এই জীবন যেন এক বাঁক বদলের খেলা। আজকাল প্রায়ই আমার মনে হয় আমার এতটা বয়স পর্যন্ত বড় বেশি যেন ছুটেছি আমি। এই ছোটাটা ছিলো হয়ত আমার নিজের সাথে নিজেরই লড়াই। অলিখিত এক প্রতিযোগীতার খেলা। এই প্রতিযোগীতায় আমার নিজের প্রতিদ্বন্দী আসলে হয়ত ছিলাম আমি নিজেই। সে যাই হোক বলছিলাম জীবনের বাঁক বদলের কথা। আসলে শুধু আমিই না প্রতিটা মানুষই তার ইহজীবনে পেরিয়ে চলে নিত্য নতুন বাঁকের পর বাঁক। বক্র রেখায় চিত্রিত সেই বাঁকগুলি মানুষ তার বুদ্ধি, শক্তি ও প্রখর মনোবলে পার করে চলে একের পর এক।
অনেকগুলো দিন পর আজ নিজেকে বড্ড বেশি থিতু হয়ে পড়েছি বলে মনে হয়। তবুও আজীবন ছুটে চলা এই অক্লান্ত আমির নিজেকে বড় ক্লান্ত লাগে। এই ক্লান্তি অনেকটা রণে ক্ষ্যান্ত দেবার মত, অনেকটা ঠিক সেই শকুন্তলার পথ হারানো পথিকের মত কিংবা সেই ক্ষেপার মত যে আজীবন খুঁজে চলেছিলো অমূল্য সেই পরশ পাথর। পরশ পাথর! যার স্পর্শে লোহা হয় সোনা। ক্ষেপা খুঁজে ফেরে সেই পরশ পাথর। আমিও এক ক্ষেপা। আজীবন বুঝি খুঁজেই চললাম সেই অধরা পরশ পাথরটাকেই।
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
মাথায় বৃহৎ জটা ধূলায় কাদায় কটা,
মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
ওষ্ঠে অধরেতে চাপি অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
দুটো নেত্র সদা যেন নিশার খদ্যোত-হেন
উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।
নিজের মনেই বিড়বিড় করি আমি। সত্যিই মাঝে মাঝে মনে হয় কোন সে পরশ পাথরের পিছে ছুটেছিলাম আমি! ধরেই নিয়েছিলাম যে সেই পরশ পাথরের স্পর্শে আমার অপূর্ণ হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। আমি গাইবো হৃদয় খুলে, আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছো দান। তুমি জানো নাই তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমান।আচ্ছা, আমি কি আজও জানি জীবনের পূর্ণতা কোথায়? নিজেকেই প্রশ্ন করি। রুনা লায়লার সেই গানের মত জানতে ইচ্ছে করে সুখ তুমি কি বড় জানতে ইচ্ছে করে? সেলুলয়েডের ফিতের ফ্লাশব্যাকে দোলে পলেস্তারা খসা, রঙহীন চিলেকোঠার সেই এক কামরার ঘর, শেওলা ধরা কালচে সবুজ রেলিং ঘেরা সেই অপরূপ মায়াময় চালচুলোহীন বাড়িটি। নারকেল গাছের ঝিরিঝরি পাতার আলোক নক্সা যা সন্ধ্যায় আশে পাশের বাড়ির বৈদ্যুতিক বাল্বগুলো জ্বলে ওঠবার পর সে বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ঝলকাতো। আমার মুদ্রিত নেত্রে ঝলকায় সে সব চিত্রকল্প। বসে থাকি নিশ্চুপ একাকী দুপুরে, পড়ন্ত বিকেলে, বারান্দার কোনে নিঝুম সন্ধ্যায়। তেপান্তরের মাঠে বধু হে একা বসে থাকি।
আরবাজ বড় অদ্ভুৎ এক মানুষ! আমার জীবনে আরবাজ এসেছিলো হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে এক অমূল্য রতন হয়ে। চমকে দিয়েছিলো, থমকে দিয়েছিলো আমাকে। আমার সকল ভালোবাসায়, সকল আঘাত সকল আশায় সে ছিলো আমার সঙ্গে ছায়ার মত ছায়া সঙ্গী হয়ে। একরাশ ক্লান্তিতে ক্লান্ত আমি তখন জীবন যুদ্ধের এক অদম্য সৈনিক। আরবাজ আমার লড়াই এ সঙ্গী হয়েছিলো। অনেকটা পথ হেঁটে এসেও হাত ধরেছিলো সে আমার। আরবাজ যেন এক অকূল দরিয়ায় কূল হারানো নাবিকের আশার বাতিঘর। জীবনের এই বিশাল বাঁক বদলটাতেই বদলে দিয়েছিলো আমার আমিকে। নিজের কাছে নিজের চেনা এই চিরচেনা আমিকে।
জীবনটাও কম অদ্ভুৎ নয়। এই জীবন আর জীবননাট্যের ঘটনাবলী আর তার পাত্রপাত্রীগুলো খেলে চলেছে কোন অদৃশ্য আঙ্গুলের পাপেটিয়ারের সুতোর ডগায় পাপেট হয়ে? সত্যিই আজকাল বড় অবাক লাগে আমার! জানিনা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনের সে সব আজ কেনো এত মূল্যহীন লাগে? এই জীবন পথের বাঁক বদলের পথিক হয়ে দিশাহারা যেন আমি আজ। আরবাজকেও যেন প্রায়ই আমার দূর্ভেদ্য ঠেকে। সদা সৌম্য শান্ত ও বিচক্ষন আরবাজ তার বিচক্ষনতায় হয়ত নড়েনি একচুল তবে আমার সবকিছু কেনো আজ বড় এলোমেলো হয়ে যায়! খুব অস্থির এক হাহাকার ঘিরে থাকে আমাকে সর্বক্ষন।
আরবাজ প্রায়ই তার অফিসে নতুন যোগ দেওয়া একজন অফিসারের কথা বলে। তার বুদ্ধিমত্তা, যুক্তি তর্কের প্রশংসা করে। চিরকাল সুসংযত ও স্বল্পভাষী আরবাজকে আগে কখনও এমন কারো প্রশংসা করতে দেখিনি। তাতেও অবশ্য আমার তেমন কোনো মাথাব্যাথা থাকে না। আরবাজ তার মতন বলে যায় আমি হু হা করি। নিজের কাজ ও ঘরসংসার, নিজের সৌখিনতা আনন্দ নিয়ে থেকে যাই আমি। আজকাল আমাদের খানাপিনাতেও একটু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে জীবন যাত্রাতেও। আরবাজ স্মোকিং ছেড়েছে। সন্ধ্যার পর রোজ হাঁটতে যায় পার্কে। আমি অবশ্য এসবের ধার ধারিনা। পার্কে হাঁটার মত বোরিং কাজটা যে কেমনে করে মানুষ ভেবেই পাই না আমি। সে যাইহোক, এরই মাঝে একদিন হঠাৎ আরবাজ তার প্রিয় সেই অফিসের মানুষটিকে ইনভাইট করে বসলো।
আমি কিছুই বুঝলাম না কেনো আরবাজ পুরো অফিসের এতগুলো মানুষের মাঝে শুধুমাত্র এই লোককেই এত পক্ষপাতিত্ব করে যাচ্ছে। আরবাজ বললো, মেসে থাকে কি খায় না খায় এমন একজন জিনিয়াস ছেলে। আমার তো তাক লেগে যায়! জীবনকে কেউ এত অন্যভাবে দেখতে পায় জানাই ছিলো না আমার। আমি মুগ্ধ হয়ে যাই তার কর্মকান্ডে। এই মানুষটা একা একা থাকে। একটাবেলা আমাদের সাথে ডিনার করলে ভালো লাগবে আমার। জানো ইন্টারভিউ বোর্ডে সেই প্রথম দেখা থেকে আজ পর্যন্ত এই ছেলে আমার চোখে এক বিস্ময়!
আমি এও জানি আমি ছাড়াও সকলের কাছেই সে এক বিস্ময়রুপেই নিজেকে প্রমান করতে পারে।
ড্রইংরুমে প্রবেশ করে চমকে উঠলাম আমি! আমার নিজ হাতে সাজানো সুসজ্জিত আলো আধারের খেলায় ভেসে যাওয়া ড্রইংরুমের এক কোনে খুব আনমনে অবহেলে বসে আছে মানুষটি। যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক চেনা আমার। ঐ একই বসার ঢং, ঐ একই অবজ্ঞা অবহেলায় উদাসীনতায় উড়িয়ে দেওয়া চারপাশ, ঐ নিরুদ্বেগ চাহনী...... আমার মাথা ঝিমঝিম শুরু হলো। আমি সামান্য সৌজন্যটুকু দেখাতেও ভুলে গেলাম। আমার অমন ফ্যাকাশে চেহারা দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো আরবাজ কিন্তু শুভ্র ঠিক সেই স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকে অতি স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে জিগাসা করলো-
- কেমন আছো তুমি কবিতা?
শুভ্র তার চিরায়ত হাসি হাসি মুখে নির্বিকার চেয়ে রইলো আমার দিকে।
শুধু তার হৃদয়ের অন্তঃক্ষরণ কেউ জানলো না......আমি ছাড়া......
আমার ঘরের মলিন দীপালোকে জল দেখেছি যেন তোমার চোখে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১২:০১