....I have been working among the refugees for five or six months. I have seen these children, and the adults, dying. That is why I can assure the world how grave the situation is and how urgently it must help.
The appeal is to the world-and the world must answer.
.....আমি ৫-৬ মাস ধরে শরণার্থীদের মধ্যে কাজ করেছি। আমি এসব শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মরতে দেখেছি। সে কারণেই আমি পৃথিবীকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই পরিস্থিতিটি কত ভয়াবহ এবং কত জরুরী ভিত্তিতে সাহায্য দরকার।
আমার এ আবেদন সারা পৃথিবীর কাছে এবং পৃথিবীকে অবশ্যই সাড়া দিতে হবে।
মাদার তেরেসা
.....আমি একটি তুরুণীর ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করা দেখেছিলাম। তাঁর দুই চোখ আমাকে থমকে দেয়। চোখজোড়া আমাকেই অভিযুক্ত করছিল। ‘তোমার কিচ্ছু এসে যায়না, তাইনা?’ এই কথা চোখ ঠিকরে বের হচ্ছিলো। হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত তার হাতে তুলে নিলাম। আমি তাকে বলতে চাইলাম যে আমাদের অবশ্যই কিছু এসে যায়- আমাদের সবার, আমরা যারা বাইরের বিশ্বের। কথাটা বলার জন্য আমি মুখ খুললাম। কিন্তু বলতে পারিনি। অসত্য কিছু আমি তাকে বলতে পারিনি।
অ্যালান হার্ট
বিসিসি প্যানোরমা
১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা অক্সফামের মাধ্যমে বিশ্বের ৬০ জন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব একযোগে একটি আবেদন রেখেছিলেন বিশ্বের দরবারে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস, ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস, লেখক ও সাংবাদিক জন পিলজারসহ আরও অনেকে। এ আবেদন এমন এক সময়ে করা হয়, যখন একাত্তরের গণহত্যা সমানতালে চলছে, প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে। আবেদনকারী ব্যক্তিরা উদ্বাস্তু শিবির এবং যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চল সফর করে নিজ চোখে দেখে এসেছেন পাকিস্তানি বর্বরতার চিহ্ন—অগ্নিদগ্ধ গ্রাম, মানুষের লাশ, ক্ষুধার্ত হাড্ডিসার মানুষের আহাজারি, ম্যানহোলের পাইপে আশ্রয় নেওয়া অসহায় দম্পতি ও ক্রন্দনরত শিশু-কিশোর। তাঁরা আবেদন করেছিলেন, বন্ধ হোক এই গণহত্যা। রাজনীতির কূটকাচালি বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে অবিলম্বে এদের সর্বাত্মক সাহায্য চাই—এ দাবি তাঁরা তুলেছিলেন। যারা এ গণহত্যার জন্য দায়ী, তাদের বিচার হোক—প্রকারান্তরে সে দাবিও তাঁরা তুলেছিলেন।
যেভাবে টেস্টিমনি অব সিক্সটির সৃষ্টি
টেস্টিমনি অব সিক্সটির নেপথ্যে যে ব্যক্তিটি ছিলেন তাঁর নাম জুলিয়ান ফ্রান্সিস। অক্সফামের তৎকালীন সংগঠক জুলিয়ান ফ্রান্সিস জবনীতে শোনা যাক-
‘একাত্তরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের সাহায্যে আমরা এগিয়ে এসেছিলাম। আমরা তখনো জানতাম না, এই সংকট কত দিন চলবে এবং আদৌ এই সংকটের কোনো রাজনৈতিক সমাধান হবে কি না। অক্সফাম তখন প্রায় পাঁচ লাখ উদ্বাস্তুর জন্য কাজ করে চলেছিল। আমি এক মাস আগে থেকেই পরবর্তী মাসের জন্য পরিকল্পনা করে রাখছিলাম। জানা ছিল, সামনে আসছে শীত, তখন সীমান্ত এলাকার কিছু কিছু স্থানে সংকটটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। আরও অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল তখন। কোনো মানবিক সংকটের খবর যখন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় চলে আসে, তখন মানুষের কাছ থেকেই টাকা তুলে অক্সফাম হতবিল গঠন করতে পারে, কিন্তু সংকটটি কত দিন চলবে, সে সম্পর্কে যদি কোনো ধারণাই না থাকে, তাহলে মানুষকে সে বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা খুবই কঠিন।’
এরই ফলশ্রুতিতে টেস্টিমনি অব সিক্সটির ভাবনা তাঁদের মাথায় আসে। যাঁরা সরাসরি এই হূদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছেন, তাঁদেরই যুক্ত করা হলো এই প্রচারণায়। জুলিয়ান নিজেই উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁদের সাক্ষ্য নিয়েছেন কলকাতা থেকে। অক্সফামের প্রধান কার্যালয় যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে এডোয়ার্ড কেনেডিসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এখানে বসেই সুবিখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজারসহ অনেকের লেখা নেওয়া হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনেই সংকলনটি প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের কাছেও এই দিনেই তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
বলার অবকাশ রাখে না, বাংলাদেশের পক্ষে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে সংকলনটি রেখেছিল বিশেষ সহায়ক ভূমিকা।
৩৮ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর প্রথম আলোরর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় টেস্টিমনি অব সিক্সটি-র হুবুহু বাংলা প্রতিলিপি ষাটজনের সাক্ষ্য।
একজন জুলিয়ান ফ্রান্সিসের সংগ্রাম
১৯৬৮ সালে অক্সফামের হয়ে গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে জুলিয়ান আসেন ভারতের বিহারে। এর মধ্যেই এল ১৯৭১। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্তের ওপারে ছুটল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। সম্পন্ন গেরস্থ থেকে রাতারাতি অগণন মানুষের নাম লেখা হয়ে গেল শরণার্থীদের খাতায়। সক্রিয় হয়ে উঠল যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অক্সফাম। শরণার্থী ত্রাণ কার্যক্রমের দায়িত্ব নিয়ে জুলিয়ান ফ্রান্সিস এলেন কলকাতায়।
ব্রিটেনের অক্সফাম সদর দপ্তর থেকে জানতে চাওয়া হলো, শরণার্থীরা সংখ্যায় কত হতে পারে? জুলিয়ান হিসাব-নিকাশ করে জানালেন, প্রতিদিনে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পাড়ি দিচ্ছে সীমান্ত। সংখ্যাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না অক্সফাম সদর দপ্তরের কাছে। তারা ভাবল, ভারতে খুব গরম পড়েছে। গরমে নিশ্চয়ই মাথা-টাথা একদম গেছে জুলিয়ানের। ভুল করে ও নির্ঘাত কটা শূন্য বেশি বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জুলিয়ানের হিসাবটা মোটেও মিথ্যা ছিল না। দিনে দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠছিল শরণার্থীদের স্রোত। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, বনগাঁওয়ের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে শরণার্থী শিবিরে হানা দিল কলেরা আর ডায়রিয়া। মরতে শুরু করল মানুষ। জুলিয়ান ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাজে। জলপাইগুড়ির একটা শরণার্থী শিবিরের কথা জুলিয়ানের পরিষ্কার মনে আছে এখনো। সেই শরণার্থী শিবিরে সে দিন জমা হয়েছে ২০টি লাশ। একসঙ্গে এত লাশ দেখে দিশেহারা ক্যাম্পের পরিচালক। লাশগুলো সৎকারের ব্যবস্থা করবে এমন একটা সোমত্ত লোকও আর অবশিষ্ট নেই ক্যাম্পে। সেনাবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের লোকজন তখনো আসেনি। জুলিয়ান দেরি করলেন না। নিজেই নেমে গেলেন কবর খোঁড়ার কাজে।
১৯৭১ সালের জুন মাসের ঘটনা। শরণার্থীদের জন্য আসা ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করতে জুলিয়ান গেছেন দমদম বিমানবন্দরে। কিন্তু দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তা কিছুতেই শুল্ক ছাড়া এসব মালপত্র ছাড়তে রাজি নন। জুলিয়ান তাকে সোজা কথায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন ত্রাণসামগ্রী সবসময় শুল্কমুক্ত হয়, এটাই নিয়ম। কিন্তু ওদের সাফ কথা—এই ত্রাণসামগ্রীর ব্যাপারে ওপর মহল থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি তারা। পাক্কা ছয় ঘণ্টা দেন-দরবার করে হয়রান হলেন জুলিয়ান। চটেমটে আগুন হয়ে পায়চারি করছেন। এর মধ্যেই কেউ একজন এসে হাত ধরল তাঁর। এবার চমকে ওঠার পালা জুলিয়ানের। এ যে মাদার তেরেসা স্বয়ং। ‘জুলিয়ান আমাদের এখন প্রার্থনা করতে হবে। যেন উনাদেরকে ইশ্বর সুমতি দেন।’ বললেন মাদার। তারপর মাদার তেরেসা জুলিয়ানকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর অব কাস্টমসের কাছে। মাদার তেরেসাকে চিনতে পেরে নড়েচড়ে বসলেন কাস্টমস কর্মকর্তা। ত্রাণসামগ্রী পেতে সেবার আর বিলম্ব হলো না মোটেই। সে সময়টায় জুলিয়ান আর মাদার কাজ করেছেন এক অর্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ‘মাদার তেরেসা প্রতিদিন সকালে ফোন করতেন আমাকে। প্রতিদিন ঠিক সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে। ফোন করে তিনি কখনো হ্যালো বা গুডমর্নিং বলতেন না। বলতেন, গড ব্লেস ইউ জুলিয়ান।’
দেশ স্বাধীনের পর জুলিয়ান ফ্রান্সিস ঘুরে ফিরে রয়ে গেছেন বাংলাদেশেই। তিনি এখন ডিএফআইডির অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশ সরকারের চরাঞ্চলের জীবিকা কর্মসূচির প্রকল্প এবং বাস্তবায়ন বিষয়ক উপদেষ্টা । এ মহৎ হুদয় মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র:
১, টেস্টিমনি অব সিক্সটি
২. দৈনিক প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে
৩. দি ডেইল স্টার
৪. অন্যান্য ওয়েবসাইট
মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশীদের অবদান নিয়ে আরো পোস্ট
তাঁদের জন্য ভালোবাসা
মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশী বন্ধুদের তিনটি অজানা গল্প শুনুন
মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশী সাহিত্যিকদের অবদান