আর্শীয়া খুব ভালোভাবেই ব্রেইন ওয়াশ করিয়েছিলো ছেলে দুটিকে সে বুঝা যায় ওদের সকল কথাবার্তা, চলাফেরা বা লাইফ স্টাইলে। নাটক বা সিনেমায় আমরা যা দেখি তা আমাদের জীবনেরই প্রতিফলন। কিন্তু আমার জীবনের গল্পগুলি সব সময় যেন সব ক্ষেত্রে সে সবের সাথে মেলেনি। এর কারণ কি আমার নিজের মাঝেই কোনো অস্বাভাবিকতা নাকি একটু অন্যরকম করেই বিধাতা লিখেছেন আমার জীবন নাট্যটিকে? জানিনা আমি। ভেবেও পাইনা। মিলাতে পারিনা সে হিসেব নিকেশও ঠিকঠাক।
যতবড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই এ বাড়িতে আসি না কেনো আমার মাঝে একটা ভয় বা ভীতি সব সময় কাজ করেছিলো। সেই ভীতি বা ভয় চ্যালেঞ্জটার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো দুটি টিন এইজ মানুষ। এ যুগের ছেলেমেয়ে এবং এই ভয়ংকর বয়সটি সকল বিষয় ও আশেপাশের সকল মানুষকে সহজে মেনে নেয় না। তাদের সব কিছুই নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ও নিজেদের ম্যুডের উপরেই চলে। কাজেই এ বয়সী মানুষগুলিকে বুঝতে পারাটা বেশ দূর্বোধ্যও বটে। নিজের জীবনের পিছনের দিনগুলোতে তাকিয়ে আজ ভাবি। আমি নিজেও কি চিনতাম নিজেকে সে দিনগুলোতে?
আর্শীয়া তার চলে যাবার পর এই পৃথিবী থেকে ওর স্মৃতিটুকুও যে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো তা ওর সন্তান দুটিকে অকারণ কষ্ট থেকে মুক্তি দেবার চিন্তা থেকেই হয়ত। আমি অবাক হয়ে ভাবি আমরা সবাই নিজেদের স্মৃতি অন্যের মনে গেঁথে রাখবার জন্য কত কিছুই না করি। আমরা ভাবি আমি চলে গেলেও আমি যেন সকলের মনে থেকে যাই। আমরা এমন কিছু রেখে যেতে চাই প্রিয়জনদের জন্য যা থেকে তারা আমাদেরকে স্মরণ করবে, চিরজীবন মনে রাখবে। কিন্তু আর্শীয়া তা চায়নি।
আর্শীয়া এক অবাক মানুষ। কোনো কিছু দিয়েই মনে হয় না আমি তাকে কখনও বিচার করতে পারবো। এই নিজেকে মুছে দেবার প্রচেষ্টা থেকেই আর্শীয়ার বাড়িটি যা ওর ধর্নাঢ্য জীবনের অধিকারী বাবা একমাত্র মেয়েকে লিখে দিয়ে গিয়েছিলো। সেই বাড়িটি সে তার সন্তানদের জন্য না রেখে দাতব্য চিকিৎসালয়ের ইচ্ছা পোষন করে গেছে।
বিয়ের পর আমি উঠেছি আরবাজের একেবারেই আনকোরা নতুন বাড়িটিতে। এ বাড়িটির সবচেয়ে উপরের যে ফ্লোরটি খালি ছিলো সেখানেই উঠেছি আমরা। একেবারেই যেন আকাশের কাছাকাছি। সকল ধরাছোঁয়ার বাইরে। নতুন করে সাজিয়েছি সব কিছুই নিজের মত করে। এ ব্যাপারে আরবাজ ও তার দুই ছেলের সহযোগীতার কোনো অভাব ছিলো না। আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই একটা ব্যাপারে। মা হিসাবে কতখানি সফল ছিলো আর্শীয়া। এ যুগের ছেলেমেয়েদের যে সব বদ গুন থাকে সেসব একেবারেই যেন নেই ওদের মাঝে। এত ইতিবাচক মানসিকতার শিক্ষাটা মূলত ওরা ওদের মায়ের কাছেই পেয়েছে বোধ হয়। আর্শীয়া এক মা বটে।
আরবাজ নিজেও খুব বিচক্ষন বুদ্ধিমান ও সুন্দর মনের মানুষ সে তো বহু কাল ধরেই জানা আমার। তবুও যে দ্বিধা দ্বন্দ বা ভীতিটা ছিলো আমার এ বাড়িতে আসবার আগে তা খুব সহজে এবং দ্রুতই কেটে যেতে থাকে আমার এই মায়াময় নতুন বাড়িটিতে। আসলে আমার শৈশব কৈশোর বা জীবনের যে কোনো অধ্যাায়েই নতুন কিছু আবিষ্কার বা এক্সপেরিমেন্ট ছিলো যেন এক অনন্য বৈশিষ্ঠ। যে কোনো অসাধ্য বা দুঃসাধ্য জিনিসকে জয় করাটাই ছিলো আমার এক আজব নেশা। সেই কারনেই হয়ত এই সুকঠিন কাজটিকে আয়ত্বে আনতে মনপ্রাণ দিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম আমি।
আমাদের বিয়েতে কোনো বাহুল্য ছিলো না। আমি আজ ভাবি। বিয়ে নিয়ে যেই সাজসজ্জা বা নানা আচার অনুষ্ঠানের আজীবন লালিত স্বপ্ন থাকে মেয়েদের সে স্বপ্ন আমি কখনও আসলে দেখিওনি। কারো সাথে জীবন জড়াতে হবে এই ব্যপারটির উপরেই বিতৃষ্ণা জন্মেছিলো আমার। তাই এতগুলো দিন পরে এসে যে পরীক্ষার মাঝে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সেখানে সাজসজ্জা বা ঘটা করা ব্যাপারটার অস্তিত্ব ছিলো না। খুব সাধারণভাবে ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে হলো আমাদের। আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিও কম ছিলো। মাকে বলা হয়েছিলো। আমি ধরেই ছিলাম মা বুঝি আসবেন এবার অন্তত একবারের জন্য। না এসে পারবেন না কিছুতেই। কিন্তু ঐ যে আগেই বলেছি আমার জীবনে সবকিছুই উল্টো করে লেখা হয়েছে। তাই সবাই যা ভেবেছিলো না এসে পারবেন না সেটাই হলো মা আসলেন না এতগুলো দিন পরেও ইগো ধরে রেখেছেন তিনি। সকলেই তাই ভাবে ইগো। তবে আমি জানি মায়ের এই ইগোটা আসলে তার মানসিক অসুস্থতা। কেউ না জানুক আমি তা জানি।
আমার মা আসেনি বটে। তবে আমার মায়ের চাইতেও বেশি যিনি করলেন তিনি আর্শীয়ার মা। নিজের মা থেকে যা আমি পাইনি তা বুঝি বহু বছর পরে আমি তার কাছেই পেলাম। উনি অঝরে কাঁদছিলেন আমাকে জড়িয়ে। বললেন আমার এক মেয়ে হারিয়ে গেছে আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। ওর সন্তান দুটির মা। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো আমি তোমাকে নিয়ে মেয়ের দুঃখ ভুলে থাকবো মা। একজন মায়ের কাছে সন্তান হারানোর দুঃখ কি সে যার হারিয়েছে সেই জানে। উনি আত্মীয় স্বজনের খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে এমন কিছু বাকী রাখলেন না যা করা যেত। আমার নিজের মাও তা পারতো কিনা জানিনা আমি।
উনি বললেন দেখো মা,আসলেই নিয়তির লিখন খন্ডন করা যায় না। আমি জানি বহু বছর আগেই এই বাড়িতে আসার কথা ছিলো তোমার। কিন্তু নিয়তিতে যে এটাই লেখা ছিলো তাই আমার মেয়েকে আসতে হয়েছিলো মাঝে কয়েকটি বছর। আমার খুব খুব বিশ্বাস আমার বুদ্ধিমতী মেয়েটা কোনো ভুল করেনি।তোমার আর ওর নিজের সন্তানের জন্য সবচাইতে ভালোটুকুর ব্যবস্থাই করে গেছে সে। আমার তার উপরে বড় আস্থা ছিলো । আর আজ থেকে তুমি আমার আস্থার স্থল। যে কোনো প্রয়োজনে এই মা তোমার সাথে থাকবে।
আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি এই পরিনত বয়সে এসে নিজেই নিয়েছিলাম। তবুও যেন এ কটা দিন হতবিহ্বল ছিলাম। কিন্তু আজ উনার কথাগুলো শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ভেঙ্গে পড়লাম কান্নায় উনার বুকের মাঝে। আমি জানি এ কান্নায় মিশে আছে আমার আজীবনের অপ্রাপ্তি আমার নিজের মায়ের কাছে না পাওয়া ভালোবাসা। অনেক পেয়েছি জীবনে । নিজের যোগ্যতা দক্ষতা বা অপরিসীম জেদ বা চেষ্টায় জিনে নিয়েছি যা চেয়েছি তাই। তবুও কেন এই হাহাকার আমার!
বিয়ের নানারকম কর্মযজ্ঞ শেষ হতে হতে সন্ধ্যে গড়িয়েছিলো। বেশ রাত করেই এ বাড়িতে এসেছিলাম আমরা। আসলে আমার বাড়ি আর আরবাজের বাড়ির মাঝে দূরত্ব শুধুই ৫ মিনিটের আর তাই গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে আনলো আরবাজ। এমন কান্ড কখনও ঘটেছে কোনোখানে জানা নেই আমার। যার বিয়ে মানে বর সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আনে। আসলে আজকাল যা হয় ঢাক ঢোল বাজিয়ে ধুমধাম করে সেই বিয়ের সাথে এই বিয়ে মিলালে তো চলবে না। এই জীবননাট্যের সব পংক্তিই তো উলটো করে লেখা।
আর্শীয়ার মা ছেলে দুটিকে ঐ বাড়িতে আজ রাতে রেখে দেবার জন্য খুব জোরাজুরি করছিলো কিন্তু আমি রাজী হলাম না। এমনকি যখন গাড়িতে উঠছিলাম তখনও আরবাজের পাশে বসলাম না আমি।ওদের সাথে পিছের সিটেই উঠলাম। আর কি এক আশ্চর্য্যভাবে আমার মনে পড়ে গেলো আমার নিজের জীবনের ছেলেবেলায় ঘটা সেই দিনটির কথা। মায়ের বিয়ের সেই দিনটি। লাল চেলীর খসখস স্পর্শ আমাকে নিয়ে গেলো সেই ছেলেবেলার সেই দিনটিতে। নিজেকেই প্রশ্ন করি। কি করে দৃশ্যপট বদলে যায় তাইনা? অথবা জীবন নাট্যের ঘটনাবলী বার বার ফিরে ফিরে আসে মানুষের জীবনে। শুধু বদলে যায় পাত্র পাত্রীরা। সেদিন চলেছিলাম নতুন শাড়ী চোলির খসখসে স্পর্শের সাথে সাথে নতুন বাবার বাড়িতে। আর আজ দুটি কিশোর ছেলে তারাও চলেছে নতুন শাড়ির স্পর্শের সাথে নতুন মায়ের পাশে তাদের নিজেদের বাড়িতেই। না আমার গায়ে নতুন বা পুরোনো কোনোই খসখসে চোলি ছিলো না। ছিলো পেলব কোমল রেশম সুতোয় বোনা রেশম শাড়ী। ছেলেগুলো যদি কোনোদিন তাদের স্মৃতিতে এই দিনটি নিয়ে লেখে তো খসখসে কথাটার জায়গা হবে না এইখানে।হবে নরম কোমল মসৃন জমিনের রেশম এবং লাল নয় নীল রঙ্গের শাড়ি।
চলবে ...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৫