সংবাদপত্র অফিসে একজন সাব এডিটরের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাব এডিটরের কাজ হলো সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তা সম্পাদনা ও প্রকাশের ব্যবস্থা করা। তিনি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিনিধি, প্রতিবেদক ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাথমিকভাবে সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো বাছাই করেন। তবে তিনি সব সংবাদ প্রকাশ করতে পারবেন না। এ কারণে তাকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মজাদার সংবাদ সংগ্রহ ও বাছাই করতে হবে। বাছাই করার পর তিনি সেগুলো ভালোভাবে সম্পাদনা করবেন। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ব্যক্তিকেই সাব এডিটর বলা হয় এবং তিনি যে কাজ করেন তাকে বলা হয় সাব এডিটিং বা সাবিং। ভালো সাব এডিটর হতে বেশকিছু বিষয় মেনে চলা দরকার। বিস্তারিত লিখেছেন : কবীর আলমগীর
নিউজ উপস্থাপনা হতে হবে সহজ : একজন সাব এডিটর যখন কোনো নিউজ এডিট করেন তার মূল লক্ষ্য হলো পাঠকের কাছে সংবাদের বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করা। মনে রাখতে হবে একটা নিউজ যেমন কোনো চায়ের দোকান যেমন পড়তে পারেন তেমনি পড়তে পারেন উচ্চশিক্ষিত কোনো লোকও। তাই নিউজের ভাষাটি হতে হবে গ্রহণযোগ্য। এমন কোনো ভাষা বা বাক্য ব্যবহার করা ঠিক হবে না যা সকল পাঠককে বুঝতে অসুবিধায় পড়েত হয়। নিউজ সম্পাদনার সময় প্রমিত ভাষায় যেভাবে কথাবার্তা বলা হয় সেভাবেই নিউজটি উপস্থাপন করতে হবে।
ধরুন : আপনার হাউজের প্রতিনিধি রির্পোট পাঠালেন। ঢাকার বনানীর একটি বাসায় চুরি করার প্রাক্কালে এক চোর আটক হয়েছেন। পরে উপস্থিত জনগণ চোরকে প্রহার করে পুলিশের কাছে সোর্পদ করেছে।
এখানে বেশকিছু শব্দ আছে যা সবার কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সহজভাষায় আপনি লিখতে পারেন ঢাকার বনানীতে বাসায় চুরি করার সময় এক যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। গণপিটুনির শিকার ওই চোরকে পরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
বানান ঠিক করুন : নিউজ সম্পাদনার মূল চাবিকাঠি হলো বানান ও বাক্যের সুষম ব্যবহার। এক্ষেত্রে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বানানরীতি অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া হাউজের কিছু কিছু বানানরীতি থাকে সেগুলোও মাথায় রাখতে। হাউজের এই রীতিকে স্টাইল শিট বলা হয়। একজন সাব এডিটর হিসেবে আপনার অবশ্যই স্টাইল শিট মাথায় রাখতে হবে। সংবাদপত্র কিংবা অনলাইনে পোর্টালে বহুল ব্যবহৃত হয় এরকম অন্তত পাঁচশ শব্দ নোট করে আপনি লিখে নিতে পারেন। তাহলে বানান ভুল হবে না। একটা অভিধানে হাজার হাজার শব্দ আছে। ভালো সাব এডিটর হতে হলে আপনাকে পুরো অভিধান মুখস্থ করতে হবে এমন কোনো মানে নেই। কিছু কিছু হাউজে বানান চেক করার সফটওয়ার আছে। বানান চেক করার সফটওয়ারের ওপর অধিকহারে নির্ভরশীল হবেন না।
ধরুন : ঝিনাইদহের মধুহাটি ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মো. মিনাজউদ্দীন নির্বাচিত হয়েছেন। এর পরিবর্তে রিপোর্টার যদি লেখেন ঝিনাইদহের মধুহাটি ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মো. মিনাজউদ্দীন নির্বাসিত হয়েছেন। তাহলে বানান চেক করার সফটওয়ার ‘নির্বাচিত’ আর ‘নির্বাসিত’ শব্দের মাঝে কোনো ভুল খুঁজে পাবে না।
যদি ইংরেজিতে লেখা হয় : Prime Minister Sheikh Hasina has gone to Bangobhaban to talk with Resident. এখানে প্রেসিডেন্টের জায়গায় রেসিডেন্ট লেখা হলে বানান চেকার দিয়ে তা শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই বানানযন্ত্রের ওপর নির্ভর না করে অভিধানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন।
বাক্য গঠনে মনোযোগী হোন : নিউজ সম্পাদনার বেলায় পারতপক্ষে জটিল বাক্য ব্যবহার করবেন না। একটি তথ্যের জন্য একটি ছোট বাক্য ব্যবহার করুন। বাক্য যত ছোট হবে নিউজ তত সুখপাঠ্য, বিষয়টি মনে রেখে কাজ করতে হবে।
ধরুন প্রতিনিধি পাঠাল : ঢাকা মহানগর যুবলীগের ২০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা ওসমানী মিলনায়তনে শনিবার বিকেলে এ সব কথা বলেন। বাক্যটি কত বড় হলো খেয়াল করুন। এখানে ছোট ছোট বাক্য করলে অন্তত তিন/চারটি বাক্য করা সম্ভব। যেমন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমানী মিলনায়তনে এক সমাবেশে এ সব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। ঢাকা মহানগর যুবলীগের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার বিকেলে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
স্টাইল শিট মাথায় রাখুন : প্রত্যেক হাউজেরই নিউজ সম্পাদনার কতগুলো স্টাইল থাকে। একজন সাব এডিটরকে এ সব স্টাইল শিট মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
যেমন ধরুন : কোনো হাউজের স্টাইল হলো হেডলাইন কখনো ৩ লাইন হবে না, সেক্ষত্রে আপনাকে হেডলাইন দুই লাইনের করার ওপর জোর দিতে হবে। যদি সেটি নিউজ বিশেষে করা না যায় তাহলে আলাদা কথা। কোনো হাউজের স্টাইল হতে পারে শিরোনামে কখনো ‘আজ’ শব্দ ব্যবহার করব না। সেক্ষেত্রে নিউজ এডিট করার সময় আপনাকে আজ- এর পরিবর্তে দিন বা তারিখ উল্লেখ করতে হবে।
ধরুন : শনিবার শেখ হাসিনা ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সমাবেশে এ সব কথা বলেন। এখানে বার বাক্যের প্রথমে। যদি হাউজের স্টাইল হয় বার বাক্যের প্রথমে থাকবে না। সেক্ষেত্রে আপনাকে লিখতে হবে- ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার এ সব কথা বলেন। যদি আপনার মাথায় স্টাইল শিট না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে প্রতিষ্ঠানের নিয়মের প্রতি আপনি অনুগত নন।
প্রশ্ন তৈরি করুন, সন্দেহ করুন : সংবাদ এডিট করার সময় কখনোই চোখবুজে রিপোর্টারকে বিশ্বাস করা যাবে না। রিপোর্টার সব তথ্য সঠিক দিয়েছে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা আপনি যদি রিপোর্টারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করেন তাহলে দেখা গেল আপনার হাত দিয়ে ভুল একটা তথ্য ছাপানো হলো। ভুল তথ্য ছাপালে হাউজের দুর্নাম, প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হবে।
ধরুন : ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ক কোনো সেমিনার হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জানালেন বাংলাদেশের অথর্নীতি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অবদান ৪৫ শতাংশ। রিপোর্টার ভুল করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জায়গায় ইসলামী ব্যাংক লিখল। আপনিও ভুল করলেন ওই তথ্য ছাপিয়ে দিলেন কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ না রেখেই। একজন সাব এডিটর হিসেবে আপনার প্রশ্ন রাখা উচিত ইসলামী ব্যাংক যদি দেশের অর্থনীতিতে ৪৫ শতাংশ অবদান রাখে তাহলে বাংলাদেশে আরো ইসলামী শরীয়তের ব্যাংক আছে সেগুলোর অবদান কত? আপনি এরকম প্রশ্ন করলেই উত্তর পাবেন ইসলামী ব্যাংক আর ইসলামী ব্যাংকিং এক কথা নয়।
আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি : পাঁচ টাকাকে সরকারি নোট করার জন্য অর্থমন্ত্রী সংসদে বিল উত্থাপন করলেন। বিলটি যাচাই-বাছাই করার জন্য স্পিকার সেটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠালেন। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ওপর নির্ভর করে বিলটি পাস হবে কি না? রিপোর্টার হেডলাইন করলেন ‘সরকারি মুদ্রা হল পাঁচ টাকা।’ সাব এডিটর হিসেবে আপনিও সেই হেডলাইন রাখলেন কোনো প্রশ্ন না করেই। আপনাকে প্রশ্ন রাখা উচিত ছিল বিল উত্থাপন আর বিল পাস এক কথা নয়। বিল পাস না হলে পাঁচ টাকার নোট সরকারি হবে না। বরং হেডলাইন হতে পারত : ‘পাঁচ টাকাকে সরকারি করতে সংসদে বিল’।
আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি : রিপোর্টার লিখলেন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির মাসিক আয় ১০ মিলিয়ন ডলার। আপনাকে সন্দেহ রাখতে হবে এটি ১০ মিলিয়ন হবে না ১০ বিলিয়ন হবে? এমনও হতে পারে রিপোর্টার লেখার সময় বিলিয়নের জায়গায় মিলিয়ন, কিংবা মিলিয়নের জায়গায় বিলিয়ন লিখে ফেলেন। প্রয়োজন হলে রিপোর্টার যেখান থেকে তথ্য নিয়েছেন সেই তথ্য যাচাই করুন।
আইনগত দিক মেনে চলুন : এমন কোনো নিউজ এডিট করবেন না যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা উস্কানি ছড়াতে পারে। এ রকম কোনো নিউজ থাকলে আপনি বার্তা সম্পাদককে অবগত করুন। স্পর্শকাতর নিউজগুলো কাউকে শেয়ার না করে নিজে ছাপানোর দায় নিবেন না। তাহলে দেখা গেল এই ভুলের কারণে আপনি চাকরিচ্যুত হতে পারেন। এ ছাড়া আইনগত ঝামেলায় পড়তে হয় এরকম নিউজের ব্যাপারে সচেতন হোন। যদি তথ্য ঠিক থাকে তাহলে আপনার হাতে প্রমাণ রাখুন যাতে আইনি ঝামেলা মোকাবিলা করতে পারেন। এরকম নিউজের বেলায় সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলুন।
বার্তা সম্পাদকের প্রতি আস্থা রাখুন : একটি বিষয় মাথায় রাখবেন, একজন বার্তা সম্পাদক তার পেশাগত যোগ্যতার বলেই ওই চেয়ারটিতে বসেন। সুতরাং তার যোগ্যতা নিয়ে কোনোপ্রকার সংশয়-দ্বিধা রাখবেন না। তার ওপর আস্থা রাখুন। এমনও হতে পারে আপনি মনে করছেন এই নিউজটির তথ্য ঠিক আছে, বার্তা সম্পাদক যদি বলেন নিউজটি ঠিক নেই আপনাকে তাই মেনে নিতে হবে। কারণ অফিসিয়াল ঝামেলাটুকু বার্তা সম্পাদকের কাছে আগে আসবে, এরপর আপনার। তাই বার্তা সম্পাদক যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিই মেনে নিন। অনেক সময় আপনি হয়ত বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে শিফটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারো সঙ্গে কথা বলুন। আপনি যোগাযোগ করতে না পারলেও শিফট ইনচার্জ বার্তা সম্পাদকের কাছ থেকে নিউজ বিষয়ক সিদ্ধান্ত ঠিকই নিতে পারবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২৯