আর্শীয়া যতই তার স্মৃতি এই পৃথিবীর সকলখান থেকে মুছে ফেলতে চাক না কেনো? আমি জানি আরবাজের জীবন থেকে তো নয়ই বরং আমার জীবন থেকেও কখনও তাকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে না এবং আমি তা চাইও না। আমি খুব ছোটবেলার স্মৃতিও মনে রাখতে পেরেছি। এত ছোটবেলার যে যারা শোনে তারা প্রায় সবাই অবাক হয়ে যায়। কিন্তু এটাই সত্য। সব সময় স্মৃতির চর্চা করেছি আমি। কিন্তু এই পার্থীব জগতের তুচ্ছ স্মৃতি নয়, আর্শীয়ার রেখে যাওয়া সব চেয়ে বড় দুটি জ্বাজল্যমান স্মৃতিই তার দু সন্তান। তাদের দেখে অবাক হই আমি। কখনও তারা মুখ ফুটেও মায়ের স্মৃতি নিয়ে হা হুতাশ করে না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে মায়ের কথা কি মনেই পড়ে না ওদের? ছোট থেকেই যেই মাকে নিয়ে হাহাকার ছিলো আমার। মায়ের স্নেহের জন্য সেই হাহাকার একটা সময় এক আশ্চর্য্য ইগোর সৃষ্টিও করেছে আমার মাঝে তা আমি জানি। কিন্তু ওরা কখনই মা নেই বা মা থাকলে এমন হত বা মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে এসব বলে না।
রবিঠাকুরের কবিতা "মাকে আমার পড়েনা মনে" এই কবিতাটি পড়েনি ওরা সে আমি জানি। তবে আমি নিজে খুব ছোট বেলায় ১১/১২ বছর বয়েসেই সেই কবিতা পড়ে কত যে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছি লুকিয়ে। তবুও একটা বারও মুখ ফুটে মায়ের কাছে আহলাদ আবদার করিনি। রবিঠাকুরের সেই কবিতা পড়ে কোনো এক হারিয়ে যাওয়া মায়ের জন্য চোখের জল ঝরতো আমার। যেই মা আমার চোখের সামনে থেকেও হারিয়ে গিয়েছিলো আমার শৈশবে দূর বহু দূরে। কোনো এক অজানা তারার দেশেই হয়তো। আমি আর সেই তারাকে খুঁজিনা। তবে রাতের আকাশ দেখা আমার পুরনো স্বভাব। আজও সেই অভ্যাসটা রয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই আমি রাতের আকাশে তাকিয়ে নতুন কোনো তারাকে খুঁজি। কোন তারাটা আর্শীয়া খুঁজে বেড়াই আমি। খুব বোকার মত শোনালেও ছোট থেকেই তো ওমনটাই শুনেছি আমি। মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়।
আমি জানি আমার এ ডায়েরি আমি যা লিখছি আমার দু একজন অন্ধ পাঠক যারা আমাকে ভীষন ভালোবাসে তারা আর্শীয়ার ব্যাপারটা বার বার আনাটা মোটেও পছন্দ করছে না। কিন্তু আমিও খুবই বেয়াড়া লেখক হয়েছি মনে হয়। আমার এই যা লিখতে চাই তা লিখবার ইচ্ছাটার ব্যাপারে আমি একেবারেই অপকট। যেমন এই এতগুলো দিন পর নতুন এক জীবনের অধ্যায় শুরু করার পিছে হয়তবা কিছু বিষয় কাজ করেছে আমার মাথায়। তার মাঝে আর্শীয়া একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। আর আছে তার অকালে মা হারা দুটি সন্তান। সে কথাগুলিই আমি লিখে যেতে চাই। তবে আসলে মনের কথা ভাষায় আনতে পারা বা লিখতে পারার মত এত শক্তিশালী লেখক এখনও হতে পারিনি বলে মাঝে মাঝেই আটকে যাই আমি।
যাই হোক এ বাড়িতে আসার পিছনে বা নতুন এক জীবন শুরু করার পিছে আরবাজের ব্যাপারটাও যে এখানে ছিলো না তা নয়। আরবাজের সাথে পরিচয় তো আমার আজকের নয়, বহু বছর ধরে সে আমার পাশে ছিলো এক প্রিয় বন্ধুর মত ছায়াসঙ্গী হয়ে। একমাত্র আরবাজকেই আমি দেখছি আবেগের সাথে চরম বাস্তবতা নিয়ে একই পথে চলতে জানা একজন মানুষ হিসেবে। আমি বড় বেশি আবেগী ছিলাম একটা সময়। তারও চাইতে বেশি জেদীও। আরবাজ আমার এই আবেগ এবং জেদকে জেনেও আমার পাশে থেকেছে জীবনের অনেকগুলো বছর বিশ্বস্ত বন্ধুর মত। আরবাজ ছাড়া আর কেউই হয়ত আমাকে কখনও বুঝতেই পারতো না এমন করে। তাই জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তাকেই বেছে নিলাম আমি হয়ত। এ ব্যপারে ফুপিও বেশ কিছুদিন যাবৎ গোয়ার্তুমী করে চলেছিলো। ফুপি চাইত আমার একটি নতুন জীবনের অধ্যায় দেখে যেতে। শান্তিতে নইলে চোখও বুজতে পারতেন না তিনি। এমনই তার বক্তব্য ছিলো আর কি। সেই মুহুর্তেই আর্শীয়া নামে এক অবাক বিস্ময় উপস্থিত হয়েছিলো আমার জীবনে।
হ্যাঁ আর্শীয়া এক বিস্ময় আমার কাছে কারণ সে এই জাগতিক জীবনের আমার দেখা মানুষগুলো থেকে বেশ খানিকটা আলাদা রকম। তার চাওয়া পাওয়া ভাবনা চিন্তার মাঝে চিরায়ত বাঙ্গালী রমনীর শেকল বাঁধা ভাবনাটাই নেই যেন। সে এক মুক্ত চিন্তার মানুষ। এবং খুবই ভালো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকারী একজন বুদ্ধিমতী নারী। এছাড়াও তার রেখে যাওয়া দু সন্তান তারা যেন আমারই ছেলেবেলাকার প্রতিচ্ছবি। আমার ছেলেবেলায় পাওয়া সেই অসহনীয় কষ্টগুলির মত একটুও কষ্ট যেন ছুঁতে না পায় ওদেরকে তাই ওদের সাথে আমার এ জীবনকে বেঁধে ফেলার ইচ্ছেটাই ছিলো আমার। এখন ওরা যে বয়সে আছে তাতে তারা নিজের মত চলতে পুরোপুরিই সক্ষম। তাদের খাইয়ে দেওয়া, গোসল করিয়ে দেওয়া বা এমন ধরনের কোনো পরিচর্যার দরকারই নেই আসলে। তারা সেসব করবার মত যথেষ্ঠ বড় হয়েছে। তাদের দরকার শুধু একটু গাইডেন্স, একটু মায়াময় পরিবেশ বা সবচাইতে বড় যে ব্যাপারটা সেটা তাদের একটি সুস্থ্য সুন্দর স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ। আমি যে কোনো কিছুতেই অংশগ্রহন করলে সফল হবার শেষ চেষ্টাটুকু করি তাই আমার ধারণা আমার এ চেষ্টাও বিফলে যাবেনা। সুন্দর একটা জীবন গড়ে উঠবে এ কটা প্রাণীর অন্তত আমারই কারণে।
মানুষ তার নিয়তির হাতে বন্দি। এ জগতে চাইলেই সব হয়না। অনেকেকই আসলে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে যেতে হয়। যারা বেঁচে থাকে তাদের প্রয়োজন শুধু মানিয়ে নেওয়া বা যাই সামনে আসুক ইতিবাচকভাবে গ্রহন করে নেওয়া। সেই ব্যাপারটা ছেলে দুটোর মাঝে খুব সুন্দরভাবেই প্রবেশ করানো হয়েছে। মা হবার কোনো দরকারই ছিলো না আমার আসলে ওদের জন্য। বরং আমি তাদের বন্ধু হয়েই থাকতে চাইলাম। আর একটা ব্যাপার আমি বাচ্চাদেরকে ভালোবাসি বটে খুব ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃ্দ্ধ পর্যন্ত কনভিন্স মানে বাংলাটা এই মূহুর্তে মনে পড়ছে না, বলতে চাইছিলাম সব বয়সী মানুষেরেই কনভিন্স করে নেবার ক্ষমতা আমার আছে। কাজেই আমার নিজের নতুন জীবনে এটাও ছিলো আমার নিজের সাথে নিজের এক চ্যালেঞ্জ বা মজার খেলা।
আমি জানি আমার হাতে বেশ কিছু অদৃশ্য যাদুর কাঁঠি আছে। সে কাঁঠিগুলি সযতনে লুকিয়ে রাখি আমি শুধু যখন যেটা দরকার হয় তখনই সেটা বুলিয়ে নেই চোখের সামনে দিয়ে। তো এই যাদুকাঁঠির স্পর্শে খুব শিঘ্রী আমি একদিন সকালে এ বাড়ির চিরায়ত নাস্তা বা ব্রেকফাস্টের ব্যপারটিকে মানে নাস্তার উপকরণ ও টেবিলটির ভোল পাল্টে দিয়ে ওদেরকে ডেকে উঠালাম। এই লকডাউনের সময়টাতে সবার ঘুমের রুটিন বদলে গিয়েছিলো আর তাই সাত সকালে ব্রেকফাস্ট বা নাস্তা করার ব্যপারটাই প্রায় ভুলতে বসেছিলো ওরা। কিন্তু আমার যাদুকাঁঠির স্পর্শে ভোল পালটে ফেলা ডাইনিং টেবিল আর সাজসজ্জা দেখে তারা তো থ! ওদের চোখে মুখে যে অবাক বিস্ময় দেখলাম তাতে মহানন্দ বা কৌতুকে প্রাণ নেচে উঠলো আমার।
ছোটটা তো অবাক হয়ে বললো, তুমি তো বাড়িতেই রেস্টুরেন্ট বানিয়ে ফেলেছো। ওর প্রিয় বিফস্টেক আর ঠান্ডা ম্যাংগো মিল্ক শেক পেয়ে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। বড়টাও কালাভুনা দিয়ে ঘিয়ে ভাজা পরোটায় কামড় বসিয়ে তার কথার ঝাঁপি খুলে বসলো। প্রথম দিনটি থেকেই আমি খেয়াল করেছিলাম যার যার রুমে ব্রেকফাস্ট নাতো সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয়ে আসা সময়ে ব্রাণ্চ যেত ট্রে করে করে যার যার ঘরে সসেজ, বয়েল্ড এগ ইত্যাদি ইতাদি। এক সাথে ফ্যামিলীর সবাই মিলে যে খাবার আনন্দ তা মনে হয় গড়েই উঠেনি এ বাড়িতে। তারা খুব চুপচাপ বা স্বল্পভাষী স্বভাবের ছিলো। কিন্তু আজ এই আনন্দঘন পরিবেশে তারা খুলে বসলো তাদের কথার ঝাঁপি।
খাবার শেষে ওদের প্রিয় গিটারের টুংটাং ধ্বনীর মায়াময় সূরে মনে হলো হাওয়ায় ভেসে এলো আর্শীয়া। সবার অগোচরে আমার কানে কানে বলে গেলো অনেক অনেক ভালোবাসা আর ধন্যবাদ তোমাকে কঙ্কাবতী....... আমি আর্শীয়ার ফিসফিস কথাগুলো শুনতে পেলাম..... সবার অগোচরে কোনো অস্পস্ট ছায়াশরিরী হয়ে বসলো সে সুদীর্ঘ টেবিলটার কোনার চেয়ারটাতে..... আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে ফের মিলিয়ে গেলো হাওয়ায় ......
আমি ওদের গিটার টেনে নিয়ে আমার অপরিপক্ক হাতে সূর তুললাম, গাইলাম......
সে যে চলে গেলো বলে গেলো না ......
সে যে কোথায় গেলো ফিরে এলো না .....
তাই আপন মনে বসে আছি কুসুম বনেতে.........
আমার চোখের কোনে জল জমে উঠছিলো। কেনো তার কারণ জানিনা আমি .......
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ রাত ১:২৯