কাব্যধর্মী চলচ্চিত্র কিংবা চলচ্চিত্রে কাব্যের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। সিনেমার জন্মলগ্ন থেকেই কবিতাকে উপজীব্য করে নির্মিত সিনেমার সন্ধান যেমন মেলে তেমনি শুরু থেকেই কবিতাকেও সিনেমাটিক ভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন ফিল্মমেকাররা। তবে সিনেমায় প্রথম কাব্যময়তার স্পর্শ পাওয়া যায় যে চলচ্চিত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার নাম পোয়েটিক রিয়ালিজম বা কাব্য বাস্তবতা। চলচ্চিত্রে পোয়েটিক রিয়ালিজম বিপ্লবের সূচনা ঘটে ফ্রান্সে, ত্রিশ দশকের শেষভাগে। এই মুভমেন্ট স্থায়ী ছিলো পুরো চল্লিশের দশক (১৯৩০-১৯৪০)। যদিও এর আগে ফরাসি ইম্প্রেশানিস্ট চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেও কবিতা ও সিনেমার সম্পর্কের ব্যাপারে সচতেনতা ছিল। সোভিয়েত মন্তাজ বা ফ্রেঞ্চ ইম্প্রেশানিজম এর মত চলচ্চিত্রের এই মুভমেন্ট খুব বেশি দিন যেমন স্থায়ী ছিলনা তেমনি ছিলনা ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী কোন বিপ্লব। তৎকালীন ফ্রান্সে সামাজিক জটিল পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত হতাশাকে কাব্যময়তা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার একটা চেষ্টা ছিল এই মুভমেন্টের ফিল্মকোরদের মধ্যে। কাব্যময়তা বলতে সমাজের প্রাকৃতজনের কঠিন জীবনের গল্পগাঁথার পাশাপাশি ক্যামেরার মুভমেন্টের সঙ্গে চরিত্রগুলোর চলাফেরার ছন্দ, নিখুঁত ও দৃষ্টিনন্দন সেট তৈরিতে নৈপূণ্য, আলোর ব্যবহার ও পরিকল্পনা, পোশাক পরিকল্পনা ইত্যাদি ব্যবহারের বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের ব্যাপারগুলোই ছিল লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ সিনেমার প্রত্যেকটি বিভাগে এমনভাবে সৃষ্টি করা হবে যেমন ভাবে কবিতায় অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রতিটি শব্দ ব্যবহার করা হয়।
পোয়েটিক রিয়ালিজম এর চলচ্চিত্রগুলো ‘রিক্রিয়েটেড রিয়ালিজম’ হিসেবে গন্য করা হয়। বিশেষ একটি রীতি অনুসরণ করে যা সামাজিক বাস্তবতার প্রামাণ্যের দিকে অগ্রসর হয়না তবে অবশ্যই মৌলিক এবং যার গন্ডি স্টুডিওতে সীমাবদ্ধ । পোয়েটিক রিয়ালিজম যুগের ছবির চরিত্রগুলোতে ফ্যাটালিস্টিক ভিউ বা জীবনের নিয়তিবাদ বা অদৃষ্টে বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গি মূর্তমান হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলোকে দেখা যায় সমাজের খুব নিম্নশ্রেনীতে বসবাস করতে যাদের বেশিরভাগই হয় বেকার অথবা অপরাধী। হতাশাজনক জীবনের একটি অধ্যায় পার করার পর তারা সচারচর একটি সুযোগ পেয়ে থাকে যা তাদেরকে ভালোবাসার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়। আর চলচ্চিত্রটি শেষ হয় মোহমুক্তির অবসান ঘটিয়ে অথবা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। প্রকৃত অর্থে স্মৃতিকাতরতা আর জীবনের তিক্ত ও কষ্টকর অভিজ্ঞতাই এ ধারার চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। আর কাব্যিক বা পোয়েটিক বলার কারণ নান্দনিক উপস্থাপনার জন্য। এই মুভমেন্টটির স্থায়ীত্ব বেশিদিন না হলেও পরবর্তী চলচ্চিত্র বিপ্লগুলোকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করেছে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতালির নিওরিয়ালিজম এবং ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ। অনেক নিওরিয়ালিস্ট নির্মাতা তাদের ক্যারিয়ার শুরুর আগে পোয়েটিকে রিয়ালিস্টদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে একজনের নাম না বললেই নয়। লুচিনো ভিসকন্টি। এই ইতালীয় ফিল্মমেকার ১৯৬৩ সালে ‘দি লেপার্ড’ ছবির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম জিতেন এবং ১৯৬৫ সালে ‘সান্ড্রা’ ছবির জন্য ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন ছিনিয়ে নেন । এছাড়া প্রখ্যাত ফরাসী ফিল্মমেকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (দি ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ, দি ম্যান হু লাভড্ উইমেন, দ্য উইমেন নেক্সট ডোর) পোয়েটিক রিয়ালিজমের অনুরক্ত ছিলেন। তবে চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদের মতে, পোয়েটিক রিয়ালিজম সিনেমার নিজস্ব ভাষা সন্ধানে পথ দেখালেও, সোভিয়েত মন্তাজ আন্দোলন ও ইতালির নিওরিয়ালিজম আন্দোলন সিনেমাকে যতটা ভাষার নিজস্বতা দিতে সক্ষম হয়েছিল, পোয়েটিক রিয়ালিজম তা পারেনি।
জাঁ রেনোয়াঁ, মার্সেল কার্নে, জুলিয়েন ডুভিভিয়ের ও জাঁ গ্রেমিলন
চলচ্চিত্রের এই মুভমেন্টের কান্ডারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় জাঁ রেনোয়াঁ, মার্সেল কার্নে, জুলিয়েন ডুভিভিয়ের, জাঁ ভিগো, জাঁ গ্রেমিলন, জ্যাকুয়েস ফেইডার, আলেক্সান্দ্রে ত্রুনা প্রমুখ কিছুসংখ্যক চলচ্চিত্রকরকে । আর এই সময়ের আলোচিত অভিনয়শিল্পীরা হলেন- জাঁ গাবিন, মাইকেল সিমন, সিমোনে সিগনোরেট ও মাইকেল মরগ্যান। পোয়েটিক রিয়ালিজম বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হচ্ছে- চিলড্রেন অফ প্যারাডাইস, গ্র্যান্ড ইল্যুশন, দি লোয়ার ডেপথস, পোর্ট অফ শ্যাডোজ, দি রুলস অফ দ্য গেম প্রভৃতি।
___________________________________________________
*দেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ অনলাইন সিনে ম্যাগাজিন 'মুখ ও মুখোশ' এর সেপ্টেম্বর সংখ্যা (ভলিউম ২) এ প্রকাশিত
*তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট অবলম্বনে
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫৫