প্রতিফলন....@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট, ২০ জুন ২০২৪, ১৯ঃ১৪
গত ২০-২১ জুন ২০২৪ তারিখে কানাডার রিজাইনা শহরে বছরের দীর্ঘতম দিন ও হ্রস্বতম রাত কাটালাম। এ দু’দিন দিনের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট, রাতের মাত্র সাত ঘণ্টা ১৫ মিনিট। আর হ্রস্বতম দিনে (২১-২২ ডিসেম্বর) দিনের দৈর্ঘ্য থাকে মাত্র ৮ ঘণ্টা ০০ মিনিট, রাতের ১৬ ঘণ্টা। আমার কাছে দীর্ঘ দিনই ভালো লাগে, আবার অনেকের কাছে দীর্ঘ রাত। এখন এখানে ফজরের নামাযের পর একটা দীর্ঘ ঘুম দিয়েও উঠে দেখি বাজে মাত্র সাতটা/সাড়ে সাতটা। ফজরের সময় শুরু হয় রাত দুইটা পঞ্চান্ন মিনিটে, শেষ হয় চারটা চল্লিশ মিনিটে। আমি যখন উঠি তখনও বাসার সবাই ঘুমিয়ে থাকে। নাস্তা হিসেবে একটা কুকি কিংবা এক স্লাইস পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে খেয়ে নেই, তারপর চিনিহীন, দুধহীন এক কাপ কফি নিয়ে লিখতে বসি। হাতে সময় থাকে দেড় ঘণ্টার মত, কারণ সকাল নয়টায় আনায়াকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসার দায়িত্বটা আমি স্বেচ্ছায় নিয়েছি। তাই ওর সাথে সাথে আমাকেও তৈরি হতে হয়। এই দেড় ঘণ্টায় কিছু লিখালিখি করি, পড়িও। তারপর ফেরার পথে একেকদিন একেক পথে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে, পথের কিছু ছবি তুলে বাসায় ফিরে এসে প্রপার নাস্তা রেডি পাই।
দীর্ঘতম দিনে মাগরিবের সময় শুরু হয় সোয়া নয়টায়, এশার সময় শুরু হয় রাত সোয়া এগারটায়। এশার নামায পড়েই শয্যা নিলেও ঘুমের জন্য হাতে থাকে মাত্র তিন/সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়। এদিকে দীর্ঘতম দিনে সান্ধ্য গোধূলিও প্রলম্বিত হয়। মাগরিবের সময় শুরু হবার (আযান তো শোনা যায় না, ঘড়ি ধরেই নামায পড়তে হয়) ৪০/৫০ মিনিট পরেও চারিদিক আলোকিত থাকে। এতটা আলোকিত থাকে যে গোধূলির আলোতে স্বচ্ছন্দে একটা বই পড়া যায়। অর্থাৎ রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত দিনের মতই আলোকিত থাকে। আবার প্রভাতী গোধূলিও প্রলম্বিত থাকে, ফলে সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগেই আকাশটা ফকফকা পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও সাধারণতঃ ভোরের আলো আমার ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু এখানে প্রাক প্রত্যুষে আকাশটা এতই উজ্জ্বল থাকে যে রাতে পর্দা সরিয়ে রাখলে আর ফজরের পর ঘুমানো যায় না।
যদিও কর্মদিবস ছিল, বছরের এ দীর্ঘতম দিনটিতে এখানকার কয়েকটি বাঙালি পরিবার ঠিক করলো যে ওয়ার্ক টাইমের পর প্রায় এক ঘণ্টার দূর পথে রিজাইনা বীচে বড়শিতে মাছ ধরতে যাবে। সেদিন ঐ সময়টাতে আনায়ার সাঁতারের ক্লাস ছিল বিধায় ও ওর বাবার সাথে ল’সন এ্যাকোয়াটিক সেন্টারে (ইনডোর) চলে গেল সাঁতারের জন্য, আর আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের এক নিকট প্রতিবেশীর সফরসঙ্গী হ’লাম। সন্ধ্যা ছয়টায় যাত্রা শুরু করার কথা থাকলেও, শুরু করতে করতে সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। পৌঁছালাম সোয়া সাতটায়, অর্থাৎ সন্ধ্যা নামতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। তার পরেও আরো পৌণে এক ঘণ্টার মত আলো থাকবে। গত বছরেও এরকম সময়ে আমরা রিজাইনাতে ছিলাম। সেবারে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই মোটামুটি আলোকোজ্জ্বল, বৃষ্টিহীন, উষ্ণ দিন পাওয়া যেত, যদিও অফিসিয়ালি সামার শুরু হয় পহেলা জুন থেকে। কিন্তু এবারে জুন মাসের ২০ তারিখেই প্রথম একটা বৃষ্টিহীন, উষ্ণ দিন পেলাম বলে মনে হলো, তার আগে নয়। আমি এবারে ৩০ মে তারিখে এখানে আসার প্রথম দিনটি থেকেই টানা তিন সপ্তাহ প্রতিদিনই কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসসহ কখনো ঝিরঝিরে কখনো মাঝারি আকারের বৃষ্টিপাত পেয়েছি। একেবারে বিমানবন্দর থেকেই গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত কিছুটা ভিজে ভিজে যেন আমরাই রিজাইনাতে বৃষ্টি নিয়ে এলাম!
এখানে মাছ ধরতে হলে সিটি অফিস থেকে যেমন লাইসেন্স নিতে হয়, সব্জী বাগান করতে হলেও নিতে হয়। সামারের এই তিন চার মাস এশীয় অভিবাসীরা (এ বিষয়ে প্রতিবেশী একটি ভিয়েতনামী পরিবারের একাগ্রতা আমার নজরে এসেছে), বিশেষ করে কয়েকটি বাঙালি পরিবার বড়শিতে মাছ ধরা আর সিটি অফিস থেকে বরাদ্দকৃত প্লটে শাকসব্জীর বাগান করার জন্য মুখিয়ে থাকে। যাদের আলাদা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাসা আছে, তারা তো কিচেন গার্ডেন করেই। যে প্রতিবেশীর সাথে আমরা যাচ্ছিলাম, তিনি ঈদের দিন আমাদেরকে তার সব্জীবাগান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার মন খারাপ ছিল, কারণ এবারে বীজ ও চাড়া রোপনের পর তীব্র শীত ও রৌদ্রহীনতার কারণে তার বেশিরভাগ চারাই মরে গেছে। এর ফলে তাকে আবার দ্বিতীয় দফায় রোপন করতে হবে। অথচ গত বছরে এ সময়েই সৌখিন সব্জীচাষীরা কিছু সব্জীর একপ্রস্থ হারভেস্ট ঘরে তুলেছিলেন। অনেকে আমাদেরকেও বাসায় এসে লাউটা মূলোটা দিয়ে গিয়েছিলেন।
রিজাইনা বীচে গত বছরেও আমরা ঠিক এরকম সময়েই এসেছিলাম। তবে সেবারে এসেছিলাম এক বারবিকিউ আয়োজনে, এবারে মৎস্য শিকারে, দর্শক হিসেবে। পৌঁছেই দেখি ফিশিং পিয়ারের প্রায় পুরোটাই অন্যান্য শিকারীদের দখলে চলে গেছে। যাহোক, কোন রকমে আমরা কয়েকটা বড়শি ফেলার মত জায়গা করে নিলাম। তারপরে শুরু হলো অপেক্ষার পালা। কিন্তু মাছ সহজে ধরা দিতে চাচ্ছিল না। আমাদের আগে আরও তিন/চারটি বাঙালি পরিবার এসেছিল। এসেই শুনি, তাদের একজন একটা মাঝারি সাইজের মাছ ধরেছেন। বাকিদের থলে তখনও শূন্য। বাঙালি ছাড়াও সেখানে অনেক চৈনিক শিকারী ছিলেন এবং তারাই সংখ্যাধিক ছিলেন। এ ছাড়াও অন্যান্য দেশের কিছু শিকারী ছিলেন। তবে আমার কাছে চৈনিকদেরকেই সবচেয়ে উৎকৃ্ষ্ট শিকারী বলে মনে হয়েছিল। তারা কিছুক্ষণ পরে পরেই সোল্লাসে ছিপ তুলে ধৃত তড়পানো মাছকে বড়শিমুক্ত করছিলেন। তারপরে একজন বয়স্ক চীনা মাছগুলোর মুখে রশি বেঁধে রশিটা পিয়ারের রেলিং এর সাথে বেঁধে মাছগুলোকে আন্দাজমত নীচে নামিয়ে দিচ্ছিলেন, যেন সেগুলো পানিতে জাস্ট ডুবে থাকতে পারে। ফেরার আগে অবশ্য আমাদের প্রতিবেশীও দুটো মাছ পেয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি তিনি আমাদেরকে দিয়েছিলেন।
দেখলাম, সবাই মাছের আধার হিসেবে রক্ত চুষে টসটসে হয়ে ফুলে যাওয়া জোঁক ব্যবহার করছে। ওগুলোই এখানে মাছের আধার হিসেবে বিক্রয় হয়। আমাদের ছোটবেলায় আমরা পুকুর পাড়ের মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করে এনে সেগুলোকে বড়শিতে গেঁথে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছি। রক্ত খেয়ে ফুলে ওঠা জোঁক দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম। চীনারাও একই আধার ব্যবহার করছিল, কিন্তু ওরা টপাটপ এত মাছ ধরছিল কোন যাদুমন্ত্রে, সেটাই ভাবছিলাম। যাহোক, all good things must come to an end; so did our fishing spree. আমি নিজে যেহেতু মাছ ধরছিলাম না, কেবলই অন্যদের মাছ ধরার আনন্দের ভাগীদার হতে গিয়েছিলাম, সেহেতু অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে আমি সৈকতের তীর ধরে একটু একটু করে হেঁটে বেড়িয়ে পুনরায় পিয়ারে ফিরে আসছিলাম। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছিল, ওদের আনন্দ উল্লাস উপভোগ করছিলাম। আনায়া আসতে পারলো না বলে ওর কথা ভেবে মন খারাপ হচ্ছিল। গতবছর যখন এখানে এসেছিলাম, এই বাচ্চাদের সাথেই আনায়াও বেলাভূমিতে বালু খোঁড়াখুঁড়ি করে খেলছিল।
পশ্চিমাকাশে সূর্যটা ঢলে পড়তে পড়তে এক সময় দিগন্তরেখা সেটাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। একটা অপার্থিব সৌন্দর্যে চারিদিক ছেয়ে আসছিল। সব কলরব থেমে আসছিল। কিছু স্থির ও ভিডিওচিত্র ধারণ করলাম। সব দেশের প্রকৃতির মাঝেই যেন “বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা”! সেই আঁচল-ছায়ায় বসে, প্রকৃ্তির অপার সৌন্দর্যে অবগাহন করে, পিয়ারে বসেই মাগরিবের নামায পড়ে পার্কিং এ থাকা গাড়ির পানে হাঁটা শুরু করলাম। আগেই উল্লেখ করেছি, সূর্যটা ডুবে গেলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য সে তার আলোর আভাটুকু অনেকক্ষণ পর্যন্ত রেখে যায়। সে আভাটুকুও অনিন্দ্যসুন্দর! গাড়িটা কিছূদুর এগোনোর পর পূব-আকাশে দেখি, পূর্ণচন্দ্রটি দিগন্তরেখা ফুঁড়ে গাছ-গাছালির ফাঁক ফোকর দিয়ে তার স্নিগ্ধ আলো ছড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে সেটি যতই ওপরে উঠতে থাকলো, ততই তার আলো রাস্তার দু’পাশে উন্মুক্ত প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই শশীপ্রভায় সিক্ত হয়ে গাড়ীটা যতক্ষণ পূবমুখে ধাবিত হচ্ছিল, আমি ততক্ষণই তার পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। উল্লেখ্য, সে রাতটা ছিল চতুর্দশীর রাত।
রিজাইনা, সাচকাচুয়ান, কানাডা
২৫ জুন ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ১০৩২
ডিভাইসঃ সবগুলো ছবি আমার তোলা, আই ফোন আই-১৩ দিয়ে।
দুই বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বসে মোটামুটি একই সময়ে (০১ জুন ২০২২) দিনরাত্রির এই হ্রাস-বৃদ্ধির খেলা নিয়ে একটি পোস্ট লিখেছিলাম। সময় এক হলেও অনুভূতিটা ছিল বিপরীত। কারণ কানাডা উত্তর গোলার্ধের উত্তরাংশে, আর অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধে, এবং মেলবোর্ন দক্ষিণ গোলার্ধের দক্ষিণাংশে। এখানে যখন গ্রীষ্মকাল, ওখানে তখন শীতকাল। অনুভূতির এই বৈপরীত্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে পাঠকগণ সেই পোস্টটি দেখতে পাবেন এখানেঃ একটি ছোট্ট দিনের ছোট ছোট কিছু আলাপচারিতা (৬০০তম পোস্ট)
বেলাভূমির বাঁকে...
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ১৯ঃ৪৯
গতবছর আনায়াও এসেছিল আমাদের সাথে, এবং এদের সাথে বেলাভূমিতে বসে খেলেছিল...।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ১৯ঃ৫০
আমাদের দলের আরেকজনের সাফল্য...।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২০ঃ০৯
বাবার ছিপে মাছ উঠেছে, ছেলে আনন্দে আত্মহারা
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট, ২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ০৫
দিগন্তে অস্তমান রবি
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ১০
মাছের কান শাখা ও মুখের ভেতর দিয়ে রশি বেঁধে মাছদুটোকে পানিতে চুবানো হচ্ছে তাদের প্রাণবায়ুকে আরও কিছুক্ষণ ধরে রাখার জন্য।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ১০
অপেক্ষা.....
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ১৩
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি.....
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ১৪
মনযোগ.....
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ১৮
পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবে গেল, সাথে সাথে পূব-আকাশে চাঁদ হাসি ছড়ালো...।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ৪৭
মনে হচ্ছে যেন দিনের আলোতেই পূর্ণিমার চাঁদটা উদিত হলো...।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট,
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ৪৮
ফেরত যাত্রা শুরু হলো, চাঁদটাও আমাদের সাথে সাথে চললো...।
@রিজাইনা বীচ প্রভিন্সিয়াল রিক্রিয়েশন সাইট থেকে চলে আসছি.....
২০ জুন ২০২৪, ২১ঃ৫৮
হাইওয়েতে.....
রাস্তায় গাড়ির আলো, মাঠে চাঁদের আলো...
২০ জুন ২০২৪, ২২ঃ০০
(সুন্দর কিছু ভিডিওচিত্রও ছিল; কিন্তু সেগুলো আপলোড করার পদ্ধতিটা জানা না থাকায় এখানে সংযোজন করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ১১:৪৯