বঙ্গমাতা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশ দেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।
কাব্যগ্রন্থঃ চৈতালি
সাত কোটি ‘বাঙালি’ নিঃসন্দেহে আজ সতের কোটি ‘মানুষ’ এ পরিণত হয়েছে। সেটা সম্প্রতি পুনঃ প্রমাণিত হলো বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনে ছাত্র-জনতার অকুতোভয়, সফল (আপাতঃ) আন্দোলনের মাধ্যমে। সে আন্দোলনের পরিণতি দেশের যে শত্রুর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে, তারই শঙ্কিত হাতে ছোঁড়া বানের বাণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। অভূতপূর্ব বানের জোয়ার শাপ নয়, অভূতপূর্ব বর দিয়ে যাচ্ছে বাংলার সাধারণ জনগণকে, তার প্রলয়ঙ্করী শক্তির সম্মুখীন করে প্রতিরোধের দীক্ষা দিয়ে । জনগণের মাঝে সংহতি সুদৃঢ় হচ্ছে। তিনজন বাঙালির মাঝে যেখানে অন্ততঃ দুইটা ‘সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শত শত হাত একসাথে মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে। বন্যার একটা ছবিতে দেখলাম, প্রবল বিধ্বংসী জোয়ারের প্রমত্ত শক্তিকে উপেক্ষা করে কিছু কিশোর-কিশোরী-যুবা প্রায় বুক সমান জলস্রোতে দাঁড়িয়ে দড়ি ধরে একসাথে তীরের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছে। কেউ কাউকে ভেসে যেতে দিচ্ছে না। একজন যদি ক্লান্তিতে একটু অসাড় মত হয়ে যাচ্ছে, তাকে অন্ততঃ দু’জন এসে সামনে ঠেলে দেবার চেষ্টা করছে। তাদের একহাতে দড়ি ধরা, অন্য হাতে বিপন্ন ব্যক্তির হাত কিংবা কোমর ধরা। এর নাম সম্মিলিত শক্তি। এ শক্তির বলে যে জাতি বলীয়ান, সে জাতিকে কেউ ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না’। বানের জলের এ ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করার বীরত্বগাথা আজ হেথায় হোথায় অন্য কোথায় রচিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এ বীরত্বগাথাকে বানের জলে ভেসে যেতে দেয়া যাবে না। হে বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক, চিত্রগ্রাহক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও কবিকূল, আপনারা আপনাদের চোখ খুলুন। এ বীরত্বগাথাকে গেঁথে রাখুন আপনাদের দেয়ালে দেয়ালে।
রিজাইনা, সাস্কাচুয়ান, কানাডা
২২ অগাস্ট ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১০:৪৩