কর্ম কাণ্ড(জ্ঞান কাণ্ড ও কর্ম কাণ্ড'র উত্তর ও শেষ কাণ্ড)
জ্ঞান কাণ্ড
http://www.somewhereinblog.net/blog/KAMAL5648/29133297
''ভ্রাতৃ ভাব ভাবি মনে দেখ দেশবাসীগণে
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া,
কতরূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া''
- ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত
বাঙলার ভক্তিবাদী ঐতিহ্য অতিসুপ্রাচীন। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি,''বিশ্বাসে মিলয়ে হরি, তর্কে বহুদূর।'' আরো বিশ্বাস করি,''ভক্তিতে মুক্তি, একিনে দরিয়া পার।''
আমরা পত্রাদির সূচনায় আবহমান কাল থেকেই ভক্তিপূর্ণ সালাম/প্রণাম লিখে আসছি। যদিও সাম্প্রকিকালে এসএমএস ও মোবাইল নামক নানাবিধ ম্লেচ্ছ বস্তু এসে চিঠিপত্রের মরণঘন্টা বাজিয়ে ফেলেছে। তদুপরি ওসবে ভক্তিপ্রকাশের কোন ব্যবস্থাই নাই। কারণ ভক্তিবাদ প্রাচ্যের নিজস্ব গৌরবের স্থল।
শ্রী রাধা ভক্তি মার্গ সাধনার কুতুব মিনার। (যদিও শ্রী গীতায় শ্রী রাধার সরাসরি উল্লেখ নেই। পরোক্ষে একবার মাত্র তিনি উল্লিখিত হয়েছেন।) স্বয়ং শ্রী চৈতণ্য মহাপ্রভুও ভক্তিমার্গ সাধনায় উৎসাহ দিয়েছেন। পাশাপাশি আমাদের সমাজে ভক্তি মার্গ সাধনার বহু নিদর্শন বিদ্যমান। অনেকের পরিচয় দেবার সময় বলা হয় ইনি কালীভক্ত কিংবা পরমহংসদেবের অনুরাগী ইত্যাদি। অন্যদিকে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা পীর/ দরবেশ/ গাউস/ কুতুবের মাজার/খানকার বহু ভক্ত পথে-প্রান্তরে সমাজে সংসারে বিরাজমান।
আমাদের অনেক গান/কবিতা/ভক্তিগীতি ভক্তিবাদের চরম পরাকাষ্ঠারূপে বিদ্যমান।
এহেন বাঙালী সমাজ ভক্তিবাদে নিবেদিত থাকবেন তাতে আর আশ্চর্য কী !
বাঙালীর ভক্তিসাধনার কিঞ্চিৎ সারাৎসার নিম্নবিধ-
প্রভু ভক্তি
বাঙালী জগৎপ্রভু ও জাগতিক প্রভু উভয়ার্থেই প্রভু ভক্ত জাতি। যে নামেই প্রভুকে ডাকেন না কেন আমাদের সমাজে জগৎপ্রভুর প্রতি ভক্তির কোন কূল কিনারা নাই, অবশ্য সেটা প্রকাশ্যে। ভেতরের খবর তো তিনিই জানেন। তিনিইতো সর্বজ্ঞ। আমরা চাকুরীরক্ষা বা পদোন্নতির নিশ্চয়তার জন্য জাগতিক যে প্রভুর অধীন তার প্রতিও কঠিন ভক্তিপূর্ণ মনোভাব পোষণ করি। এতে জগৎপ্রভু কী মনে করছেন সে দিকে সবসময় পুরো মনোযোগ রাখতে পারি না। প্রাণের দায় বলে কথা। জাগতিক প্রভুরাও সর্বজ্ঞ। অন্তত সর্বজ্ঞ বলে ভান করেন। ভেতরে কী ভাবেন সেটা তিনি জানেন আর তার জগৎপ্রভুই জানেন। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত আমরা যারা জাগতিক প্রভুর প্রতি প্রকাশ্যে ভক্তি দেখাই সেটা কতোটা খাঁটি আর কতোটা লোক-দেখানো (সোজা বাংলায় বস-দেখানো) সেটা আমরা জানি আর ওপরওয়ালা জানেন। আমাদের সর্বজ্ঞ বসরা কিন্তু আসলেই জানেন না। এবং সেটা যে জানেন না সেই কথা আবার বসরা জানেন না।
নেত্রী ভক্তি/ নেতা ভক্তি
সব সময় দেশে যেহেতু সরকার বিরাজ করে তাই আমারা আমাদের সুবিধার্থে সরকারী নেতা/নেত্রীদের প্রতি প্রবল ভক্তিভাব প্রদর্শন করি। সেটা কেমন তার একটা মোক্ষম বিবরণ দিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-''রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুন।" সরকার বদলের সাথে সাথে রাতারাতি আমাদের ভক্তিভাব আমূল বদলে যায়। (আক্ষরিক অর্থেই রাতারাতি, কারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল জানতে নির্বাচনের দিন গভীর রাত পর্যন্ত লেগে যায়। যিনি সারাদিন ভোট বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন তিনিই রাত পোহাবার পর বড় গলায়- পারলে মাইকভাড়া করে বলেন আমরা ভোট দিলাম বলেই তো..ইত্যাদি ইত্যাদি) এরপর শুরু হয় আসল ভক্তিগীতি-নেতা/নেত্রীকে পাম দিয়ে কোথায় যে তোলেন আর না তোলেন তার আর কোন ব্রেক কাজ করে না। শেক্সপিয়ার বহু আগে বলেছেন-some are born grate, some achieve greatness, and some have greatness thrust upon 'em. বাংলাদেশে কোনটা প্রযোজ্য আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন।
অর্থ ভক্তি
মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বহুলপঠিত ''বিষাদ সিন্ধু''তে বলেছেন, "অর্থই সকল অনর্থের মূল।'' কিন্তু তাই বলে আমরা অর্থের প্রতি অনুরাগ হারাইনি। অর্থের প্রতি ভক্তি (প্রকৃত পক্ষে অতিভক্তি) আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। অর্থপ্রাপ্তির জন্য আমরা অন্য যে কোন ভক্তি প্রকাশ স্থগিত রাখতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। নীতিবাক্য বা নৈতিকতার মতো প্রাগৈতিহাসিক ও গ্রন্থসর্বস্ব বিষয় নিয়ে বিচলিত হই না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আমাদের কাছে মওজুদ থাকলেও এই ভক্তিতে আমাদের ওপর পাশ্চাত্যের কিঞ্চিৎ প্রভাব বিদ্যমান। অন্তত: সত্যের খাতিরে হলেও পাশ্চাত্যের এ গৌরবটুকু স্বীকার করতেই হবে। অর্থবান কোন ব্যক্তি (আত্মীয় হলে তো পোয়াবারো) সামনে এলে ভক্তিতে আমাদের মাথা নুয়ে মাটি ছুঁয়ে যায়।
ডান্ডা ভক্তি
আমাদের সকল মনোবল ডান্ডার সামনে ঠান্ডা হয়ে যায়। ফলে আমরা সদাসতর্ক থাকি ডান্ডাওয়ালা তথা ডান্ডার প্রতি ভক্তির প্রকাশটা যেন অকুণ্ঠ ও প্রকাশ্য হয়। ডান্ডা যাতে ভুল করেও আমাদের পিঠে না পড়ে সে বাবদে আমরা চোখ কান নাক মায় ষষ্ট/সপ্তম/অষ্টম সব ইন্দ্রিয় সজাগ রাখি। বাঙলায় কিন্তু একখানা মোক্ষম প্রবাদ আছে- শক্তের ভক্ত, নরমের যম। আমাদের এই ডান্ডাভক্তির খবর জানতেন বলে পাল, সেন, গ্রীক, মুঘল, তুর্কি,পাঠান, ইংরেজ, পাকিস্তানী সবাই ডান্ডা দেখিয়ে/দিয়ে আমাদের ওপর শাসন শোষন চালিয়ে গেছেন। এই ডান্ডা ভক্তিই আমাদের চিরকালীন পরাধীনতার অন্যতম কারণ।
গুরু ভক্তি
আমাদের গুরু ভক্তি কিংবদন্তী তুল্য। একলব্যতো গুরু (!) দ্রোনাচার্যকে আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে কুণ্ঠিত হণনি। এমনই গৌরবময় আমাদের গুরু ভক্তি। তবে এখন আমাদের গুরু ভক্তির মানে বদলে গেছে। ডোনেশন/ কোচিংয়ের কারণে আসল গুরু ভক্তি এখন নকল হয়ে গেছে। এখন যিনি আমাদের জাগতিক সাফল্যের পথ দেখাতে পারেন তিনিই আমাদের ভক্তি প্রাপক গুরু। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গুরুরা এখন আদি গুরুর মর্যাদা পান। তাঁরা মাঝে মাঝে ''ওস্তাদ''রূপেও পূজিত হন।
তারা ভক্তি
আমাদের অভিনয়, গান, মডেলিং, খেলাধুলা, ভিজে/ডিজে/আরজে নানা রকমের তারায় জ্বলজ্বল করছেন। ডিজ্যুস, এফএম রেডিও আর সরোয়ার ফারুকীদের 'অত্যাধুনিক''ভাষা আর তারাদের বিচিত্র চুল/দাড়ি, ড্রেস, ভঙ্গি আমাদের হৃদয়ে ভক্তিভাব জাগ্রত করে। আমারা মনেপ্রাণে তাদের অনুকরণ করি, অনুসরন করি আর কৃতার্থ হই। তারাদের ছবি ঘরে ঝোলাই, মনে খোদাই করি, প্রাণে ধারণ করি।
উৎসব ভক্তি
উৎসব ভক্তি এ দেশে অতি প্রাচীন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের উৎসব ভক্তি বেড়ে গেছে। দেশী উৎসব যেমন-পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, বড় দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদিতে আমরা আগের চেয়ে বেশী অংশ নিই। নতুন নতুন আনন্দ কৌশল অবলম্বন করি। তাছাড়া আমরা বিদেশ থেকেও উৎসব আমদানী শুরু করেছি। যেমন-ভ্যালেন্টাইন ডে, মাদারস ডে, ফাদারস ডে ইত্যাদি। এই সব উৎসব উদযাপনে আমাদের আসক্তি মতান্তরে ভক্তি অধিক হারে বাড়ছে।
আগে আমরা যে সকল ভক্তি মার্গ অবলম্বন করতাম তার মধ্যে ছিলো পিতৃ ভক্তি, মাতৃ ভক্তি, পতি ভক্তি, পত্নী ভক্তি, গুরু (জন) ভক্তি ইত্যাদি। একুশ শতকে এসে ওসব পুরনো বাতিকে আমরা আর অনুরক্ত নই।
ভক্তি কাণ্ড সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২২ সকাল ১০:১৬