্রটি আবার সুর ধরিল-
বৃক্ষ হতে দ্রাক্ষাফল ভক্ষণ করিতে
লোভী শৃগাল প্রবেশিল এক দ্রাক্ষা ক্ষেতে
কিন্তু হায় দ্রাক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চে থাকে
শৃগাল নাগাল পাবে কিরূপে তাহাকে,
বারম্বার চেষ্টায় হয়ে অকৃতকার্য
'দ্রাক্ষা টক' বলিয়া পালাল ছেড়ে রাজ্য।
সেই হইতে আমাদের হরেরাম একেবারে তাহার চেলা হইয়া গেল। হরেরামের কাছে আমরা শুনিলাম যে ছোকরার নাম শ্যামলাল। সে নাকি এত কবিতা লিখিয়াছে যে, একখানা আস্ত খাতা প্রায় ভরতি হইয়াছে আর আট-দশটি কবিতা হইলেই তাহার একশোটা পুরো হয়; তখন সে নাকি বই ছাপাইবে।
ইহার মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হইল। গোপাল বলিয়া একটি ছেলে স্কুল ছড়িয়া যাইবে এই উপলক্ষে শ্যামলাল এক প্রকাণ্ড কবিতা লিখিয়া ফেলিল। তাহার মধ্যে 'বিদায় বিদায়' বলিয়া অনেক 'অশ্রুজল' 'দুঃখশোক' ইত্যাদি কথা ছিল। গোপাল কবিতার আধখানা শুনিয়াই একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, "ফের যদি আমার নামে পোইট্রি লিখবি তো মারব এক থাপ্পড়।" হরেরাম বলিল, "আহা বুঝলে না? তুমি স্কুল ছেড়ে যাচ্ছ কিনা, তাই ও লিখেছে।" গোপাল বলিল, "ছেড়ে যাচ্ছি তা যাচ্ছি, তোর তাতে কি রে? ফের জ্যাঠামি করবি তো তোর কবিতার খাতা ছিঁড়ে দেব।"
দেখিতে দেখিতে শ্যামলালের কথা ইস্কুলময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। তাহার দেখাদেখি আরও অনেকেই কবিতা লিখিতে শুরু করিল। ক্রমে কবিতা লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকম ছোঁয়াচে হইয়া নিচের ক্লাশের প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোট ছোট ছেলেদের পকেটে ছোট ছোট কবিতার খাতা দেখা দিল। বড়দের মধ্যে কেহ শ্যামলালের চেয়েও ভালো কবিতা লিখিতে পারে বলিয়া শোনা যাইতে লগিল। ইস্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চরিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল।
পাঁড়েজির বৃদ্ধ ছাগল যেদিন শিং নাড়িয়া দড়ি ছিঁড়িয়া ইস্কুলের উঠানে দাপাদাপি করিয়াছিল, আর শ্যামলালকে তাড়া করিয়া খানায় ফেলিয়াছিল, তাহার পরদিন ভারতবর্ষের বড় ম্যাপের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা বাহির হইল—
পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি,
অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি !
উঠানে দাপটি করি নেচেছিল কাল
তারপর কি হইল জানে শ্যামলাল।
শ্যামলালের রঙটি কালো কিন্তু কবিতা পড়িয়া সে যথার্থই চটিয়া লাল হইল, এবং তখনি তাহার নিচে একটা কড়া জবাব লিখিতে লাগিল। সে সবেমাত্র লিখিয়াছে— 'রে অধম কাপুরুষ পাষণ্ড বর্বর-' এমন সময় গুরু গম্ভীর গলা শোনা গেল— "ম্যাপের উপর কি লেখা হচ্ছে?" ফিরিয়া দেখে হেড মাস্টার মহাশয় ! শ্যামলাল একেবারে থতমত খাইয়া বলিল, "আজ্ঞে স্যার, ওরা আগে লিখেছিল।" "ওরা কারা?" শ্যামলাল বোকার মত একবার আমাদের দিকে, একবার কড়িকাঠের দিকে তাকাইতে লাগিল, কাহার নাম করিবে বুঝিতে পারিল না। মাস্টার মহাশয় আবার বলিলেন, "ওরা যদি পরের বাড়িতে সিঁদ কাটতে যায়, তুমিও কাটবে?" যাহা হউক সেদিন অল্পের উপর দিয়াই গেল, শ্যামলাল একটু ধমক-ধামক খাইয়াই খালাস পাইল।
ইহার মধ্যে একদিন আমাদের পণ্ডিতমশাই গল্প করিলেন যে, তাঁহার সঙ্গে যাহারা এক ক্লাশে পড়িত, তাহাদের মধ্যে একজন নাকি অতি সুন্দর কবিতা লিখিত। একবার ইন্স্পেক্টর ইস্কুল দেখিতে আসিয়া, তাহার কবিতা শুনিয়া এমন খুশি হইয়াছিলেন যে, তাহাকে একটা সুন্দর ছবিওয়ালা বই উপহার দিয়াছিলেন।
ইহার মাসখানেক পরেই ইন্স্পেক্টর ইস্কুল দেখিতে আসিলেন। প্রায় বিশ-পঁচিশটি ছেলে সাবধানে পকেটের মধ্যে লুকাইয়া কবিতার কাগজ আনিয়াছে। বড় হলের মধ্যে সমস্ত স্কুলের ছেলেদের দাঁড় করানো হইয়াছে, হেডমাস্টার মহাশয় ইন্সপেক্টরকে লইয়া ঘরে ঢুকিতেছেন— এমন সময় শ্যামলাল আস্তে আস্তে পকেট হইতে একটি কাগজ বহির করিল। আর যায় কোথা ! পাছে শ্যামলাল আগেই তাহার কবিতা পড়িয়া ফেলে, এই ভয়ে ছোট বড় একদল কবিতাওয়ালা একসঙ্গে নানাসুরে চীৎকার করিয়া যে যার কবিতা হাঁকিয়া উঠিল। মনে হইল, সমস্ত বাড়িটা কর্তালের মতো ঝন্ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল, ইন্স্পেক্টর মহাশয় মাথা ঘুরিয়া মাঝ পথেই মেঝের উপর বসিয়া পড়িলেন। ছাদের উপর একটা বিড়াল ঘুমাইতেছিল, সেটা হঠাৎ হাত পা ছুড়িয়া তিনতলা হইতে পড়িয়া গেল, ইস্কুলের দারোয়ান হইতে অফিসের কেশিয়ার বাবু পর্যন্ত হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। সকলে সুস্থ হইলে পর মাস্টার মহাশয় বলিলেন, "এতো চেঁচালে কেন?" সকলে চুপ করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা করা হইল, "কে কে চেঁচিয়েছিল?" পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল— "শ্যামলাল।" শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে, এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না। যতগুলি ছেলের পকেটে কবিতার খাতা পাওয়া গেল, স্কুলের পর তাহাদের দেড়ঘণ্টা আটকাইয়া রাখা হইল।
অনেক তম্বিতম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। তখন হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, "কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?" বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, "বিষস্য বিষমৌষধম্, বিষের ওষুধ বিষ। বসন্তের ওষুধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যে কবিতা লিখেছ তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা এক মাস প্রতিদিন পঞ্চাশ বার করে এটা লিখে এনে স্কুলে আমায় দেখাবে" এই বলিয়া তিনি টিকা দিলেন—
পদে পদে মিল খুঁজে, গুণে দেখি চৌদ্দ
এই দেখ লিখে দিনু কি ভীষণ পদ্য !
এক চোটে এইবারে উড়ে গেল সবি তা,
কবিতার গুতো মেরে গিলে ফেলি কবিতা।
একমাস তিনি কবিদের এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্যগুণ— তারপর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।
=================================================================================
গল্প কিংবা কবিতা, কোন কিছু লেখাতেই তেমন জুত করতে পারিনা। তা না হলে কাল্পনিক_ভালোবাসার কথামতো ভৌতিক বা আধি ভৌতিক গল্প লিখে পুরষ্কার জেতার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতাম... তা যখন হচ্ছে না তখন দর্শক হয়ে দেখি কে হন সেরা ভূতকার!
কা_ভাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, কবিতা প্রতিযোগিতার ঘোষণা না দেয়ায়...
কা_ভার ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে এ পর্যন্ত যারা ভূতের গল্প বা আধি ভৌতিক গল্প (বা কবিতা) দিয়েছেন তার একটা লিষ্টি বানিয়ে নীচে দিলাম। সবচেয়ে উপরে আছে সবশেষে আসা গল্প।
ভৌতিক বা আধি ভৌতিক গল্প প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেয়া কাল্পনিক_ ভালোবাসার পোস্ট:
view this link
৩৮) মা হাসান: view this link
৩৭) বিদ্রোহী ভৃগু: view this link
৩৬) আমি সাজিদ: view this link
৩৫) ওমেরা: view this link
৩৪) সোহানী: view this link
৩৩) বিদ্রোহী ভৃগু: view this link
৩২) কবিতা পড়ার প্রহর: view this link
৩১) মা হাসান: view this link
৩০) মোঃ মাইদুল সরকার: view this link
২৯) মিররড ডল: view this link
২৮) শাইয়্যানের টিউশন: view this link
২৭) অজ্ঞ বালক: view this link
২৬) ইমরান আল হাদী: view this link
২৫) গিয়াস উদ্দিন লিটন: view this link
২৪) ওমেরা: view this link
২৩) বিএম বরকতউল্লাহ: view this link
২২) পদাতিক চৌধুরী জুনিয়র: view this link
২১) অপু তানভীর: view this link
২০) শেরজা তপন: view this link
১৯) নীল আকাশ: view this link
১৮) মাআইপা: view this link
১৭) রাজীব নুর: view this link
১৬) আখেনাটেন: view this link
১৫) অশুভ: view this link
১৪) পদ্মপুকুর: view this link
১৩) পদাতিক চৌধুরী শেষ পর্ব: view this link
১২) কল্পদ্রুম: view this link
১১) বিএম বরকতউল্লাহ: view this link
১০) রাজীব নুর: view this link
৯) পদাতিক চৌধুরী পর্ব দুই: view this link
৮) বিএম বরকতউল্লাহ: view this link
৭) আহমেদ জী এস: view this link
৬) আমি সাজিদ: view this link
৫) বিএম বরকতউল্লাহ : view this link
৪) পদাতিক চৌধুরী পর্ব এক: view this link
৩) রাজীব নুর: view this link
২) বিএম বরকতউল্লাহ : view this link
১) বিএম বরকতউল্লাহ : view this link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৯