প্রেক্ষাপট
১৯৯২ সালের কথা। তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। সে বছরই ২৬ মার্চ প্রথম গণ আদালতে বিচার হয় গোলাম আযমের। বিচারে শাস্তি হয় মৃত্যুদন্ড। এ রায় কার্যকর করার জন্য দাবী জানানো হয় সরকারকে। ক্ষমতাসীন বিএনপি উল্টো জাহানারা ইমামসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করে বসে। একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে রক্ষা করার জন্য সরকারের এই নোংরামীর প্রতিবাদ করেছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ১৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তার দেওয়া ভাষণে গণআদালতের নায্যতা এবং গোলাম আযমের দুষ্কৃতি তুলে ধরেছিলেন এখনকার প্রধানমন্ত্রী। সে ভাষণেই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ একটি অভিযোগ তুলেছিলেন শেখ হাসিনা।
ভাষণের সেই অংশটুকু

মাননীয় স্পিকার,এটা অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক বিষয় যে এতদিন পর আমাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে যে গোলাম আযম রাজাকার প্রধান ছিলেন কিনা? গোলাম আযম যে একজন হত্যাকারী ছিলেন, তার একটি প্রমাণ আমি এখানে দিচ্ছি। হোমনা থানার প্রতিনিধি নিশ্চয়ই এখানে আছেন। কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জনাব সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত পত্রের নির্দেশে হত্যা করা হয়। সিরু মিয়া দারোগা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিন থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রেনিং ও অপারেশন চালাতেন। '৭১এর ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা এবং তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামাল মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। সিরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধে অনেক দুঃসাহসিক কাজ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ করেছিলেন যে তিনি আমাদের প্রবাসী বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী বেগম তাজউদ্দিনকে সপরিবারে কুমিল্লা সীমান্ত পার করে পৌছে দিয়েছিলেন। সেই সিরু মিয়াকেও গোলাম আযমের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিলো। তার নজির ও প্রমাণ (একখানা কাগজ দেখিয়ে) এই কাগজে রয়েছে। আপনি চাইলে এই কাগজও আপনার কাছে দিতে পারি।
মাননীয় স্পিকার, আজকে আমরা আইন হাতড়ে বেড়াচ্ছি যে কোন আইনে তাকে বিচার করা যায়। এখানে বিএনপির ব্যারিস্টার সাহেবরা অনেক কথাই বলেছেন। আজকে আমার দলের পক্ষ থেকে আমরা Act XIX of 1973 (আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন ) উল্লেখ করেছি। এই এক্টের ধারা অনুযায়ী ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করা যেতে পারে বলে আমাদের সদস্যরা যে প্রস্তাব রেখেছেন, সরকার পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে নানা রকম অজুহাত দেখাচ্ছেন। গোলাম আযম একজন নরঘাতক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে যারা বিশ্বাস করে তাদের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমরা জানি, অন্তত এই বিষয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই।
কে এই সিরু মিয়া?

প্রধানমন্ত্রী তার পরিচয় খানিকটা দিয়েছেন। তার সঙ্গে আরেকটু যোগ করা যাক।২৫ মার্চের সেই কালরাতে সপরিবারে ঢাকাতে এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন এই সাব-ইন্সপেক্টর। নিজের চোখে দেখেছেন পাকবাহিনীর বর্বরতা। ২৭ মার্চ হোমনার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে ফেরেন সিরু মিয়া। সেখান থেকে মাধবদী বর্ডার ক্রস করে মুজিব নগর যান এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানান। এরপর শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়ার অন্য এক জীবন। রামকৃষ্ণপুর নিজের বাড়িতেই গড়ে তোলেন ট্রানজিট ক্যাম্প। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা তার বাড়িতে থাকতো, খেতো। সংখ্যাটা দেড়শো পার হয়েছে কোনো কোনো দিন। শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পরিবারই নন, মুজিব নগর সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সচিব এবং অনেক সেক্টর কমান্ডারের স্বজনদেরও নিরাপদে ভারতে পৌছে দিয়েছেন সিরু মিয়া। আর এসবে তার সঙ্গী ছিলো অষ্ঠম শ্রেনীর ছাত্র আনোয়ার কামাল। সিরু মিয়ার একমাত্র সন্তান। স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত ছিলো তার। তালেব আলী নামে একজন দালালের মধ্যস্থতায় রাজাকারদের টাকা দিয়ে সীমান্তের এপার-ওপার করতেন সিরু মিয়া সঙ্গীদের নিয়ে।
সিরু মিয়ার গ্রেপ্তার

১৭ অক্টোবর মুজিব নগর থেকে হোমনায় ফেরেন সিরু মিয়া। ২৫ অক্টোবর তার বাসাতেই একটি বৈঠকে বসে মুক্তিযোদ্ধারা। বাঞ্ছারামপুর, হোমনা, দাউদকান্দি ও নবীনগরের মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনী কমান্ডারদের সেই বৈঠকে সিরু মিয়া তাদের জন্য বরাদ্দ অস্ত্র ও গ্রেনেড দেন, পাশাপাশি নতুন চাহিদার তালিকা নেন। ২৬ তারিখ রাতে নৌকায় চড়ে ফের মুজিব নগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি। সঙ্গী হন কামাল, দাউদকান্দি থানার কমান্ডার নজরুল, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, হোমনা থানার কমান্ডার জাহাঙ্গীর সেলিম ও সফিউদ্দিন আহমদ। ২৭ অক্টোবর দুপুরে ছওরা গ্রামে পৌছান তারা। সিএন্ডবি রোডে দুতরা মাজার শরীফের কাছে রাজাকারদের চেকপোস্ট। তন্তুর চেকপোস্ট নামে পরিচিত এই স্থানে বরাবরের মতোই তালেব আলীর মাধ্যমে রাজাকারদের টাকা দেন তিনি। তালেব আলী চলে যাওয়ার পরপরই ২৭-২৮ জন রাজাকার বিশ্বাসঘাতকতা করে রাইফেল উচিয়ে ধরে। সঙ্গীদের সহ গ্রেপ্তার হয়ে যান সিরু মিয়া। প্রত্যেকের হাত বেধে চেকপোস্টের ছনের ঘরে ঢোকানো হয়। একটু পর একজন বাঙালী অফিসারের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে আসে, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এই ছয়জনকে। প্রচণ্ড অত্যাচারের মধ্যে কিশোর কামালকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয় করেছিলো সবাই। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীর সেই বাঙালী অফিসার তাদের অনুরোধ রাখেনি। উল্টো বলে : হারামীর জাত, বেঈমানের জাত, তোরা পাকিস্তানকে ইন্ডিয়ার কাছে বেচে দিতে চাস। তোদের বাচার আর পথ নেই।’
ব্রাক্ষণবাড়ীয়ায় সিরু মিয়া
বন্দীদের এরপর পিঠমোড়া করে বেধে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরে। সেখানে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে তাদের রাখা হয়। মাইকিং করে জনগনকে দেখানো হয় দেশদ্রোহীদের পরিণাম। রাতে তাদের অন্নদা স্কুলের সামনে রাজার মঞ্জিল (কালীবাড়ি) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় জেরা করতে। (মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অন্নদা স্কুলের উল্টো দিকেই থাকতাম আমরা। এখানে এই স্কুলেই ক্যাম্প করা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দেখি আমি।) পরদিন তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দানু মিয়ার বাড়িতে। এখানে ছিলো পাক আর্মির গোয়েন্দা দপ্তর। টানা আটদিন তাদের উপর চলে নির্যাতন। চাবুক মেরে, গরম লোহার শিকের ছ্যাকা দিয়ে নানা ভাবে অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় তাদের উপর। সেখান থেকে কুমিল্লা জেলে পাঠানো হয় বন্দীদের।
গোলাম আযমের চিঠি
২৯ অক্টোবর সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তার চাচা শ্বশুর আব্দুল মজিদ মিয়ার কাছে জানতে পারেন যে তার স্বামী-সন্তান ধরা পড়েছেন। নানা জায়গা ধর্না দিলেন তিনি তাদের জন্য। কিন্তু বৃথা যায় সব তদবীর। শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকাতে এলেন তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় মহসীনের কাছে। খিলগাও গভর্মেন্ট হাইস্কুলের এই শিক্ষক গোলাম আযমের দুই ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতেন। তার মাধ্যমেই গোলামকে ধরলেন আনোয়ারা। সব শুনে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান, শান্তি কমিটি ও রাজাকার-আলবদরদের কর্ণধার একটি চিঠি লিখলেন। খাম বন্ধ করে বললেন কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট রাজাকার কমান্ডারকে এই চিঠি দিলে সিরু মিয়াদের ছেড়ে দেয়া হবে। আনোয়ারার ভাই ফজলু মিয়া ১ নভেম্বর কুমিল্লায় গেলেন চিঠি নিয়ে। রাজাকার কমান্ডার চিঠি পড়ে বললেন ঈদের পরদিন কামালকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর সিরু মিয়াকে পুলিশে যোগদানের জন্য পাঠানো হবে। জেলখানায় ফজলুর সঙ্গে কামালের দেখা হয়। মামার সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে মাকে চিঠি লেখে কামাল : আম্মা সালাম নিবেন। আমরা জেলে আছি। জানি না কবে ছুটব। ভয় করবেন না। আমাদের উপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের জেলে অনেকদিন থাকতে হবে। ঈদ মোবারক। কামাল।
আরেকটি লিখে তার নানাকে।

২৩ নভেম্বর ঈদ। পরদিন কামালের ফেরার কথা। ফেরে না কামাল। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় তিতাসের পাড়ে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে গুলি করে মারা হয় সিরু মিয়া ও তার ছেলে কামালকে। ঈদের পরদিন ফজলু কামালকে আনতে যায় কুমিল্লা জেলখানায়। সেখানে তাকে সিরু মিয়া ও কামালের পরিধানের জামা-কাপড় তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। ঠিক এই নির্দেশই তার লেখা চিঠিতে দিয়েছিলেন গোলাম আযম। একজন মুক্তিযোদ্ধা কিশোরের আকুল মাকে স্বান্তনার নামে কি নির্মম রসিকতা। মহিলাকে তার স্বামী ও পুত্রের কাপড় ফেরত দেওয়া হোক!!!
প্রসঙ্গতই আরেকটি কাহিনী মনে পড়ে গেলো। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামও মার্চের সেই দিনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায়। তিনি ভারত যাওয়ার পর তার পরিবার ছিলো সেখানে, গোলাম আযম ছিলেন তার প্রতিবেশী। ২৫ মার্চের আগে গোলামের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছেন নজরুল। অথচ ২৭ মার্চ সেই বাড়িটি ঘেরাও করে মেশিনগানের গুলিবর্ষন করেছে পাকবাহিনী । বর্তমান মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম ও তার ভাইরা প্রাণে বেঁচে যান। গোলাম আযম এগিয়ে আসেননি তার বিপন্ন এই প্রতিবেশীদের বাচাতে। এই জানোয়ারটাকে নরপশুই বলে সবাই।
শেষ কথা
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যেসব তালিকা এদিক ওদিক হাওয়ায় ভাসছে তাতে গোলাম আযমের নামটা শোনা যাচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় বক্তৃতাকে আমলে নিলে এটাই বোঝা যায় যে গোলাম আযমের সেই চিঠি তার কাছে আছে। এত বড় অকাট্য প্রমাণ একজন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে, অথচ বিচারের তালিকায় যদি গোলাম আযমই না থাকে তাহলে সেই বিচারের মানে কি দাঁড়ায়! বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যদি আসামীদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা যায়, স্পেশাল ট্রাইবুনালেও সেই নিয়ম রাখা হোক। রেহাই দেওয়া যাবে না যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দুই আলবদর ঘাতক চৌধুরী মাঈনউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকেও।
কৃতজ্ঞতা : মুসা সাদিক, শাহরিয়ার কবির।