
তুতেনখামেন (Tutankhamun), সম্ভবত মিশরের সবচেয়ে আলোচিত ফারাওদের একজন। তুতেনখামেন জন্মেছিলেন প্রায় ৩৩০০ বছর আগে, ১৩৪১ খ্রীষ্ট-পূর্বে। তুতেনখামেনের বাবা ছিলেন আখেনাতেন (Akhenaten)। কিন্তু মা কে ছিলেন, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়ে গেছে। আখেনাতেন এর প্রধান স্ত্রী ছিলেন নেফারতিতি (Nefertiti), কিন্তু তিনি সম্ভবত তুতেনখামেন এর মা ছিলেন না। ধারণা করা হয়ে থাকে আখেনাতেন এর অন্য আরেক স্ত্রী কিয়া'র (Kiya) গর্ভে তুতেনখামেনের জন্ম হয়। আখেনাতেন এর রাজত্ব কালে মিশরের রাজধানী থিবেসের (বর্তমান লুক্সর) উত্তর প্রান্তে সরিয়ে নেয়া হয়। থিবেসের রাজ প্রাসাদেই তুতেনখামেন বেড়ে উঠেন। সে সময় তাকে যুদ্ধবিদ্যা- অস্ত্রচালনা-লেখপড়া সহ নানান দীক্ষায় দীক্ষিত করা হয়।
তার আসল নাম ছিলো তুতেনখাতেন (Tutankhaten), যার অর্থ হলো "আতেন এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি"। মিশরীয়রা দেবতা "আমেন"(Amun) এর উপাসক ছিলো, সেই সময় রীতি অনুযায়ী রাজ বংশের সদস্যদের নামের সাথে দেবতাদের নাম যুক্ত করার প্রচলন ছিলো। আখেনাতেন সিংহাসনে বসার পর "আমেন" এর পরিবর্তে "আতেন" (Aten) এর উপাসনা শুরু করেন। সে জন্য তার নাম রাখা হয় তুতেনখাতেন। কিন্তু তুতেনখামেন ক্ষমতায় বসে আবারও আমেন এর উপাসনা চালু করেন এবং তার নাম পাল্টে তুতেনখামেন বা "আমেন এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি" রাখেন।
নেফারতিতির কোন ছেলে না থাকায়, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর ১৩৩৩ খ্রীষ্ট-পূর্বে মাত্র ৯ বছর ব্য়সে সিংহাসনে বসেন তুতেনখামেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তার বোন, নেফারতিতি ও আখেনাতেনের মেয়ে আঁখসেনামুনকে (Ankhesenamun) বিয়ে করেন।এই বালক বয়সে তার পক্ষে রাজত্ব সামলানো সম্ভব ছিলো না। ধারণা করা হয় আই (Ay, সম্ভবত নেফারতিতির বাবা) এবং সেনা প্রধান হোমারহেব (Horemheb) তার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। সম্ভবত এই দু'জনের সিদ্ধান্তেই তুতেনখামেন আবারও আমেনের উপাসনা চালু করেন।
তিনি 18th Dynasty'র দ্বাদশ ফারাও ছিলেন, সেই সময়টা মিশরীয় ইতিহাসে নতুন রাজত্ব বা New Kingdom নামে পরিচিত। তার রাজত্বকাল ছিলো মাত্র নয় বছরের। সিংহাসনে আরোহনের নবম বছর, ১৩২৫ খ্রীষ্ট-পূর্বে (কারও কারও মতে ১৩২৩) আকস্মিকভাবে এই বালক ফারাও মৃত্যু বরণ করেন।
যথারীতি তার মৃত্যুর কারণ নিয়েও প্রচুর বিতর্ক আছে। অনেকেরই ধারনা তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। এক্ষেত্রে সন্দেহের আঙ্গুলটা তার দুই উপদেষ্টার দিকেই যায়। কারণ, তার কোন জীবিত উত্তরাধিকারী না থাকায় নতুন ফারাও নির্বাচনে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং এই সুযোগে আই, আঁখসেনামুনকে বিয়ে করে ক্ষমতা দখল করেন। এর কিছুদিন পর হোমারহেব আইকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই ফারাও হয়ে সিংহাসনে আরোহন করেন। তুতেনখামেনের রাজত্বকালের তেমন কোন নিদর্শন না পাওয়ার কারন হিসেবে ইতিহাসবিদরা হোমারহেবকে দায়ী করেন। তাদের ধারনা, হোমারহেব ক্ষমতায় এসে তুতেনখামেনে বানানো সব স্থাপনা নষ্ট করে ফেলেন।
তার মমির সিটি স্ক্যানে দেখা যায় যে মৃত্যুর আগে তার পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো আর ২০১০ সালে DNA অ্যানালাইসিসে শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া যায়। এখন ধারনা করা হচ্ছে, এই দুইয়ের সম্মিলিত আক্রমণেই তিনি মারা যান। আবার অনেকের মতে, ঘোড়ায় টানা রথের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।
২০০৫ এর জানুযারীতে, Egyptian Supreme Council of Antiquities তুতেনখামেনের মমি CAT স্ক্যান করার জন্য অল্প সময়ের জন্য সমাধি থেকে বাইরে নিয়ে আসে। স্ক্যানে তার মাথায় আঘাতের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি। স্ক্যানের ফলাফল অনুযায়ী তার গড়ন ছিলো মাঝারী এবং উচ্চতা ছিলো ১৬৮ সেন্টি মিটার বা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি।

তুতেনখামেনের সমাধি
১৯২২ এর নভেম্বরে হাওয়ার্ড কার্টার, ভ্যালি অফ দ্যা কিংস এ তুতেনখামেনের সমাধি খুঁজে পান। তবে তুতেনখামেনের সমাধি একজন ফারাও এর সমাধির তুলনায় অনেক সাদামাটা ছিলো। ধারনা করা হয়, তার আকস্মিক মৃত্যুর পর তাড়াহুড়া করে অন্য কারও জন্য বানানো কবরে তাকে সমাহিত করা হয়।
আর সব প্রাচীন সমাধির মতো এখানেও, সমাধির শান্তি বিনষ্টকারীদের জন্য বেশ কিছু অভিশাপ বার্তা পাওয়া যায়।যার মধ্যে একটি ছিলো অনেকটা এরকম:
"যারা এই পবিত্র সমাধিতে প্রবেশ করবে, মৃত্যু খুব দ্রুত তাদের গ্রাস করবে।"
হ্য়তো এই অভিশাপেই সমাধি আবিষ্কারের সাত সপ্তাহ পরে এই অভিযানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, লর্ড কারনাভন কায়রোতে মারা যান। অবাক হবার মতো ব্যপার হলো, একই সময়ে ইংল্যান্ডে, তার পোষা কুকুরটিও মারা যায়!!!
সমাধিতে পাওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ধন-সম্পদ:
স্বর্ণ খচিত বিছানা।

কফিন।
অলংকার।

মুখোশ।

চেয়ার।
সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা তুতেনখামেনের চেহারা পূনর্নিমানের চেষ্টা করেছেন, তার কিছু নমুনা:

ফ্রান্স।

ইংল্যান্ড।

মিশর।

সমাধিতে পাওয়া কাঠের আবক্ষ মূর্তি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:১৪