আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম । তেতাল্লিশের মন্বন্তরে জন্ম নেওয়া এ শিল্পীর লেখায় ক্ষুধা-দারিদ্র-সংগ্রাম উঠে আসাটাই ছিলো স্বাভাবিক। তাঁর লেখায় ছিলো গভীর জীবনবোধ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও ক্ষুরধার হিউমার। ক্ষুধায় কাতর রুগ্ন মানুষের বমি আর দুধভাতকে পাশাপাশি রেখে তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ধনী-গরীবের ভেদাভেদ। তাঁর লেখা তাঁর মত করেই বলতে গেলে ঠিক যেনো আমাদের মস্তিস্কের কোটরে গিয়ে হাতুড়িপেটা করে। জীবনমুখী আবেদন, চরিত্র সৃষ্টিতে মুন্সীয়ানা ও আঞ্চলিক সংলাপের যথার্থ প্রয়োগ তাঁর লেখনীর উল্লেখযোগ্য দিক। ইলিয়াসের হাতের ছোঁয়ায় খিস্তি-খেউড়ও লাভ করতো শৈল্পিক রূপ।
জীবনভর লেখার জন্য হাপিত্যেশ করেননি, বরং লেখাই তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরেছে। বণিকবুদ্ধির কাছে এক মূহুর্তের জন্যও বিকিয়ে দেননি তাঁর শিল্পসত্তা। তাই ইলিয়াসের সাহিত্য জীবন ২টি উপন্যাস, ৫টি গল্পগ্রন্থ ও ১টি প্রবন্ধ সংকলন ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার সংকলনে এসে থেমে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সাহিত্যভান্ডারে তিনি হীরার খনি যার প্রতিটি লেখাই কালের বাজারে হীরার চেয়েও মূল্যবান।
নিজের সম্পর্কে ইলিয়াস বলতেন যে তিনি চব্বিশ ঘন্টার লেখক। তিনি বেঁচেছেন, পথ চলেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এই লেখকের চোখ নিয়ে। জীবনকে তিনি দেখেছেন একজন লেখকের চোখে, তাঁর সমগ্রতায়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস । ডাকনাম মঞ্জু। জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, তৎকালীন রংপুর ও বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে। পৈত্রিক নিবাস ছিলো বগুড়ায়। পিতা বি এম ইলিয়াস ছিলেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি হাই স্কুলের হেডমাস্টার ও তৎকালীন বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক। মাতা মরিয়ম ইলিয়াস। ইলিয়াস ছিলেন তাঁর ভাইদের মধ্যে সবার বড়।
১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন বগুড়া জেলা স্কুল থেকে। এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে এম এ পাশ করেন ১৯৬৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ।
ইলিয়াস জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে । কর্মজীবনে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও ঢাকার সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন । স্ত্রী সুরাইয়া তুতুল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আর তাঁর প্রধান অস্ত্র কলমের যুদ্ধ তো ছিলোই। তাঁর লেখা প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রতক্ষ্যভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও যোগ দেননি।
১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এছাড়া বিভিন্ন সময় ভূষিত হয়েছেন নানা পুরস্কারে।
সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিস সহ নানাবিধ রোগে। শেষ পর্যন্ত মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে মৃত্যুবরণ করেন এ বরেণ্য কথা সাহিত্যিক।
সাহিত্যকর্ম
উপন্যাস:
চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬), খোয়াবনামা (১৯৯৬)
প্রবন্ধ সংকলন:
সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু-২২টি প্রবন্ধ (১৯৯৭)
গ্রন্থটিতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ২১ টি প্রবন্ধ ও ১টি অপ্রকাশিত বক্তৃতা সংকলিত হয়েছে।
গল্পগ্রন্থ:
অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : নিরুদ্দেশ যাত্রা, উৎসব, প্রতিশোধ, যোগাযোগ, ফেরারী, অন্য ঘরে অন্য স্বর ।
খোঁয়ারি (১৯৮২)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : খোঁয়ারি, অসুখ-বিসুখ, তারা বিবির মরদ পোলা, পিতৃবিয়োগ।
দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : মিলির হাতে স্টেনগান, দুধভাতে উৎপাত, পায়ের নিচে জল, দখল।
দোজখের ওম (১৯৮৯)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : কীটনাশকের কীর্তি, যুগলবন্দি, অপঘাত, দোজখের ওম।
জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)
অন্তর্ভুক্ত গল্প : প্রেমের গপ্পো, ফোঁড়া, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, কান্না, রেইনকোট।
কিছু কথা:সম্প্রতি আমি মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর রচনাসমগ্র-১ (গল্পসমগ্র) পড়লাম। আমার মস্তিস্ক ও হৃদয় জুড়ে শুধুই মুগ্ধতা । তাঁর লেখাকে বিশ্লেষণ করার মত ধৃষ্টতা আর যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই ভাবলাম সংক্ষিপ্ত জীবনী আর সাহিত্যকর্ম তুলে ধরি। আর আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আবার পাড়ি জমালাম তাঁর লেখার জগতে। হাতে তুলে নিলাম রচনাসমগ্র-২।#
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৩