একটা শিশু তার জীবনের প্রথম পাঁচ বছর যা শেখে, তা তার পরবর্তী জীবনের ভিত তৈরি করে দেয়। এই সময়ে ছবি আর শব্দ দিয়ে শিশুদের জন্য চমৎকার একটা জগৎ তৈরি করা যায়, যে জগতে চাঁদ হাসতে জানে, দুমদাম শব্দে ফুল ফোটে, মুরগি-শিয়াল-বাঘ-সিংহ-কুমির সবাই অফুরান কথা বলতে থাকে........
একেবারে ছোট শিশুদের কিছু শেখাবার জন্য, কিম্বা একটা সুন্দর জগত তৈরি করে দেয়ার জন্য বাংলায় প্রচুর ছন্দময় ছড়া রয়েছে। 'আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা' বা 'চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে?' এই ছড়া শুনতে শুনতে শিশুর চাঁদ চেনে; 'খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে', কিংবা 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের দেশে এসো/ খাট নাই পালং নাই পিঁড়ি পেতে বস' শুনতে শুনতে শিশুর দু'চোখে ঘুম নামে। আবার 'খোকা যাবে মাছ ধরতে সঙ্গে যাবে কে? ঘরে আছে হুলো বিড়াল কোমর বেঁধেছে' কিংবা 'আয়রে আয় টিয়ে, নায়ে ভরা দিয়ে....' এইসব ছড়া ছবিওয়ালা বইয়ের পাতা উল্টে শুনতে শুনতে শিশুরা হুলো বিড়াল, বোয়াল মাছ, ভোঁদড়ের কান্ডকীর্তি দেখে মোহিত হয়। বৃষ্টির টুপটাপ শুনতে শুনতেও কত ছড়া শোনা যায়! 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবো মেপে' কিংবা 'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান'........
কবিগুরুর কবিতায় দেখি:
"বাদল ধারায় মনে পড়ে ছেলে বেলার গান/ বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর নদে এলো বান" (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, সঞ্চয়িতা)
কবিগুরুর ছেলেবেলা মানে অন্তত দেড়শ বছর আগের কথা। তাহলে বাঙলার এই ছড়া- কবিতার সৃষ্টি কয়েক প্রজন্ম ধরে শিশুদের মনোরঞ্জন করে আসছে!
সে তুলনায় এই বয়সীদের জন্য গল্প আছে খুবই কম; এর একটা কারণ মনে হয়, ছন্দময় ছড়া শিশুরা মনে রাখতে পারে সহজে; ছড়া- কবিতায় অল্প কথা দিয়ে শিশুদের বোধগম্য একটা ছবি এঁকে দেয়া যায়, কিন্তু এ কাজটা গল্প দিয়ে করা কঠিন; হয়ত তাই, এদের জন্য গল্প তেমন লেখা হয়নি। অনেক খুঁজে পেতে এই বয়সী শিশুদের জন্য লেখা বাংলায় একটাই গল্পের বই পেয়েছি- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা টুনটুনির বই। এটা তিনি লিখেছিলেন ১০০ বছরেরও আগে! আসলে এত ছোট শিশুদের জন্য যে বই লেখা যায়, লেখা দরকার, এই বোধটাই হয়তো আমাদের নেই। বাংলাপিডিয়ায় শিশুসাহিত্যর সংজ্ঞা কেন দেয়া আছে এভাবে:
"শিশুসাহিত্য শিশুদের উপযোগী সাহিত্য। সাধারণত ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে এ সাহিত্য রচনা করা হয়। এই বয়সসীমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে।"
তাহলে ছয় বছরের কম বয়সীরা কি শিশু না! তাদের উপযোগী সাহিত্যর দরকার নেই!!
রাশিয়ান ভাষায় কিন্তু এই ১ থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্য প্রচুর গল্প আছে, যা একইসাথে মনোরঞ্জক এবং শিক্ষামূলকও। আশির দশকের রাশিয়া টুকরো হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত মস্কোর প্রগতি প্রকাশন থেকে রাশিয়ান সাহিত্য বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর অনূদিত হত, বাংলাতেও অতি চমৎকার ভাবে অনূদিত রাশিয়ান সাহিত্য অনেক, অনেক আছে। মূল রাশান সাহিত্য পড়তে পারিনি, কিন্তু যতটুকু এই অনূদিত সাহিত্য পড়েছি, তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, রাশিয়ান সাহিত্যের মত মনের মাঝখানে গিয়ে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া, আবার একইসাথে শিক্ষামূলক, এমন সাহিত্য সারা পৃথিবীতে আর কোথাও ছিল না, নেইও। ছোটদের বইগুলো যা বাংলায় অনূদিত হত সেগুলো ছিল বিশাল, চোদ্দো/ দশ ইঞ্চি আকারের, একটু মোটা এক ধরনের কাগজে ছাপা, আর প্রতি পাতায় সুন্দর ছবি আর একটা করে বাক্য মোটামুটি দশ বারোটা বাক্যে ছোটদের একটা গল্প। ছবিসহ গল্পগুলো এমন যে, একবার শুনলে এরপর ছবি দেখে দেখে নিজেই গল্পটা বুঝে নেয়া যায়! গল্পগুলো একেবারে দু তিন বছরের বাচ্চার উপযোগী। একটা গল্প এরকম- গল্পের নাম 'কার জোর বেশি'। এই বইয়ের প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দু তিন বছরের ছেলে জিজ্ঞেস করছে, "আচ্ছা বাবা, কার জোর সবচেয়ে বেশি?" বাবা বলছে, "চল্, নিজেই দেখে নে।" বাবা ছেলেকে নিয়ে গেল চিড়িয়াখানায়; সব প্রাণী দেখার পর ছেলে বলল, "হাতি আর তিমি সবচেয়ে বড়, তাই এদের জোর সবচেয়ে বেশি।" এবার বাবা নিয়ে গেল, যেখানে কনটেইনারে মাল ভরে ক্রেনে তোলা হচ্ছে সেখানে। বাবা বলল, "এই কন্টেইনারে হাতি, তিমি দুটোই এঁটে যাবে।" ছেলে বলল, "তাহলে ক্রেনের জোর বেশি, কারণ ক্রেন কনটেইনারগুলো তুলছে!" এবার বাবা বলল, "দেখ, একটা মালগাড়িতে একসাথে কতগুলো কন্টেইনার যাচ্ছে", ছেলে বলল, "তাহলে মালগাড়ির জোর বেশি।" এরপর তারা এলো জাহাজ ঘাটে, দেখা গেল একেকটা জাহাজে কয়েকটা করে মালগাড়ির জিনিস ভরা হচ্ছে। ছেলে দেখে বলল, "তাহলে জাহাজের জোর সবচেয়ে বেশি", বাবা বলল, "কিন্তু মানুষ যদি না চালাতো, তাহলে এই জাহাজ, মালগাড়ি, ক্রেন কিছুই চলতো না; তাহলে কার জোর বেশি হল?"এবার ছেলে বলল, "মানুষের"; পিঠ চাপড়ে বাবা বলল, "একেবারে ঠিক।"
এই বই দেখে গল্প শুনতে শুনতে যে শিশু কখনো চিড়িয়াখানা দেখেনি, সেও চিড়িয়াখানার অনেক জীবজন্তু দেখে ফেলে, দেখে জাহাজঘাটা, ট্রেন স্টেশন, মালগাড়ি..... আর জেনে যায় সবচেয়ে বেশি জোর কার, মানুষের!
মাশার গল্পও ছোটদের বোঝার মত; রাশিয়ান ভাষায় মাশা মানে ছোট খুকি। মাশার একটা গল্প এরকম:
একদিন মাশা দেখতে পেল এক থুত্থুরে- দুর্বল বুড়ি রাস্তা পার হতে পারছে না, মাশা তাকে হাতে ধরে রাস্তা পার করে দিল। বুড়ি খুব খুশি হয়ে মাশাকে একটা ফুল দিল, তাতে রংধনুর সাত রং এর পাপড়ি। বুড়ি বলল, "যখনই তুমি কিছু চাইবে, তখনই একটা করে পাপড়ি ছিঁড়ে বলবে,
যা উত্তর যা দক্ষিণ
সাঙ্গ করে প্রদক্ষিণ
যেই না এসে পড়বে ভূঁইয়ে
ইচ্ছে উঠুক সফল হয়ে।
সাথে সাথে সেটা পেয়ে যাবে।" পরীক্ষা করে দেখার জন্য মাশা লাল পাপড়িটা ছিড়ে বলল, "যা উত্তর, যা দক্ষিণ,.... আমি বাড়ি যাব", অমনি দেখে সে তার বাসায় দাঁড়িয়ে আছে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই দেখল, আলমারির মাথায় মায়ের কাঁচের ফুলদানি রাখা। ভাবল, এটা নিয়ে খেলা যাক! ফুলদানিটা নামাতে যেতেই হাত থেকে পড়ে চুরমার! রান্নাঘর থেকে মা চেঁচিয়ে বললেন, "কি ভাঙল মাশা?" মাশা ঝটপট কমলা পাপড়িটা ছিঁড়ে বলল, "যা উত্তর..... মায়ের ফুলদানিটা ঠিক হয়ে যাক!" দেখে ফুলদানি আবার আলমারির মাথার উপরে। এখন কি করা যায়! জানলা দিয়ে গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে মাশা ভাবলো, উত্তর মেরু গেলে কেমন হয়! সঙ্গে সঙ্গে নীল পাপড়ি ছিঁড়ে বলল, "......আমি উত্তর মেরু যাব"
দেখে শোঁ শোঁ বাতাসের সাথে বরফে কুচি এসে ওকে জমিয়ে দিচ্ছে, চারপাশ অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই! বুঝল এটাই উত্তর মেরু! ঠান্ডায় আর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ হাতে ধরা ফুলে চোখ পড়ল; তাড়াতাড়ি বেগুনি পাপড়ি ছিঁড়ে বলল,
".......আমি বাড়ি যাব"
দেখে আবার সে বাড়িতে। ভাবল, কি করি . এখন...... আচ্ছা, খেলনা আনানো যাক! হলুদ পাপড়ি ছিঁড়ে বলল, "....আমার খেলনা চাই", সঙ্গে সঙ্গে খেলনা আসা শুরু হল, বাতাসে ভেসে ভেসে খেলনা আসছে..... পুতুল, হাতি, বাঁশি, বল.... যত রকম খেলনা আছে, দোকানের খেলনা, বাসার খেলনা, সবরকম খেলনা...... বাসা ভরে, উঠোন ভরে যেতে লাগল। মাশা বলতে লাগলো, "থাক! থাক! আর লাগবেনা!" কিন্তু খেলনা আসছেই..... এবার মাশা সবুজ পাপড়ি ছিঁড়ে বলল, "......সব খেলনা চলে যাক" সাথে সাথে বাড়ি খালি, একটাও খেলনা নেই, এমনকি তার নিজের যেসব খেলনা ছিল সেগুলোও চলে গেছে!
মাশা দেখল আর মাত্র একটা পাপড়ি আছে- আকাশী পাপড়ি। মাশা ভাবলো, 'এখন কি চাইব! একটা সাইকেল, নাকি বড় পুতুল, নাকি একটা ট্রেন সেট!' ভাবতে ভাবতেই মাশা বাইরে এলো, এসে দেখে সব বাচ্চারা খেলছে, শুধু একটা ছেলে চুপচাপ মন খারাপ করে একা বসে আছে। মাশা বলল "তুমি খেলছো না কেন?" ছেলেটা বলল, "কি করে খেলবো! আমার তো পা ভাঙ্গা" মাশা বললো, "এক্ষুনি তোমার পা ভালো করে দিচ্ছি", বলে শেষ পাপড়িটা ছিঁড়ে বলল, "ছেলেটার পা ভালো হয়ে যাক", অমনি ছেলেটা উঠে দৌড় লাগালো, তাকে ধরতে পিছনে দৌড়াতে লাগলো মাশা।
গল্পটা মজার; আবার শিক্ষণীয়। এরকম গল্প আরো অনেক আছে, যেমন অকর্মার চিঠি, কুটকুটে বিছানা, লাল ঝুঁটি মোরগটি....... এমনকি বোকা আইভানের গল্প, যেটা একটু বড় বাচ্চাদের, সেটা পর্যন্ত এই ছোট বাচ্চারা দেখেশুনে খুব মজা পেত। আমি যখন আমার ছেলে মেয়েদের জন্য এই বইগুলো খুঁজলাম, তখন আর বাজারে রাশিয়ান বই পাওয়া যায় না, পেলাম অনূদিত চাইনিজ বই। এগুলোও একেবারে ছোট শিশুদের জন্য, এগুলোতেও ছবিসহ গল্প আছে, কিন্তু ছবি-গল্প কোন কিছুই রাশিয়ান বই এর ধারে কাছে যায় না। চৈনিক গল্পে আছে পান্ডা, খরগোশ, হাতি, শেয়াল এইসবের নানা ঘটনা; আর আছে চার পাঁচ বছর বয়সী ইউয়ান ইউয়ানকে নিয়ে নানা ঘটনা; কিভাবে সে খায়, ঘুমায়, কিন্ডারগার্টেনে যায় এসব, এগুলোই গল্প!! অদ্ভুত লাগলো দেখে যে, এই গল্পগুলোতে কোন কাল্পনিক চরিত্র নেই,(যেমন মাশার গল্পে বুড়িরূপী পরী) শিশুদের গল্পে যার উপস্থিতি প্রায়শই থাকে। চীনা শিশুদের মনে হয় হাঁটি হাঁটি পা পা বয়স থেকেই বাস্তব জীবনের গল্প শেখানো হয়- এতে ভালো না মন্দ হয় জানিনা!
জাপানি ছোট শিশুদের জন্যও ছবিসহ গল্প আছে; আমার একটা মাত্র জাপানি গল্প মনে আছে। দুই বোন থাকে শ্বশুর বাড়িতে; বহুদিন মাকে দেখেনি, তাই শাশুড়ির কাছে অনুমতি চাইলো মায়ের বাড়ি যাবার। শাশুড়ি তাদের যাওয়া বন্ধ করার জন্য বললেন, এক শর্তে অনুমতি দেবেন যাবার, যদি ফেরার সময় তাদের একজন কাগজে করে বাতাস, আরেকজন কাগজে করে আগুন নিয়ে আসতে পারে। ৩ কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল দুই বোন। তারপর এক মাস মায়ের কাছে থেকে, যখন বাড়ি ফিরছে, তখন অর্ধেক পথ পার হয়ে, একটা জঙ্গলের মধ্যে এসে হঠাৎ শাশুড়ির শর্তের কথা মনে পড়ল; মনে পড়তেই তারা বুঝলো কি অসম্ভব কাজ করতে তারা রাজি হয়েছে। দুজন তখন খুব কাঁদতে লাগল। হঠাৎ দেখে সামনে এক পরী! পরী সব শুনে বলল, "কান্না থামাও, তোমরা যা চাও এক্ষুনি তা দিচ্ছি" বলে পরী একটা কাগজ নিয়ে অনেক ভাঁজ করতে লাগলো, ভাঁজ করা কাগজ এর একদিক ধরে নাড়া দিতেই বাতাস বের হলো পরী বলল এই নাও, কাগজে করে বাতাস- এর নাম পাখা। এবার পরী একটা কাগজের উপর একটা মোমবাতি বসিয়ে মোমবাতির চারপাশ কাগজ দিয়ে ঢেকে দিল। অন্য বোনকে সেটা দিয়ে বলল, "এই নাও কাগজের মধ্যে আগুন, এর নাম লন্ঠন।" দুই বোন তো মহা খুশি!
জাপানি পাখা আর লন্ঠন কিভাবে এল তার গল্প এটা! এই গল্প পুরোটা ছবি দিয়ে বলা, যার জন্য ছোট বাচ্চারাও এটা বুঝতে পারে।
ইংরেজিতে ছোট বাচ্চাদের জন্য এমন প্রচুর গল্প আছে, এগুলোকে বলে টডলার স্টোরিজ। আসলে ইউরোপে এক দেশে যে গল্পের উৎপত্তি তা অন্য দেশে গিয়ে সেই দেশীয় রূপ ধারণ করে, সেই দেশেরই গল্প হয়ে যায়। তাই ডেনমার্কের হ্যান্স এন্ডারসনের গল্প আর জার্মানির গ্রীম ভাইদের গল্প ইউরোপের নানা দেশে নানাভাবে চালু আছে, ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীর নানা দেশে। গ্রীম ভাইদের একটা গল্প আছে জেলে ও মাছের গল্প; এই গল্পটা আবার রাশিয়ানদেরও আছে; রাশিয়ানরা যদি গ্রীম ভাইদের থেকে এই গল্পটা নিয়েও থাকে, তবে তার পরিবেশন একেবারে তাদের দেশী স্টাইলে, এটার বাংলা অনুবাদও খুব সাবলীল, শুনলে মনে হয় আমার দেশী কোন ভাই কথা বলছেন! এই যেমন মাছকে ডেকে বলা জেলের কথা,
".........মোর স্ত্রী এমেলা, এ জীবনের ঝামেলা
পাঠিয়েছে হেথা মোরে, বর মাগিবার তরে"
এই বইয়ের ছবিগুলো খুব সুন্দর; শান্ত সমুদ্র, উত্তাল সমুদ্র, প্রাসাদ এবং সবশেষে ভাঙ্গা কুঁড়েঘরের সামনে সস্ত্রীক জেলে। যদিও গল্পটা একটু বড় কিন্তু এটাও ছবি দেখে দেখে বোঝার মতো গল্প! এই গল্পের শিক্ষা, 'বেশি লোভ করলে সব চলে যায়' !! এরকম শিক্ষামূলক গল্প আরো আছে, যেগুলো তিন বছরের থেকে শুরু করে আরো বড় বাচ্চাদের বোঝার মত, খুব ছোটদের বলার সময় কিছু কাটছাঁট করতে হয় তাদের জ্ঞাত শব্দ ভান্ডার বিবেচনা করে। পিনোকিওর গল্প এমন একটা গল্প; একেকটা মিথ্যা বলার সাথে সাথে পিনোকিওর নাক বড় হতে থাকে; এই বইয়ে অনেক ছবি থাকায় ছোট শিশুরা গল্পটা বুঝতে পারে, মিথ্যা কথা বললে যে বিপদ হয় সেটাও বুঝতে পারে!
ঈশপের গল্পগুলোও শিক্ষামূলক, কিন্তু ছবি না দেখিয়ে এই গল্পগুলো শিশুদের বলে বোঝানো মুশকিল। আমার ছোটবেলায় শোনা ঈশপের প্রতিটা গল্প আজো মনে আছে........ একটা গল্পে ছিল, একটা ছোট ছেলে দেখল যে রাস্তার পাশে পড়ে আছে একটা কাঁচের বৈয়াম, ভেতরে অনেকগুলো মার্বেল। ছেলেটা বৈয়ামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মুঠো ভরে মার্বেল নিয়ে হাত বের করতে গিয়ে দেখল, বৈয়ামের মুখে হাত আটকে যাচ্ছে। অনেকবার চেষ্টা করার পরও যখন পারল না, তখন সে মুঠোয় অল্প কয়টা মার্বেল নিল, এবার সহজেই হাত বের করতে পারল। Grasp all, lose all- তখনই শিখেছিলাম!
ছোটদের শব্দ ভান্ডার সীমিত বলে গল্প তাদের গল্প বলা কিছুটা ঝামেলার; আবার অনেকসময় গল্প তারা নিজের মতো করে বানিয়ে নেয়! আমি এটা বুঝেছিলাম আমার ১৪-১৫ বছর বয়সে, ২+ বছর বয়সী মামাতো বোনকে গল্প বলতে গিয়ে। তাকে গল্প বলা শুরু করেছিলাম, 'একদিন এক বাঘের গলায় কাঁটা ফুটল', সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, "কেন, গাবের মা ওকে পানি খাওয়ায় নাই?" সেই উদগ্রীব মুখের দিকে চেয়ে মনে হলো, বাঘ কাকে বলে ওতো তাই জানে না; তাহলে বাঘ, সারস, শিয়াল এসব চেনাবো কিভাবে! তার চেয়ে ও যেভাবে শুনতে চায় সেভাবেই গল্পটা বলি! বললাম, "হ্যাঁ, মা তো প্রথমে একটু পানি খাওয়ালো, কাঁটা গেল না; আবার খাওয়ালো, গেল না, তারপর আবার খাওয়ালো......" এভাবে অনেকবার পানি খাওয়ার গল্প বলার পর একসময় বাঘের গলায় কাঁটা বেঁধার গল্প শেষ হল ! ঈশপ সাহেব তার গল্পের এই রূপান্তর দেখলে কি বলতেন জানি না, কিন্তু এভাবে ছোট শিশুদের জন্য গল্প বানানো যায়, যেকোনো একটা কিছু নিয়ে গল্প শুরু করে দিলেই হয়, তারপর তার কল্পনা অনুযায়ী গল্প আগাতে থাকে। অবশ্য এভাবে গল্প বানাবার একটা সমস্যাও আছে; প্রথমবার যা বলে আর শোনে, শিশুর মাথায় গল্পের সেই শব্দগুলো থেকে যায়, তাই পরের বার বলতে গেলে হুবহু সেটাই বলতে না পারলেই বিপত্তি!! একবার ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে যৌথ উদ্ভাবন হল ইলিশ মাছের ক্যান্ডি ফ্লস কিনতে যাবার গল্পের। পরের বার আবার ইলিশ মাছ খাওয়াবার সময় সেই গল্প বলতে হবে, বললামও, কিন্তু প্রথমবার বলার সময় ইলিশ মাছের বাচ্চাদের যে নাম ছিল সেগুলো ভুলে গেছিলাম, সুতরাং খুবই অশান্তি হল! এর পর থেকে গল্প যেটাই বানানো হোক, আমি খুঁটিনাটি লিখে রাখতাম.......
সব বিদেশী গল্পর কথা বললাম, আমাদের গল্পের কথা বলি। এই খুব ছোট শিশুদের জন্য বাংলায় প্রচুর ছড়া-কবিতা থাকলেও গল্প তেমন নেই, আগেই বলেছি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা এগুলো ছোটদের জন্য লেখা ঠিকই, কিন্তু আজকালকার শিশুরা ওই গল্পগুলোতে তেমন আগ্রহী হয় না। বাংলা শিশু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন রায় পরিবারের যে তিন প্রজন্ম- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়; চমৎকার লেখার সাথে সাথে এরা সকলেই ছবিও আঁকতে জানতেন, তাই এদের পক্ষেই সম্ভব ছিল ছোটদের জন্য ছবিসহ গল্প লেখা। কিন্তু তারা কেউই তা লেখেননি; প্রথম দুজনের জীবদ্দশায় এদেশে ছাপাখানা তেমন উন্নত ছিল না জানি, কিন্তু সত্যজিৎ রায় কেন লেখেন নি কে জানে!!
আমাদের অনেক রূপকথা আছে; ঠাকুরমার ঝুলি তো রূপকথার এক বিশাল ভান্ডার। এই রূপকথাগুলো আমাদের লোকসাহিত্যের অংশ; বহুকাল আগে থেকেই শিশুরা এগুলোর সাথে পরিচিত। কিন্তু আমার মনে হয়, এই রূপকথাগুলোর বিষয়বস্তু খুব ছোট শিশু কেন, কোন শিশুর জন্যই উপযোগী নয়।
অরুন-বরুন-কিরণমালার অভিযান, বা রাজপুত্র- মন্ত্রীপুত্র তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অভিযানে যায়, কখনো অচিনদেশের রাজকন্যাকে নিয়ে ফেরে- এই গল্পগুলো হয়তো বাচ্চাদের কল্পনা শক্তিকে উদ্দীপিত করে কিন্তু অনেক গল্পেরই বিষয়বস্তু এমন যে, শিশু তা থেকে নতুন কিছু শিখতে পারে না......... কোন কোন রূপকথার গল্প এমন যে- রাজার সন্তান হয় না, তাই একে একে সাত রাণী ঘরে আনেন, কিন্তু কারোরই সন্তান হয় না; তখন একদিন এক সন্ন্যাসী এসে একটা ফল দিয়ে বলেন সেটা পাটায় বেঁটে যেন সাত রানী সাত ভাগ করে খান, কিন্তু ছয় রানী ষড়্ করে ছোটরাণীকে না দিয়েই সেটা খেয়ে নেন, ছোট রানী এসে যে শিলপাটায় সেটা বাটা হয়েছিল সেটা ধুয়ে পানি খায়; দশ মাস পরে ছয় রানীর সুন্দর ছয়টি ছেলে হলো কিন্তু ছোট রানীর গর্ভে জন্ম নিল একটা বানর, আর একটা পেঁচা। তাদের নাম হল বুদ্ধু- ভুতুম........
এইসব গল্প এমনই অদ্ভুতুম!! এইসব গল্পে অনেক ছড়াও আছে, যেমন:
"বুদ্ধু আমার বাপ, কি করেছি পাপ,
কোন পাপে ছেড়ে গেলি দিয়ে মনস্তাপ!" কিম্বা,
"এক যে ছিল বাদশা তাহার ঘরে ছিল সাতটি রানী
ছোট রানী মা হইবেন, লোকে করে কানাকানি...."
আরো আছে, ১২ বছর বয়সী রূপবান কন্যার ১২ দিন বয়সী স্বামী, তার করুণ কাহিনী........
এইসব গল্পে শিক্ষনীয় কি আছে? গল্পগুলো নানি- দাদিরা বাচ্চাদের বলেন, তারাও খুব মন দিয়ে শোনে। শেষ পর্যন্ত কি বোঝে সেটা জানি না। একটা চার বছরের শিশু, যার শোনা বেশিরভাগ গল্পই এইসব রাজা- রানী সংক্রান্ত, তাকে যখন একটা গল্প বলতে বলা হল, তখন সে গল্প বলছে এভাবে:
"রাজা আর রানি বসে আছে বাগানে। মন্ত্রী আসলো, বলল, 'মহারানী, আপনার একটা মেয়ে হয়েছে', রানী বলল 'ও, তাই নাকি'........"
বেচারা বুঝতেও পারছে না, তার বলা গল্পটার উদ্ভটত্ব! এই গল্পটা শোনার পর থেকে ভাবছি, এইসব রূপকথা ঠিক কত বছরের বাচ্চাদের শোনার উপযোগী......
ইউরোপীয় রূপকথাগুলোও কী আর ভালো! বেশিরভাগই তো সৎমায়ের কূটনামি, রাণীর হিংসামি বা ডাইনীর শয়তানির গল্প! তবে রাশিয়ান বাবা ইয়াগা আর যাদুকরী ভাসিলিসার রূপকথা গুলো অনবদ্য!!!
যেসব শিশুরা কিছু বড়, যাদের জানা জগৎ এবং শব্দ ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ, তাদের জন্য এবং কিশোর বয়সীদের জন্য বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার খুবই সমৃদ্ধ; একইসাথে মনোরঞ্জক ও শিক্ষামূলকও। অবশ্য রাশিয়ান বই, যেমন তিমূর ও তার দলবল, মিশকার রান্নাবান্না, উভচর মানব, ছোরা- এগুলোর সাথে তুলনীয় কোন বই-ই আমি দেখিনি!!!
এখন সুন্দর ছবিওয়ালা অনেক বই পাওয়া যায়, কিন্তু বইয়ের পাতা উল্টে গল্পের ভেতর ডুবে যাবে এমন ছোট মানুষ এখন আর পাওয়া যায় না! এখন ৩/৪ বছর বয়সীরাও নিজে নিজে ট্যাব বা ল্যাপটপ চালাতে জানে, খুঁজে নেয় পছন্দসই গল্পের ভিডিও; আগের প্রজন্ম, কিংবা তারও আগের প্রজন্মের শিশুদের গল্প শোনার সাথে, এই প্রজন্মের শিশুদের ডিজিটাল গল্প শোনার আনন্দের কোন ফারাক হয় কিনা জানিনা! শিশুদের সম্পর্কে বলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাটা আমার খুব মনে হয়।
"ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর-কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা-অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে।" ( ছেলে ভুলানো ছড়া ১, রবীন্দ্র রচনাবলী)
কথাটা এখন আর ঠিক বলে মনে হয় না; দেশ কাল শিক্ষা প্রথা-অনুসারে বয়স্ক মানবের যেমন পরিবর্তন হয়েছে, শিশুদেরও তেমন পরিবর্তন ঘটেছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে; তাদের হাতে মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার এসে যাওয়ায় আজকের শিশু আর আগের দিনের শিশুর মধ্যে এখন বিরাট ফারাক। তাই এইসব গল্প কবিতার আবেদন ক্রমশই কমে আসছে।
সব ছবি অন্তর্জাল থেকে নেয়া।