somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ের মন

০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ভোরে ফজরের নামাযের পর মাসজিদের নিকটস্থ খালের পাড় ধরে বিছানো ওয়াকওয়েতে টানা চল্লিশ মিনিটের মত হাঁটা শেষ করে যখন “অনন্যা” গেটের কাছাকাছি আসলাম, তখন দেখি কুয়াশা ঢাকা ভোরে আপাদমস্তক চাদরাবৃত একজন মহিলা গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন। তিনি কয়েকবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, আমারও তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। আমাকে অতিক্রম করার সময় তিনি আমাকে সালাম জানিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আংকেল, আপনি কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পারছেন”? তাকে চেনার ব্যাপারে আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়াতে তিনি নিজের থেকেই পরিচয় দিয়ে বললেন, “আংকেল, আমি রানু। আপনার বাসায় এক সময় কাজ করতাম। খালাম্মা কেমন আছেন”? এবারে আমি তাকে সঠিক চিনতে পারলাম, তিনি একে একে বাসার সবার ভালোমন্দ থাকার বিষয়ে খোঁজ খবর নিলেন। আমিও তাকে তার ছেলে মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তার ছেলেটা আগামি ২০২৫ এর মার্চ-এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। দোয়া চাইলেন। আমি তার ছেলেমেয়ে মোট কতজন তা নিশ্চিত জানতাম না। তাই আন্দাজের উপর জিজ্ঞাসা করলাম, “ছেলেটা আগামি বছরে এসএসসি পরীক্ষা দিবে, আর মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে”? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আংকেল, মেয়েও আগামি বছরেই অনার্স পরীক্ষা দিবে”।

মনে মনে ভাবছিলাম, মেয়ে আগামি বছরে অনার্স পরীক্ষা দিবে, এটা তো তার জন্য এক বিরাট খুশির এবং গর্বের ব্যাপার। এটা বলতে তার দীর্ঘশ্বাস বের হলো কেন? খানিকক্ষণ পর তিনি নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন এই বলেঃ “আংকেল এই মেয়েটার জন্য আমার জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে গেল! আপনারা তো জানেন, আমি আর আমার স্বামী কত কষ্ট করে ছেলে মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখাচ্ছি”! আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না, এর পরে বাকিটুকু তিনি নিজেই অনর্গল বলে গেলেন। তার মেয়েটা অনেক মেধাবী ছিল। স্কুল কলেজের সব পরীক্ষাতেই সে ভালোভাবে পাশ করে গেছে। টিউশনি করে নিজের হাত খরচ চালিয়েছে। মেয়েটা অনার্সে ভর্তি হবার পর তিনি ও তার স্বামী তাকে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়া শুরু করেন। একটা উপযুক্ত ছেলের সাথে সম্বন্ধ করার প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু সেটা আসার পর থেকেই মেয়েটার মাঝে অস্থিরতা দেখা দেয়। এক রোযার মাসে ক্লাস থেকে সে সময়মত ঘরে ফিরে না আসাতে তিনি তাকে বিরতিহীন ফোন দিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই ফোন ধরছিল না। অবশেষে একবার ফোন ধরে সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে সে তার পছন্দমত একটি ছেলের সাথে বের হয়ে এসেছে, আর ঘরে ফিরে যাবে না।

এ কথা শুনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং পরপর তিন দিন ধরে তার জ্ঞান আসছিল, আর যাচ্ছিল। পাড়া পড়শিরা তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার মনের দুঃখের অনল কিছুতেই নির্বাপিত হচ্ছিল না। তার রাগী স্বামীও পণ করে বসলেন যে এ মেয়েকে তিনি আর কোনদিন ঘরে প্রবেশ করতে দিবেন না। তাদের উভয়ের এতটা দুঃখের কারণ হচ্ছে যে তারা অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করেছেন। তাদের মত আর্থিক বলয়ের আর কেউ সাধারণতঃ ছেলেমেয়েদেরকে এতটা উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখে না। আমি নিজেও দেখেছি রানু কতটা পরিশ্রম করে sincerely এবং diligently তিন তিনটা বাসায় গায়ে গতরে খেটে তার জীবিকা অর্জন করেছেন। তার স্বামী পেশায় রডমিস্ত্রী, তিনিও অত্যন্ত পরিশ্রম করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করেছেন। কিন্তু মেয়েটি তাদের এ নিষ্ঠা ও শ্রমের কদর করলো না! সে ঘর থেকে পালিয়ে যে ছেলেটিকে বিয়ে করেছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা তার তুলনায় অনুল্লেখ্য। পঞ্চম শ্রেণী পাশ সে যুবক পেশায় একজন রাজমিস্ত্রীর যোগালি। থাকে ময়মনসিংহের ফুলপুরে। রানু ও তার স্বামী জামাই হিসেবে তাকে মেনে না নেয়াতে সে ভীষণ নারাজ। বিয়ের পর থেকে সে মেয়েটাকে বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

বিয়ের পর রানুর মেয়ে নিগার সুলতানা তুলি অন্তঃসত্ত্বা হতে সময় নেয় নি। এ খবর পেয়ে রানু পাগলের মত হয়ে যান। তার স্বামীরও মেয়ের উপর ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু হাজার হোক, মায়ের মন তো, আত্মজা বলে কথা! মেয়ের পেটের সন্তানের কথা ভেবে তার নিজের পেটে মেয়েটির বেড়ে ওঠার কষ্টের কথা হয়তো তার মনে পড়ে গিয়েছিল। মেয়ের এবং মেয়ের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে দৃঢ়চেতা রানু নিজেকে সামলে নেন, মাতৃ্ত্বের স্বর্গীয় মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধের কাছে নতজানু হয়ে পড়েন। একই সাথে তিনি তার অনড় স্বামীকেও ম্যানেজ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। একসময় তিনি সফল হন, তার স্বামীকে রাজী করিয়ে মেয়েটিকে ঘরে তুলে আনেন। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি এখন তার মায়ের ঘরে থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। মায়ের সেবা যত্নের মধ্য দিয়ে তার কষ্টের দিনগুলো পার করছে। ২০২৫ এর প্রথমার্ধে তার জন্য একই সাথে দুটো পরীক্ষা অপেক্ষা করছে; এক, জানুয়ারি মাসে সফলভাবে সন্তান জন্ম দেয়া এবং দুই, মার্চ মাসে অনার্স পরীক্ষায় পাশ করা। সে যেন উভয় পরীক্ষায় আগের সকল পরীক্ষার মত সাফল্য অর্জন করতে পারে, রানু সেজন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার কাছেও দোয়া চাইলেন। অনেক সময় আপন সন্তানেরা তাদের জীবনে মা বাবার অবদান শুধু চোখে দেখেই ক্ষান্ত থাকে, আবার অনেক সময় দেখেও দেখে না। চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও তারা সে অবদানটুকু অনুধাবন করে অন্তরে ধারণ করতে পারে না। তাদের মা বাবার এ দুঃখটা চিরকাল অন্তরে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়!

মেয়েটারও নিশ্চয়ই এ বিষয়ে অনেক কিছু বলার থাকতে পারে। কিন্তু তার কথা তো আমি শুনিনি, তাই কিছু না জেনে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোন মন্তব্য করাটাও সমীচীন হবে না। তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এ ধরণের অসম বিয়ের পেছনে বহু মনস্তাত্ত্বিক অনুঘটক কাজ করে থাকে। এ বয়সের ছেলে মেয়েরা অনেকেই প্রথম প্রেমের বাঁধনেই আটকা পড়ে যায়। প্রথম দর্শনেই যাকে ভাল লাগে, তাকেই জীবনের চিরসঙ্গী ভেবে তারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে থাকে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে তাদের মাঝে গভীর আবেগ এবং প্রণয়ের জোয়ার আসে এবং এর ফলে একের প্রতি অপরের ভালোবাসা ও মানসিক নির্ভরতার ক্রমবিকাশ ঘটে। এটাকেই বলে ‘পাপি লাভ’ (Puppy Love), আধুনিক ভাষায় যেটাকে আদর করে “ক্রাশ” নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তরুণ বয়সে অনেকের মাঝেই এই ক্ষণিকের ক্রাশ অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে ওঠার মত দূরদর্শিতা ও সক্ষমতা থাকে না।


ঢাকা
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ৮৮৪
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৩
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানবিক করিডোর দেওয়ার অর্থ দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিকিয়ে দেয়া।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:০৪


জানি না তিনি কোন প্রেক্ষিতে কথাটা বলেছেন, কিন্তু রাখাইনে মানবিক করিডোর দিলে সেখানে বাইরের সেনা মানবিক সহায়তা ও শান্তরক্ষার্থে প্রবেশ করবে, যা ধীরে ধীরে সামরিক ঘাঁটিতেও পরিণত হতে পারে। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত একটি মানবিক দেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৩৮



যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমরা ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
ভারতের মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা বাংলাদেশি তোমরা ভারতীয়। আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই। ভারতের বাংলাদেশের সাথে সাংস্কৃতিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

লামিয়ার আত্মহনন: রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা, সামাজিক নিষ্ঠুরতা ও মনুষ্যত্বের অন্তর্গত অপমান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:৫১


সেদিন ছিল ১৮ মার্চ ২০২৫। পটুয়াখালীর দুমকীতে বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন শহীদ জসিম হাওলাদারের ১৭ বছরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে লামিয়া। সে বাবা, যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমুদ্রের গভীরে 'অন্ধকার অক্সিজেন'!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩



সমুদ্রের গভীরে 'অন্ধকার অক্সিজেন'! তৈরি হচ্ছে সূর্যালোক ছাড়াই, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা:—

♦️সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার তলদেশ। অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক জগৎ। আর সেখানেই নাকি রয়েছে অক্সিজেন! বিজ্ঞানীরা যাকে ডাকছেন 'ডার্ক অক্সিজেন' নামে। 'নেচার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:০৪


আজ বিমান বাহিনীর বার্ষিক মহড়ায় এমনটাই বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এমন বক্তব্যের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন বাংলাদেশ কি তবে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×