মায়ের ডায়েরীটি শুধুমাত্র প্রতিদিনের ব্যাক্তিগত দিনলিপিই নয়। এই ডায়েরীতে মা লিপিবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন তার নানা রকম প্রিয় এবং অপ্রিয় জাগতিক ও অজাগতিক বিষয়গুলিও। যেমন ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুদের নাম। কয়েক পাতা জুড়ে মা শুধু নাম কালেকশনই করেছেন। যেমন আরও কয়েক পাতায় উনি লিখে রেখেছেন উনার পড়া প্রিয় বইগুলির নাম। আমি খেয়াল করে দেখলাম ডায়েরীটা কয়েকভাগে বিভক্ত। নামের ভাগ, বই এর ভাগ, তার গহনার বিবরণী বা লিস্টির ভাগ, কিছু প্রিয় রেসিপি, কিছু নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি এবং সবশেষে ব্যাক্তিগত কথামালা। রোজ রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে আমি এই ডায়েরী নিয়ে বসি।
মায়ের ডায়েরীর প্রতি হঠাৎ আমার এত আগ্রহ জন্মাবার কারণই হয়ত মায়ের রহস্যময় মনোগজতের কিছু গলি ঘুপচির আভাস পাবার চেষ্টা। রহস্যময় মনোজগত বলেছি এই কারণেই যে আম্বিয়ার মা থেকে শুরু করে যে কেউই মাকে চিনেন এবং জানেন তারাই নিজের মেয়ের সাথে মায়ের এই অস্বাভাবিক দুরত্বের বা আচরণের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। আমিও ঠিক এই রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। আসলে সারাজীবন একই ছাদের নীচে থেকেও তাকে আমার সত্যিকারে জানা হয়নি অনেক খানিই। আর বুঝার প্রশ্ন তো অনেক দূরে। তাই আমি মায়ের ডায়েরীটির প্রতি এতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছি। এই আগ্রহের আরও একটা কারণ ছিলো বাবার অন্তর্ধানের যে ইতিহাস এতগুলো দিন পরে আমি সেদিন দাদুর মুখে শুনেছি সেই ইতিহাসের আরও কিছু খোলা জানালার আবিষ্কার করা যায় কিনা তারই ইচ্ছাটা। মা ডায়েরীতে নানা কথাই লিখেছেন, তার রাতে দেখা কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের কথা। তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা রাগ ক্ষোভ আর দূরাশার কথা। মায়ের দেখা স্বপ্নগুলোর বিবরণ বড় অদ্ভুৎ। প্রথমে তার দেখা স্বপ্নের যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তা আবোল তাবোল স্বপ্ন মনে হওয়ায় এড়িয়ে গেলেও হঠাৎ মনে খটকা লাগায় আমি ফের মন দিয়ে পড়তে শুরু করি। মা লিখেছেন-
----------------
কাল রাতে ফের সেই অদ্ভূত স্বপ্নটা দেখলাম। যে স্বপ্নটা আমি বার বার দেখি। একটি পুরোনো রাজবাড়ি। বাড়িটির এক বিশাল প্রশস্থ জলসাঘরে ঘুঙ্গুর পায়ে নেচে চলেছে একটি ছোট্ট মেয়ে। দেয়ালজোড়া বিশাল আয়নায় প্রতিবিম্বে মেয়েটির দুলে দুলে নেচে চলার দৃশ্যটি আমার বড় চেনা। তবে মেয়েটা কি ঐ রাজবাড়ির নর্তকী নাকি ঐ বাড়ির মেয়ে কিছু বুঝিনা আমি। স্বপ্নে মেয়েটার মুখ দেখা যায় না। পাতলা নেকাবে ঢাকা থাকে তার মুখ। নাচতে নাচতে মেয়েটা আমার দিকে এগুতে থাকে আর তখনই শুরু হয় আমার শ্বাসকষ্ট। কাল রাতেও একই ব্যাপার হলো। অনেক কষ্টে জেগে উঠি আমি। উঠে দেখি আমি দরদর ঘামছি। পানি খাই এক গ্লাস। আমার ধারণা আমি ঐ মেয়েটি । আমার জন্ম ঐ রাজবাড়িতেই। স্বপ্ন আমাকে বার বার আমার অতীত জনমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্বপ্নে আমি ফিরে ফিরে যাই আমার অতীত জনমের রাজ বাড়িটিতে। আচ্ছা আমার অতীত জনমের সেই রাজবাড়িটা কোথায় ছিলো। আমার নাম কি ছিলো সেই জগতে? রাজকুমারী কাঞ্চনমালা নাকি অন্য কিছু ......
------------------
কাল রাতে এক আশ্চর্য্য ঘটনা হলো। যদিও ঘটনাটি নতুন নয় তবে অবশ্যই অতিপ্রাকৃত তাতে আমার সন্দেহ নেই। এ কথা কাউকে বললেই হেসে উড়িয়ে দেবে বা আমাকে পাগল সাবাস্থ করতে উঠে পড়ে লাগবে। তাই কাউকে বলিনি। এই ঘটনার শুরু সেই ক্লাস নাইন থেকে। একদিন মাঘ মাসের শীতের রাত। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছি। ঘড়িতে ঢং ঢং ঠিক রাত দুটোর ঘন্টা দিলো। আমার চোখ খুলে গেলো আপনিতেই। রাত্রীতে আলো জ্বালিয়ে ঘুমানো আমার অভ্যাস। আলো নেভালেই আমার নিশ্বাস আটকে আসে,তাই আলোটা জ্বালিয়েই রাখি আমি। সেই ঝকঝকে আলোতে স্পষ্ট দেখলাম। হাসি হাসি মুখের এক যুবক আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে হিম হয়ে যাই। সম্পূর্ণ সন্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকি তার চোখের দিকে। সেই হাসি হাসি চেহারার যুবক তার স্মিত হাস্যের চোখের আলোয় আমাকে বিদ্ধ করে রাখে সন্মোহনের ঘোরে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এক ঝটকায় আমি উঠে বসি। অমনিতেই ভোঁজবাজীর মত সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ......কি ভয়ংকর কিছু মুহুর্ত! উফফ আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি...
-------------------
একি স্বপ্ন নাকি ঘোর নাকি সত্যিই ঘটে আমার সাথে? গভীর রাতে কিংবা ঝুম দুপুরে আমি ঠিক আমারই অবয়ব দেখতে পাই। হেঁটে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মাঝে, সারা বাড়িতে। আমি আতঙ্কে নীল হয়ে যাই। স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু আমার সেই অবয়বের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে । সে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না .......
----------------------------
মায়ের ডায়েরীতে ডুবে যাই আমি। বিস্ফারিত নয়নে গিলতে থাকি তার লেখা এই সব অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন বা অভিজ্ঞতার কথা। তার ডায়েরী থেকে বেছে বেছে স্বপ্নগুলোই পড়তে থাকি আমি। এরই সাথে স্বপ্ন নিয়ে আমি নানা রকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, আর্টিকেলও পড়তে শুরু করি। দুঃস্বপ্ন দেখার পেছনে রয়েছে যে সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও গবেষণালব্ধ কারণ সে সব পড়ে পড়ে আমার মাথা কাজ করে না আর। দুঃস্বপ্নগুলির পিছে রয়েছে চলমান জীবনের চাপ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবেরই প্রতিচ্ছবি হলো এমন সব দুঃস্বপ্ন। খুব জানতে ইচ্ছে করে মায়ের জীবনের কিসের এত উৎকন্ঠা ছিলো? জেনেছি বাহ্যিক চাপ বা নিজের কাছে নিজের প্রত্যাশা যখন অত্যধিক হয়ে যায় তখনই এই জাতীয় দুঃস্বপ্নের দেখা মেলে। এটা মূলত মনের ভেতরের না-বাচক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ। জীবনের নিরাপত্তাহীনতা অথবা উদ্বিগ্ন পরিস্থিতির কারণেই এমন দুঃস্বপ্ন এসে ধরা দেয়। এই রকম দুঃস্বপ্ন মূলত ব্যক্তিগত জীবনের কোনো দুর্বলতা থেকেই গড়ে উঠে। জীবনের কোনো বিষয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেও এমন স্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখতে পায় মানুষ। তবে কি মা কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন? এবং এই মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণ কি? তবে কারণ হিসাবে আমি মোটামুটি দাঁড়া করিয়ে ফেলি তারই ডায়েরীর প্রাপ্ত তথ্য থেকে পাওয়া কিছু কথামালা দিয়ে। মা লিখেছেন,
--------------------
ডঃ রঞ্জন বলেছিলেন আমার নাকি কোনো অতীত জনম নেই। এবং সেটা কারোরই নাকি থাকে না। এ কথা আমি আজও বিশ্বাস করিনি, করবোও না। এই সব অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলোতে ডাক্তারী ফলায় এই ডক্টরের কি সাধ্য তাতে? সে তো বিশ্বাসই করে না আমি যে সত্যিই জানি ঐ রাজবাড়িই আমার আসল বাড়ি। উনি বলেছিলেন এসব নাকি আমার ভ্রান্ত ধারণা। স্বপ্ন আমাকে নিয়ে যায় আমার অতীতে এই কথা আমি কি করে তাকে বুঝাবো? আর বুঝারই বা কি সাধ্য আছে তার? সে বলে, খুব অল্প বয়স থেকেই আমার রুপের প্রশংসাটাই নাকি নিজের সম্পর্কে আমাকে অতি বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাই নাকি আমি নিজেকে ভাবছি রাজকন্যা বা এমন কিছু অপার্থীব কেউ একজন...... এই ডক্টর আমাকে নিশ্চয়ই হিংসা করেছে নয়তো ও নিজেই কিছু জানে না....
-----------------------
মায়ের লেখা আরও সব নানা রকম অবাস্তব কল্পনার বর্ননাগুলি পড়ে আমি বেশ বুঝতে পারি। কিশোরীকাল থেকেই মায়ের এই অবাস্তব কল্পনার মাঝে বসবাসের শুরু তার ফলশ্রুতিতে এই সব দুঃস্বপ্নের সুত্রপাত। নিজেকে নিয়েই নিজের মাঝে মত্ত থাকার ফল। মায়ের ভাষ্যমতে বা মায়ের ডায়েরীর লেখাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় ডক্টর আসলে ঠিকই ধরেছেন, অসামান্য রুপের প্রশংসাই তাকে কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ করে তুলেছিলো। আমার এই সব ব্যাখ্যার পিছে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় মার লেখা আরও কিছু তথ্য থেকেই।
----------------------------
ইদানিং হঠাৎ নিজের অবয়ব নিজে দেখতে পাওয়ার সেই অসুখটা বেড়েছে আমার। অসুখ মানে ডঃ রঞ্জনের মতে, উনি যেটাকে আমার হেলুসিনেশন বলতেন। বিয়ের পরে এই হেলুসিনেশন বলতে গেলে প্রায় ছিলোই না । কিন্তু হঠাৎ সেদিন মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার বিছানার উপরেই বসে আছে সে। মানে আমার অবয়ব। আমাদের দুজনের মাঝখানে কে এই নারী? আমি চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থমকে গেলাম। অষুধগুলো কি আবার শুরু করতে হবে? আমি কি তবে ফের একটাবার ডঃ রঞ্জনের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট নেবো?
----------------------------
এরপর পরই মায়ের লেখা আরও কিছু তথ্য থেকে আমি পরিষ্কার হয়ে যাই আমার দেখা মায়ের ঐ অস্বাভাবিক ক্রোধ বা উন্মাদনার কারনগুলি। মা লিখেছেন,
জানতাম এমন কিছুই একটা ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে। যেদিন থেকে আবার আমার হেলুসিনেশনে ঐ ছায়ামূর্তী দেখতে পেলাম সেদিন থেকেই বুঝেছিলাম চরম কোনো পরিনতীর দিকেই যাচ্ছে আমার জীবন। যেদিন জানতে পেলাম ওর প্রাক্তনের কথা। যাকে ছাড়া নাকি তার জীবন বিবর্ণ। চরম হতাশা আর গ্লানিতে পাগল হয়ে গেলাম আমি? এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা আমার চাইতেও কোনো আকর্ষনীয়া নারী পৃথিবীতে থাকতে পারে যার আবেদন আমার চাইতেও বেশি। উফফ! কি করবো এখন আমি? আত্মহত্যা নাকি খুন? এখন তো আমি একাও নই। সাথে আমার সন্তান। এই অপমান আমি কি করে সহ্য করবো! এই অপমানের কি প্রতিশোধ নেবো আমি? আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে শেষ করে দেই নিজেকে অথবা ওদের পুরো পরিবার। সবচাইতে রাগ লাগে ওর বাবার উপরে। কোনো সাহসে উনি ঐ আবলুশ কাঁঠ ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে গেলেন? তাও আবার তার এই সম্পর্কের কথা গোপন করে। নাহ ছাড়বোনা আমি। কোনোদিন ক্ষমা করবো না ঐ বৃদ্ধকে। আমার এই পরিনতির জন্য একমাত্র দায়ী করে রাখবো আমি তাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিশ্বাসঘাতক....ছোটলোক...... এই ফ্যামিলীকে আমি শেষ করে দেবো.... কিন্তু কি করে? সত্যিই খুন চেপেছে আমার মাথায় .... সবকটাকে বিষ খাইয়ে মারবো আমি...কিন্তু আমার মেয়ে? এই মেয়েটাই আমার জীবনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে.... কোনো কূল কিনারা পাই না আমি... কি করবো ? কি করবো? হে খোদা আমাকে বলে দাও.. আমি এখন কি করবো?
বন্ধ করে ফেলি আমি ডায়েরীটা......চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি কিছুক্ষন। বাবার জন্য কষ্ট হয়। মায়ের জন্যও। কি নিষ্ঠুর আমাদের এই জীবন। কতগুলি আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ি আমরা আর তারপর পারিপার্শ্বিক জগতের কাছে নিয়ন্ত্রন হারাই। গভীর রাতে আমি চুপি চুপি উঠে আসি ছাঁদে। মেঘহীন তারাভরা ঝকঝকে আকাশ। পুবের হাওয়া বইছে......ঝকঝকে আলোয় পুরোনো বাড়ির এখানে ওখানে ছাল ওঠা ছাঁদটাও বড় মায়াময় দেখাচ্ছে। পৃথিবীতে এত মায়া, এত কষ্ট, এত পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশের মাঝেও প্রকৃতি বড় সুন্দর আর নির্লিপ্ত। আমার মন হু হু করে ওঠে। হঠাৎ নিজেকে এই বিশাল পৃথিবীতে বড় একা লাগে। আমার পাশে কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। তবুও কত মায়ায়, কত কান্নায়, কত হেলা ফেলায় জড়িয়ে আছি আমি এই নিষ্ঠুর এবং মায়াময় পৃথিবীতে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি জগতের এই মায়াজালে।
বাবাকে বড্ড মনে পড়ে আমার আজকাল। মায়ের ডায়েরীটা পড়ার পর থেকে তার জন্যও কষ্টটা কম নয় আমার। আমার অতি সুন্দরী মা হেরে গিয়েছিলেন। যার আত্মবিশ্বাসই ছিলো তার সৌন্দর্য্য সেই সৌন্দর্য্যের অবহেলা মানতে পারেননি তিনি যার ফলশ্রুতিতে প্রায় উন্মাদিনীতেই পরিনত হয়েছেন তিনি। বাবাই কি সুখী হয়েছেন? হয়তো বা হ্যাঁ, হয়তো না। তার কি একটাবারও মনে পড়ে না তার এই দুঃখী মেয়েটার কথা? এ প্রশ্নে নিজেকেই প্রশ্ন করি আমি। আচ্ছা আমি কি সত্যিই দুঃখী? কখনও নিজের কাছে এই প্রশ্নের উত্তরটা হ্যাঁ পাইনি।বরং মনে হয়েছে বিশ্ববিধাতা আমাকে যত না দুঃখ দিয়েছেন, দুঃখকে জয় করতে শিখিয়েছেন তারও চেয়ে অনেক বেশী। সংসারের এই জটিল চক্র বড় রহস্যময়, বড় অদ্ভুত। তবুও বড় মায়া, চারিদিকে অপার মায়ায় ভেসে থাকি আমরা। ভালোবাসি এই জগতকে।
দোলনকে মনে পড়ে, মনে পড়ে আরবাজকেও। আরও কত শত হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ ভেসে যায় মনের আয়নায়। আরবাজ বলে জীবন এক রেইল স্টেশনের মত। কত মানুষ ট্রেইনের অপেক্ষা করে, ট্রেইনে চেপে চলে যায়, আবার আরেক দল নতুন মানুষ ফিরে আসে। এই ক্ষুদ্র জীবনটাতেও কত শত মানুষের আনাগোনা। জীবনের চাকাও কখনও থেমে থাকে না, গড়িয়েই চলে। দোলনের সাথে আর কখনও হয়তো দেখাও হবেনা আমার। আমার কিশোরীকালের প্রেম, আমার অবাক ভালোবাসা, সেই স্মৃতিময় প্রেমের শুধু সুখ স্মৃতিটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই আমি বাকীটা জীবন। তবে আরবাজকে হয়তো একজন অতি অতি ভালো বন্ধু হিসাবে সারাজীবনই পাশে পাবো। আমি চাই আরবাজের একজন বিদুষী স্ত্রী হোক, সন্তান ও সংসারে আরবাজ পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক একদিন। ওর সুখী দাম্পত্য জীবন আমাকেও সুখী করবে এমনই আমার বিশ্বাস। আমাকে ভালোবেসে আরবাজের এই একা থাকার ডিসিশনটা আমি মানতে পারিনা। তাই মাঝে মাঝে এমনও ইচ্ছে হয় ওর সাথে ইচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলার। তবে এই ব্যাপারে আমি মনে হয় স্বার্থপর হয়ে গেছি। কেউ নেই আমার পাশে সুখে ও দুঃখে যার কাছে হাত বাড়ানো যায়। এই একমাত্র আরবাজই আমার এমন একজন বন্ধু যার কাছে অবলীলায় আমি ভাগাভাগি করে নিতে পারি আমার সকল কষ্ট ও সুখগুলোকে। তাই স্বার্থপরের মত ওর কষ্টকে আড়াল করে আমি হাসিমুখে ওর সাথে কাটিয়ে দেই দিনের পর দিন। বহু দূরে চলাচল তার তবুও মনের একেবারেই কাছটিতেই তার বসবাস....
শেষ অধ্যায়
ঝুমকী ফুপুর এখানে চলে আসার সাথে সাথেই হঠাৎ যেন জীবনের নাটকের সেকেন্ড সিন ড্রপ পর্দা নেমে এলো। শুরু হলো জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের বেসরকারী এই কোর্সটি ঝুমকী ফুপুর সাহায্যেই ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এইখানে ক্লাসগুলির সাথে সাথে প্রায়ই থাকে নানা অরফানেজ বা হসপিটাল বা নানা রকম বাড়তি সুবিধাযুক্ত স্কুল বা পার্ক পরিভ্রমনমূলক শিক্ষা। আমি আমার দেশের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে দেখে ভাবতেও পারিনি কোনোদিন এই উন্নত দেশগুলোতে এই সব শিশুরা যারা মা বাবা বা আত্মীয় পরিজনহীন তারাও এত সুখী থাকতে পারে। অবলীলায় নিজেদের ভেতরের মেধা বিকশিত করে তুলতে পারে কিছু হৃদয়বান মানুষের সাহ্চর্য্য ও সহযোগীতায়। বড় ভালো লাগে ওদের হাসিখুশি মুখগুলো দেখতে। ওদের সাথে খেলতে বা কথা বলতে। আমি আরও অবাক হয়েছি ওদের বয়সের তুলনায় জীবনবোধের মূল্যায়ন ও জ্ঞান দেখে।
এক কথায় ভালোই আছি আমি। নতুন পরিবেশ ও নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই নিজের কাছে। বাকী সময়টা এবং ছুটির দিনগুলো কাটে ঝুমকী ফুপুর সাথে গল্পে, কথায় বা শপিং মলগুলো ঘুরে ঘুরে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি ঝুমকীফুপুর মাঝে এই বয়সেও যে উচ্ছলতা ও আনন্দ ছড়িয়ে আছে তা হয়তো এই পৃথিবীর ৯০% মানুষের মাঝেই নেই। ছিপছিপে শরীরের এক মাথা কোঁকড়া চুলের ঝুমকিফুপুর উচ্ছলতায় হাসি আনন্দে দিনে দিনে আমি হয়ে উঠি রঙ্গীন বর্ণীল। নতুনভাবে উজ্জিবীত হয়ে উঠি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা নিয়ে। আমার দুঃখ কষ্ট ফেলে আসা অতীত ধীরে ধীরে বর্ণহীন হতে থাকে। ফুপু কেনো আজও চিরকুমারী এ কথাটিও আমাকে মাঝে মাঝেই ভাবায়। তবে তাকে জিজ্ঞাসা করে কোনো সদউত্তর পাইনি। বরং এ কথা জানতে চাইলেই সে চোখ রাঙ্গিয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বলে, চুপ, আর কখনও জানতে চাইবি না। সবাইকে সব কথা জানতে হয় না। আমি কি তোর থেকে জানতে চেয়েছি? তুই কেনো বিয়ে করলি না আরবাজকে?
সব প্রশ্ন বা রহস্যের আসলে উত্তর হয় না বা উত্তর জানতে নেই........
বহুদিন পর দাদুর মৃত্যুর খবর আসে। জানতে পাই দাদুর মৃত্যুর পর বাবা নাকি বাংলাদেশে এসেছিলেন দীদাকে নিয়ে যেতে। দীদা রাজী হননি। যে কটা দিন বেঁচে থাকবেন সে বাড়িতেই কাঁটিয়ে দেবেন এমনই তার ইচ্ছা। বাবা ফিরে গেছেন তার আপন ঠিকানায়। মা এখন অনেকটাই স্থির হয়েছেন এমনটাই আঁচ করি ঝুমকী ফুপুর সাথে কথা হয় যখন তার মায়ের। সবাই বেশ নিজ নিজ স্থানে নিজের মত করে ভালো মন্দ অথবা তাদের নিজেদের মতই আছে। আমিও ভালো আছি.......অতীতের স্মৃতিগুলি আমি একেবারেই ভাবি না আর .....অতীতের প্রায় সকলেই মনে হয় মনে রাখেনি আমাকেও.....
একদিন হঠাৎ আমার জন্মদিনে তীতলীর কার্ড আসে। কার্ডটা খুলে আমি অবাক হয়ে যাই। তীতলী লিখেছে .....
আপু,
তোমার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। বাকী জীবনটা অনেক অনেক আনন্দে থাকো তুমি এটাই আমার চাওয়া।
তবে একটা কথা আজ তোমাকে বলতে চাই, তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যাবার পরে আমি একা হয়ে গেছি। ভীষন একা.........মাঝে মাঝে তোমাকে ভীষণ মিস করি....
তীতলী
অনেক অনেক দিন অনেক অনেক অতীত ভুলে থাকবার পরেও তীতলীর এই ছোট্ট কথামালার কার্ডটি হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ বসে থাকি। হু হু কান্নায় ভেঙ্গে আসে বুক।তীতলীরও সেই বয়স হয়ত এখন যখন দুঃখকে জয় করা শিখতে হয় বড় কষ্টে, বড় সাধনায়। অনেকেই তা পারে না, তীতলী কি পারবে? না ওকে পারতেই হবে। আমি ওকে শিখিয়ে দেবো। দুঃখ কষ্ট দ্বিধা দ্বন্দ এ সকল আপেক্ষিক বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করে কিভাবে নিজের মত করে বাঁচতে হয় ওকে শিখিয়ে দেবো আমি। মনে মনে বলি,
" তীতলীমনি তুমি যত দূরেই আর যেখানেই থাকো। আমি আছি তোমার পাশে।" নিজের কাছে নিজের এই প্রতিশ্রুতি করি আমি। কিন্তু জানিনা কিভাবে বা কি করে এই প্রতিশ্রুতি রাখবো আমি। তবুও আমি জানি আমি পারবো......আমাকে সেটা করতেই হবে...এ পৃথিবীতে একটা মানুষের কাছেও হয়তো আমার আজও মূল্য আছে। সে তীতলী, আমার ছোট বোন। এই আশাটি আমাকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে আরও বহুদিন... মানুষ তো বাঁচে আশা নিয়েই...
পাদটিকাঃ
গল্পটি অতীত থেকে বলতে শুরু করা হয়েছিলো। অতীত থেকে বলা শুরু হলেও এটি একটি বহমান বা চলমান জীবনে গল্প। গল্পটির এই পর্যন্তই লেখিকার জানা আছে। এরপরে ভবিষ্যতে এ গল্পের নায়িকা বা অন্যান্য পাত্র পাত্রীর ভাগ্যে কি ঘটবে জানা নেই তার। যদি তেমনি বিশেষ কিছু ঘটে, দোলন, আরবাজ কিংবা অন্য কাউকেও সে জীবন সঙ্গী হিসাবে বাঁছাই করে তবে সেদিন কোনো নতুন গল্প লেখা হবে কিনা জানিনা। তবে ভবিষ্যতের সেই নতুন গল্প লেখা নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই তার। শুধু মনে হয় যদি এই নায়িকার জীবনটা রিওয়াইন্ড করে আবার তার ছেলেবেলায় ফিরিয়ে দেওয়া যেত সেখানে থাকতো তার অতি স্বাভাবিক একটি সুখী মায়াময় পরিবারের গল্প, একজন মমতাময়ী মা, স্নেহময়ী বাবা কিংবা ছোটবোন তিতলী। যাদের ভালোবাসায় একটি সুখী সমৃদ্ধ জীবন বয়ে যেত। দোলন কিংবা আরবাজ খানিক টানাপোড়েন হলেও যে কোনো একজনকে সঙ্গী করে নিয়ে সে শুরু করতো আর একটি নতুন জীবনের গল্প। তবে বেশ হত।
গল্পটি নিজের জন্য লিখে রেখে যাবার প্রেষনা থেকেই লিখতে শুরু করেছিলাম। এতগুলো দিন, এতগুলো পর্বের সাথে আমাকে যারা সঙ্গ দিয়েছেন, সহমর্মিতা ভালোবাসা আর অনুপ্রেরনায় ভাসিয়ে রেখেছেন তাদের সকলের প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৭