বছর ঘুরে ফিরে এলো মার্চ মাস। বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা ঘটে এ মার্চ মাসে। তাই এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে মার্চ মাস বিশেষ কিছু এবং অত্যন্ত আবেগের। স্মরণ করছি সেই সব শহীদকে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা।
আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ছিলেন ভিনদেশী কিছু মমতাময় মানুষ। আমরা কী ভুলতে পারি সেই ওডারল্যান্ডের কথা? অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হয়েও যিনি এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে পেয়েছিলেন বীর প্রতীক খেতাব।
সরাসরি যুদ্ধ, যুদ্ধের একমাত্র উপায় নয়। প্রমাণ করেছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর আর বাংলার বন্ধু স্যার জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের হতভাগ্য শরণার্থীদের সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে তাঁরা আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। সেদিন এরিক ক্ল্যাপটন, রিংগোস্টার, লিওন রাসেল, বব ডিলান সহ বিশ্বের তাবৎ নামীদামী শিল্পীদের সংগীতের মাদকতায় ভেসেছিলো লাখ লাখ মানুষ। জোয়ান বায়েজ কনসার্টে আসতে না পারলেও লিখেছিলেন তাঁর অমর ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি।
বাংলার সংকট ও মরণোন্মুখ মানুষকে সহায়তা করার জন্য ‘অক্সফাম’ ষাটজনের সাক্ষ্য শীর্ষক একটি দলিল প্রকাশ করে। ষাটজন ভিনদেশী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, ত্রাণকর্মী, সংগঠক ও টিভি রিপোর্টারের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার সরেজমিন দলিল এ সাক্ষ্য।
যুদ্ধের সময় আমেরিকান কবি ‘অ্যালেন গিন্সবার্গ’ লিখেছিলেন September on Jessore Road কবিতাটি। যার আলোকে মৌসুমী ভৌমিক গেয়েছিলেন বিখ্যাত ‘যশোর রোড’ গানটি। স্মরণ করতে হয়, ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে এ দেশকে আপন করে নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল নিবেদিত প্রাণ সাংস্কৃতিক কর্মী শরনার্থী শিবির ও মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে, পুতুলনাচ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখতেন, শরনার্থীদের বুকে যোগাতেন সাহস। আর দু:সাহসী মার্কিন চিত্রপরিচালক লেয়ার লেভিন ক্যামেরা হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরেছেন " মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার" কর্মীদের সাথে সাথে, প্রায় ২০ ঘন্টার ভিডিও ধারণ করেছেন, সেলুলয়েডে লিখেছেন তাদের আরেক যুদ্ধের দিনলিপি। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরী করতে পারেননি। দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে এই ফুটেজ সংগ্রহ করে তৈরি করেন "মুক্তির গান" এবং "মুক্তির কথা"।
আমি যে ক্যাম্পাসের ছাত্র তার নাম চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। আমার ক্যাম্পাসেও রয়েছেন এমন একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি এহতাজ মিয়া। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন চুয়েটের কর্মচারী। এহতাজ মিয়ার কারনেই পাকিস্তানি হানাদাররা চুয়েট ক্যাম্পাসে বর্বরতা চালাতে পারেনি। পকিস্তানি হয়েও যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষকে তিনি আগলে রেখেছিলেন। যুদ্ধ শেষে রয়ে গিয়েছিলেন এ বাংলাতেই।
ভালোবাসা। এ ভালোবাসাই বুঝি পারে মানুষকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিভেদকে ভুলে কাছে নিয়ে আসতে। পৃথিবী জুড়ে আজ যুদ্ধ, ধ্বংস আর রক্তের খেলা। তারপরও ভালোবাসা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। যেসব ভিনদেশী মানুষ এ দেশের ক্রান্তিকালের সময় ভালোবাসা অর মমতা দেখিয়েছিলেন তাঁদের জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।#