বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৫শে মার্চ ছিল একটি নির্মম গণহত্যার দিন। অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যার প্রথম পর্যায়ে পাক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ দ্বারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হত্যাকান্ড শুরুর সময়েই ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি নরনারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা 'অপারেশন সার্চলাইট' অভিযান চালায়। সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল ঘুরে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন। নয় মাস যুদ্ধে আরও অনেক প্রতিবেদনে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মতো নিষ্ঠুরতার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি মার্কিন সিনেটর এডওর্য়ার্ড কেনেডি পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। একাত্তরের পাকিস্তানি গণহত্যা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার জন্য জহির রায়হান চারটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। লিবারেশন ফাইটার্স ও ইনোসেন্ট মিলিয়নস ছাড়াও স্টপ জেনোসাইড ও আ স্টেট ইজ বর্ন-এর পরিচালকও ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে সোচ্চার হতে থাকে। কতিপয় দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং অপরাপর সদস্য দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনী পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী গড়ে তুলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় বুদ্ধিজীবীসহ অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায় এবং এঁদের খুব কমই জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন। তাঁদের ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন, ব্যায়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দেহ ক্ষতবিক্ষত করে, গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতাকামী, মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নির্মূল করাই ছিল গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। হত্যাযজ্ঞে কতজন বাঙালি নিহত হন তা নির্ধারণে কোনো জরিপ পরিচালিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ শেষে সরকারি হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ও ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন বলে প্রকাশ করা হয়।
১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি তদন্ত করার জন্য জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের এগিয়ে আসা উচিত এইজন্যে যে, নিরীহ বেসামরিক জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে নিধন করার কার্যে যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল কিংবা যারা এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা তৈরির জন্য দায়ী ছিল তাদের অনেকে এখন বাংলাদেশ সরকারের আওতার বাইরে রয়েছে। ন্যয় বিচারের স্বার্থে এদেরকে কিছুতেই শাস্তির হাত থেকে রেহাই দেয়া যেতে পারে না। যারা সরকারের আওতায় রয়েছে দেশের আইন অনুযায়ী তাদেরও বিচার হবে।
১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক বিচারকমন্ডলী কমিশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষের উপর পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়ক বাহিনী গণহত্যায় জড়িত ছিল। এরফলে, বাঙালী জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে নির্মূল করার প্রয়াস চালানো হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, স্বাধীনতাকামী, আওয়ামী লীগের সমর্থক ও হিন্দু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলেও যুদ্ধের শেষদিকে নির্বিচারে বাঙালিদেরকে গণহত্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধককালীন ও যুদ্ধের পর বাঙালির হাতে অবাঙালিদের গণহত্যার বিষয়ে কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকারে পরিণত সম্প্রদায়ের সংঘটিত গণহত্যার অপরাধ প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাবে প্রমাণ করা অসম্ভব।
পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য পাকিস্তান প্রধান বিচারপতি হামদুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে যার তদন্ত রিপোর্ট পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর ওয়াশিংটন পোষ্টে প্রকাশিত হয়। তদন্ত রির্পোটে ব্রিটিশ সাংবাদিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ছাত্রী হলের লোমহর্ষক বর্ণনায় বলেন- ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় তিন চারশ সৈন্যের দল ছাত্রীনিবাসে হামলা চালিয়ে প্রবেশ করে, পৈশাচিক উন্মত্ততায় কক্ষে কক্ষে অবস্থিত যুবতী ছাত্রীদের উপর বলৎকার করতে থাকে, বিবস্ত্র করে শারীরিক ও অস্ত্রের সাহায্যে নির্যাতন করতে থাকে। পরে তাদের বিবস্ত্র লাশ লরিতে ভর্তি করে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যায়। এই ধরনের অনেক নারীঘটিত ঘটনার উল্লেখে তদন্ত কমিশন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে পদস্থ সামরিক কর্মকর্তার নির্দেশ ছাড়া অপরাধমূলক কর্ম সৈনিকের পক্ষে সম্ভবপর নয়। জেনারেল রাও ফরমান আলী তদন্ত কমিশনের কাছে গণহত্যা ও গণধর্ষনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং রাজাকার আলবদর বাহিনী সৃষ্টি করে হত্যা লুন্ঠন ধর্ষনের প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধ স্বীকার করেন। পাকিস্তানের পরাজয় সর্ম্পকে তদন্ত কমিশনের একটি চমকপ্রদ মন্তব্য ছিল- এটি কেবলমাত্র সামরিক পরাজয় নয়, এটি একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয়; যা পাকিস্তানকে বহুদিন বহন করতে হবে।
বাংলাদেশের গণহত্যার অজস্র তথ্য,প্রমাণ ও সংবাদ রয়েছে, নানাভাবে আলোচিত হয়েছে এর নৃশংসতা। গিনেস বিশ্ব সমীক্ষায় বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞকে বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত পাঁচটি বৃহৎ গণহত্যার অন্যতমরূপে তুলে ধরা হয়। বিশেষভাবে শক্তিধর দেশগুলির পক্ষপাতমূলক বিরোধীতার কারণে বাংলাদেশের গনহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে গণহত্যাকে সমর্থন দিয়েছিল। এই গণহত্যা অস্বীকারের কোনো উপায় নাই, তারপরও অস্বীকারের চেষ্টা দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করে ফলে বাংলাদেশ সরকারের আওতায় থাকা গণহত্যাকারীদের বিচার বিঘ্নিত হয়। পাকবাহিনীর দোসররা ক্ষমতার অংশীদার হয়ে গণহত্যাকে ক্রমাগত অস্বীকার করতে থাকে। গণহত্যায় নিহত শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। জনগণের স্মৃতি থেকে গণহত্যাকে মুছে ফেলার প্রয়াস চালায়। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে যে, যখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। গণহত্যাকারীদের সব চেষ্টা বিফলে যায় যখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় জনগণ এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালত বসিয়ে প্রতিকী বিচারে যুদ্ধাপরাধী প্রধানের ফাঁসির রায় প্রদান করা হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংসদে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ(আদালত) আইন দিয়ে যুুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে গণহত্যাকারীদের বিচার পুনরায় শুরু করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। বিচার চলাকালে অপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে আবারও জেগে উঠে জনগণ, দেশব্যাপী আন্দোলনে উদ্বেল গণজাগরণ মঞ্চ। তৎপর হয়ে উঠে গণহত্যাকারীদের অনুসারীরা ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে, অপপচারে লিপ্ত হয় দেশের ভাবমূর্র্তি ক্ষুন্ন করতে, এমনকি বিপুল অর্থ ব্যয় করছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের জন্য। তাদের সহায়তা করছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল ও বিদেশী কিছু রাষ্ট্রও। ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীর সমস্ত সম্পদ রাষ্ট্রের অনূকুলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধী পরিবারের রাস্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা, গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবী খেতাব যাতে না পায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে সকল দেশ, দল, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এখনও বাংলাদেশের গণহত্যাকরীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তাদের প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থার লক্ষ্যে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনীতি জোরদার করতে হবে।
জাতিসংঘে ১৯৫১ সালে গণহত্যা সম্মেলন আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হলেও ১৯৮৮ সালে পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র এতে যুক্ত হওয়ার পর গণহত্যার অপরাধের সাথে জড়িত আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়িত হয়। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত অপরাধ এখতিয়ারের বাইরে রাখার কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণ ও গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণহত্যার শিকার জাতি সকলের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্ট, আর্মেনিয়া কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যা স্মরণে রয়েছে আলাদা জাতীয় দিবস। বাংলাদেশও ১১ মার্চ ২০১৭ জাতীয় সংসদের দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২৫শে মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিন্ধান্ত নিয়ে যুক্ত হলো।
বিজয়ের ইতিহাসে গণহত্যায় শহীদের আত্মদান রক্তাক্ষরে লিখিত হয়ে যায় গণমানুষের স্মৃতিতে, আর পরাজিতরা তাদের অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলে মিথ্যে ইতিহাস লিখতে চায়। বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে মুছে ফেলতে জড়িত রাষ্ট্র যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনি তাদের এদেশীয় দোসররা সক্রিয় ছিল তাদের অপরাধ মুছে ফেলার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের মাাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম স্মরণে গণহত্যাকারী, তাদের অনুসারী ও সহায়তাকারীদের কলঙ্কিত অধ্যায়কে গণমানুষের ইতিহাসে খোদিত করে দিয়েছে। দীর্ঘ বছর পর বাংলাদেশের গণহত্যার বিচার বিজয়ের ইতিহাসকে যেমন আলোকিত করেছে, তেমনি পরাজিত গণহত্যাকারিরা ইতিহাসের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত জাতির জন্য অনুকরণীয় হযে উঠছে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। জয় বাংলা।।