জাতীয় শিশু দিবস
শিশুর অধিকার : বিশ্ব ও বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী শিশুদের কল্যাণে বিশ্ব শিশু দিবস ১৯২৪ সালে লীগ অব নেশন বিশ্ব সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রচারিত হয় এবং ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী শিশু অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ কতৃক গৃহীত হয় শিশু অধিকার সনদ যা ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। জাতিসংঘ সনদে ৫৪টি ধারায় শিশুদের কল্যান, অধিকার রক্ষা ও সকল প্রকার বৈষম্য, শোষণ, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে রক্ষার বিধান করা হয়েছে। উক্ত সনদে শিশুদের ব্যাপকভিত্তিক অধিকার স্বীকৃতিতে মৌলিক চারটি অধিকার প্রধান শিরোনামে আলোচ্য- বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, সুরক্ষার অধিকার ও অংশগ্রহনের অধিকার। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত- এ প্রত্যয় নিয়ে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের প্রথম শিশু সম্মেলন এবং উক্ত সম্মেলনে শিশু অধিকার রক্ষায় ঘোষিত হয় ২১ দফা কর্মপরিকল্পনা। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ২০১২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রত্যেক শিশু সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য সহস্রাব্দ লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেন।এতদসত্বেও বিশ্বে শিশুর অধিকার রক্ষার চিত্র সর্বক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার রক্ষায় কয়েটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অগ্রগতি হয়নি। শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা একুশ শতকে জাতিসংঘের জন্য চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বিশ্বে সহিংসতায় ৫০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি শিশু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দারিদ্রের কারণে বিশ্বের প্রায়ই ১৫ কোটি ৫ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু বাধ্য হয়ে শিশু শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৭% ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিশু শ্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খারাপ হচ্ছে দাসত্ব, পতিতাবৃতিতে বাধ্য করা ও শিশু পর্ণোগ্রাপি। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা উপরোক্ত ধরণের শিশু শ্রম নিষিদ্ধে ও দূরীকরণে পদক্ষেপের জন্য প্রস্তাব গ্রহন করেছে। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর প্রায়ই ২০ কোটি শিশু অপুষ্টির শিকার ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকীর সম্মুখীন। ইউএনএইডস এর তথ্যসূত্র অনুসারে সারাবিশ্বে প্রতিদিন প্রায়ই ৮ হাজার শিশু তরুণ এইডস আক্রান্ত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বে বর্তমানে প্রায়ই ১৫ কোটি শিশু শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ১৫ কোটি শিশু পিতামাতার একজন অথবা উভয়েই স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে এতিম। দেড় কোটি শিশু পিতামাতার একজন অথবা উভয়েই এইডসে মৃত্যুর কারণে পিতামাতাকে হারাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ৭ কোটি মেয়ে শিশুরা বাল্যবিবাহির শিকার এবং ১৫-১৯ বছর বয়সী দেড় কোটি শিশু নারী অল্পবয়সে সন্তান ধারণ করছে। বিশ্বে প্রতিবছর ২ কোটি শিশু বিভিন্ন কারণে স্থানচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তে পরিণত হচ্ছে। ১৫ লক্ষ শিশু পাচার, ১০ লক্ষ শিশু বিনা বিচারে কারাগারে আটক ও ৫ কোটি শিশুর জম্ম নিবন্ধিত হয়না। বিশ্বব্যাপী শিশু নির্যাতনের জটিল সমস্যাগুলোতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা রয়েছে। শিশু পাচার রোধ, অকারণে শিশুদের নির্যাতন, জোরপূর্ব্বক যৌনকর্মে বাধ্য করা, অল্পবয়সে সন্তানধারণ, শিশু অপহরণ ও জিম্মি করা, যুদ্ধে শিশুর উপর আক্রমণ ও ব্যবহার রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অবস্থান শক্তিশালী নয়। সম্প্রতি ইসরায়েল কতৃক গাজায় আক্রমণে অনেক শিশুর প্রাণহানি ঘটলেও জাাতসংঘ কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক আইনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘনে মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা পশ্চিমা বিশ্ব ছিল বিশ্রী রকমের নিশ্চুপ। পাকিস্থানে পেশোয়ারে জঙ্গীরা স্কুল শিশুদের নির্মম হত্যাকান্ডে বিশ্ববিবেক হতবাক। রাষ্ট্রীয় প্রশয় ব্যতীত সন্ত্রাস কখনো শক্তিশালী হয়না। এই বর্বরতম ঘটনার মধ্য দিয়ে আটক জঙ্গীদের ফাঁসি ও ঘটনায় নিহত শিশুদেও নামে বিভিন্ন স্কুলের নামকরণের মধ্য দিয়ে পাকিস্থান নতুনভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছে তা প্রশংসনীয়। সর্বক্ষেত্রে সন্ত্রাস নির্যাতন বন্ধে প্রতিঠি রাষ্ট্রের মধ্যে যে সহযোগীতা প্রয়োজন তার উদ্যোগ জাতিসংঘকেই গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ব শিশু দিবস আন্তর্জাতিভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃত ও পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয় ১৭ই মার্চ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জম্মদিনে। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ জম্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফুর রহমান মাতার নাম সায়েরা খাতুন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পাকিস্থান সৃষ্টির পর বাঙ্গালীর প্রতি বৈষম্যেও বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময়গুলি কারাগারেই অতিবাহিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রী লাভ করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফার রুপরেখা ঘোষণা দেন যা বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ নামে খ্যাত। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট আসনে বিজয়ী হয় আওয়ামীলীগ। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ভাষণে বাঙ্গালীর মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়ে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। ঐতিহাসিক মুজিব নগরে বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহনের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন হলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বীরের বেশে স্বাধীন জম্মভূমিতে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট দেশীবিদেশী ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাবিলাষী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন।
১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জম্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং শিশু অধিকার রক্ষায় প্রণয়ন করা হয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ১৯৯৭-২০০২। ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয় জাতীয় শিশু নীতি। শিশু অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ করতে ২০০১-২০১০ সালকে শিশু দশক ঘোষণা করা হয়। প্রণয়ন করা হয় শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়ষীরা শিশু ও বাংলাদেশের জাতীয় নীতিতে ১৪ বছরের কম বয়সীরাই শিশু হিসেবে গণ্য হয়, এই অসামঞ্জস্যতার ফলে বাংলাদেশে ১৪ বছরের উর্ধ্বে বয়সীরা শিশু হিসেবে গণ্য না হওয়ায় আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তারপরও সনদ নীতি ও আইন প্রণয়ণের মধ্য দিয়ে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে শিশুর অধিকার?
বাংলাদেশও শিশু অধিকার রক্ষায় বিশ্বের থেকে ব্যতিক্রম নয়। দরিদ্র ও দরিদ্র সীমার নীচে অবস্থানকারী পরিবারের শিশুরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় অধিকার লাভ থেকে সম্পূণরুপে বঞ্চিত। বাংলাদেশের শিশুরা দারিদ্রতা, খাদ্যে ভেজাল, পিতামাতার শিক্ষার অভারের ফলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন অপুষ্টির শিকার। বছরে ৪৫ লাখ শিশু জম্ম গ্রহণ কালে জম্মের সময় প্রতিহাজারে ৩ জন মা ও ৬০ জন শিশু মারা যায়। পরবর্তীতে প্রথম বছরে মারা যায় ৫ লাখ শিশু, ৫ বছরে পদার্পণ করে ৩৪ লাখ এদের মধ্যে ২০ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা লাভ করে। স্কুলে ভর্তি বয়সী শিশুদের ৮০% অধিক স্কুলে ভর্তি হলেও ৪০% ঝরে পড়ে ও বাকী ৬০% প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে তন্মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম। শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থান উদ্বেগের পর্যায়ে। শিশুদের ঝুকিপূর্ণ কর্মে নিয়োগের পাশাপাশি নিম্ন মজুরীর বঞ্চনা, মেয়ে শিশুশ্রমিকের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য। শিশুদের অংশগ্রহনের অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারে প্রায়ই অনুপস্থিত। শিশুদের মতামতের প্রতি পরিবারে তেমন কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুরাই বেশী নিগ্রহের শিকার। উপরোল্লেখিত আন্তর্জাতিক শিশু নির্যাতনের জটিল সমস্যাগুলো উন্নয়নশীল বাংলাদেশে প্রকট। শিশু পাচার, অকারণে শিশুদের নির্যাতন, জোরপূর্ব্বক যৌনকর্মে বাধ্য করা, বাল্যবিবাহ ও অল্পবয়সে সন্তানধারণ, শিশু অপহরণ ও হত্যা, শিশুদের ঝুকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োগ, শিশুদের বিনা বিচারে কারাগারে আটক, শিশুদের পিতামাতার অকালমৃত্যুতে বাস্তচ্যুত ইত্যাদি সমস্যাগুলি ব্যাপক এবং সমাধানের চিত্র মোটেই আশাপ্রদ নয়। বাংলাদেশে শিশু সমস্যার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্রতা বৃদ্ধি, ক্ষুধা, কর্মহীনতা, নদীভাঙ্গনের ফলে বাস্তচ্যুত হয়ে শহরে অভিবাসন।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অনুপাতে শিশু সংখ্যার বিশালতা সমস্যার ব্যাপকতা নির্দেশ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও ব্যাপক কেননা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, গবেষণা ও উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর থেকে অনেক পিছনে অবন্থান করছে। যার ফলে জাতির অর্ধেক ভবিষ্যত গড়ে উঠছে অযত্ম অবহেলায়। এই বিশাল ভবিষ্যত জনগোষ্ঠিকে সঠিক পরিচর্যায় দক্ষ মানব সম্পদে রুপান্তরের জন্য প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা, জাতিসংঘ সনদের বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস। শিশুর অধিকার বাস্তবায়ন সমাজের প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তির অংশগ্রহন ব্যতীত অসম্ভব। তাই আজকের জাতীয় শিশু দিবসের অঙ্গীকার হোক কবি সুকান্তের ভাষায়, “শিশুদের জন্য এই পৃথিবী বাসযোগ্য করে যাব আমি”।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ১০:৫৯