সাত কাণ্ড রামায়ন পড়ে আমাদের ''কাণ্ড'' জ্ঞান হয়েছে। আর মহাভারত হচ্ছে সেই জ্ঞানমহাসাগর যার সম্পর্কে বলা হয় ভারতে এমন কিছু নেই যা মহাভারতে নেই। সেই মহাভারতের অষ্টাদশ অধ্যায়ে আছে শ্রী গীতার উৎস। শ্রী গীতায় আছে তিন মার্গ- জ্ঞান যোগ, কর্ম যোগ ও ভক্তি যোগ। আমরা বাঙালীরাও সর্বভারতীয় উত্তরাধিকারের গৌরবে উভয়ের উত্তরাধিকারী।
সেই জানার আলোয় বাঙালীর জ্ঞান-সাধনার সাত কাণ্ড বিবরণ প্রদানের জন্যই ভক্তিভরে এই নিব্ন্ধ রচনা-কর্মে নিয়োজিত হলাম।
আমাদের জ্ঞান সাধনার উৎস সপ্তবিধ। যথা:
আড্ডা-জ্ঞান
আড্ডা কর্মে কর্মনিপুন বাঙালীর সিদ্ধহস্ততা প্রশ্নাতীত। ড.সৈয়দ মুজতবা আলী দিব্যজ্ঞানী মানুষ রূপে সারাজীবন আড্ডার গুনগান করেছেন। অবলীলায় স্বীকার করেছেন তাঁর যা ''জ্ঞান গম্মি'' সবই আড্ডার ''ঝরতি পড়তি মাল''। আমরা সকাল-দুপুর-রাত, এমন কী গভীর রাতেও রাস্তায়, উঠানে, মাঠে আয়েস করে আড্ডা দিই। নাওয়া খাওয়া ভুলে আড্ডায় মাতি। তর্কে মাতি। চা দোকান হচ্ছে আমাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল-পাড়ার মিনি পার্লামেন্ট, আসল পার্লামেন্টের বাড়া। সব বিষয়ে সকলেই ব্যাপক জ্ঞান বিতরণ/বিনিময় করে। সাথে গালাগালি গলাগলি সবই আছে। সে আড্ডা থেকে বাংলা বাগধারায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে "চায়ের কাপে ঝড় তোলা''নামক নতুন ভুক্তি। সে জন্য আমাদের জ্ঞানের প্রধান উৎস ''আড্ডা-জ্ঞান''।
গুজব-জ্ঞান
বাঙলা গুজবের জন্য অতি উর্বর ক্ষেত্র। ''গুজবে কান দেবেন না'' এই আপ্তবাক্য আউড়েই গুজবের জন্য কান পেতে থাকি। গুজব শ্রবণে আমাদের কর্ণ শীতল হয়। গুজব-তৃষ্ণায় আমাদের কানের ''প্রাণ যায়যায়" দশা উপস্থিত হয়। গুজব শোনার সাথে সাথে সেটা আরেকজনের কানে পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত আমাদের চিত্তচাঞ্চল্য দূর হয় না। এমনকি বদহজম পর্যন্ত দেখা দেয়। গুজব হতে প্রাপ্ত সংবাদ/জ্ঞান আমরা সানন্দে অতি উচ্চমার্গের জ্ঞানরূপে বর্ণনা করি ও শ্রবণ করি।
কান-কথা
আমাদের জ্ঞানের তৃতীয় মার্গ ''কান-কথা''। কান-কথা রূপে আমরা মূলত: গুপ্তজ্ঞান লাভ করি। সুফিবাদ আর বৈষ্ণববাদী দর্শনের পূণ্যভূমি এই বাংলায় গুপ্তজ্ঞান বা গুপ্তার্থ অতিপূজণীয় বিষয়। ভেদ জানার জন্য অভেদের পেছনে আমরা নিত্য ছুটি। ''কান-কথা'' শোনার জন্য ''কান-খাড়া'' করে থাকি এবং সেটা শুনেই আমরা নগদ নগদ শত্রুপক্ষের ''কান-কাটা''য় ওস্তাদ। ''কান-কাটা'' লোকজন এ জন্য কখনো ''কান-কামড়া''য় না। কান-কথা আমরা ''কান-পেতে'' শুনি, শুনেই অন্যের ''কান-ভারী'' করার জন্য ব্যস্ত হই। কান-কথা নিয়ে কানাকানি বা কানাঘুষার শেষ থাকে না। কোন কথা ''কানে ওঠাতে'' চাইলে আমরা কখনোই ''কানে-আঙু"ল'' দিই না। ''কানে-খাটো'' লোকেরাও এই সব কথা ''কানে তুলতে'' ব্যর্থ হয় না।
মিডিয়া-জ্ঞান
ডিজিটাল যুগে এসে মিডিয়া এখন সব চেয়ে বড়ো জ্ঞানের উৎস হয়ে উঠেছে। অনাদিকাল থেকে আমরা বিশেষত: লোকায়ত বাংলায় পত্রিকার নাম থেকে পড়া শুরু করে শেষ পৃষ্ঠার তলদেশে লেখা সম্পাদকের নাম পর্যন্ত পড়ি। এখন অবশ্য চা দোকানে চা-র সাথে টা রূপে টিভিও চলে। মিডিয়া থেকে সদ্যলব্দ জ্ঞান নিয়ে ''চার্লামেন্টে'' চায়ের কাপে রীতিমতো ঘূর্ণিঝড় উঠে যায়। ঢাকা চাটগাঁর সিটি বাসে,কারে,জীপে,মাইক্রোতে দেখবেন সবাই পেপার ভাগাভাগি করে, ভাগে না পেলে গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে মিডিয়া জ্ঞানের জন্য হন্যে হয়ে আছে। রেলে বাসে যদি কোন পেপার কিনে ওঠেন কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবেন আপনার পেপার শতভাগ হয়ে পুরো কামরা ভ্রমন করে ফেলেছে, পেপারটি সবাই গোগ্রাসে গিলছে, একমাত্র আপনি ছাড়া। বিনা পয়সায় অন্যের পেপার পড়ার যে মজা এই গুপ্তজ্ঞান বাঙালী ছাড়া এই ভূ-ভারতে কারো আছে কিনা আমার জানা নেই। ভূ-ভারত ঘোরা কোন জ্ঞানী যদি আমাকে জ্ঞানবান করেন তাহলে এই অভাজন কৃতার্থ হবে। আজকাল মিডিয়া-জ্ঞান জগতের নতুন ''হিরো'' ''টক-শো''গুলোও বিপুল অবদান রাখতে শুরু করেছে।
"শিক্ষা-জ্ঞান''
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড- এই মূলমন্ত্রে পরিচালিত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষালয়। আমরা প্রচুর অর্থব্যয়ে (ডোনেশনে/কোচিংয়ে) সেই মহার্ঘ্য শিক্ষা ''ক্রয়'' করছি। যদিও সে শিক্ষা ব্যবহার করছিনা। ব্যবহার করছি শিক্ষার সাথে উপরিপাওয়া সনদ খানা। শিক্ষার সাথে উপরিপাওয়া সনদ ছাড়াও কিঞ্চিৎ জ্ঞানও আমাদের মেমোরিতে ঢুকে পড়ে ( না পড়লেই আমরা হয়তো বেশি খুশী হতাম)। এটি বাঙালীর জ্ঞানসাধনার সর্বাপেক্ষা গৌন উৎস।
গ্রন্থ-জ্ঞান
লাইব্রেরী ( সরকারী/বেসরকারী/ব্যক্তিগত) হচ্ছে গ্রন্থ হতে প্রাপ্ত জ্ঞানের উৎস। এটি অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক জ্ঞান-আহরণ পদ্ধতি। খুবই অপছন্দনীয় (এমনকি নিন্দনীয়) কাজ। কিছু কিছু লেখক শ্রেণীর লোক নিজেদের লেখা বইয়ের কাটতি বাড়াবার ''কু-মানসে'' লাইব্রেরীর প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখেছেন। কালে কালে এমন চেষ্টা হয়েছে। বুদ্ধিমান বাঙালী কখনো এইসব ''নির্জীব'' জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি কিংবা ওইসব লেখকের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। কিছু কিছু নির্বোধ টাইপের ''অকর্মা'' লোক কদাচিৎ ওই ফাঁদে পা দিয়ে থাকে। বাঙালী সমাজ সে ধরনের লোকদের খুব একটা পাত্তা দেয় না। বই কেনার জন্যও কেউ কেউ কুমন্ত্রণা দেয়। বহু আগে ড.সৈয়দ মুজতবা আলীও দিয়েছেন (কারণ তিনিও কিছু বই লিখেছেন)। আমরা এসব গায় মাখিনা। শুধু বইমেলা আসলে আহমেদ, ইকবাল, মিলনদের গৎবাঁধা কিছু বই কিনি। কারণ তাঁরা বইকে জ্ঞানের সাথে গুলিয়ে ফেলেননি।
গবেষণালব্ধ জ্ঞান
গবেষণালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে জ্ঞানজগতে নতুনমাত্রা যুক্ত হয়ে থাকে। আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলো প্রধানত: এই অকর্মাখাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে। (যেহেতু তাদের টাকা থুড়ি ডলারের অভাব নেই) নির্বোধ জাতীয় লোকেরা এইসব করে থাকে। বাঙালীর আর যে বদনামই থাক বুদ্ধিহীনতার কোন অপবাদ বাঙালীর ঘোর শত্রুও দিতে পারবে না। তবে গবেষণা আমরাও করি। সেটা অবশ্য পরের দোষত্রুটি বের করার জন্য। শত্রুস্থানীয় লোকেরা একে ছিদ্রান্বেষণ বলে ছোট করতে চায়। আমরা এটাকেও গায় মাখিনা।
জ্ঞান-কাণ্ড সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:৫০