ফাটা টায়ারের চাকা খোলার কাজ চলছে.....
২০ মে ২০২৩, বিকেল ১৭-৪১
গত চার পাঁচদিন ধরে আনায়াকে স্কুলে পৌঁছে দেয়ার পর বাসার আশে পাশের রাস্তাগুলো দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি পথ-পরিচিতির জন্য। গতকাল রিজাইনা পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে কিছুটা সময় ছিলাম। কিছুটা সময় বলতে কয়েক ঘণ্টা। মুশকিল হলো, লাইব্রেরীতে একবার ঢুকলে সময়ের প্রতি আমার কোন খেয়াল থাকে না। তাই কয়েক ঘণ্টায় মনের আশ মেটেনি। আমাদের বাসা থেকে লাইব্রেরী দশ মিনিটের হাঁটা পথ। লাইব্রেরীতে পাঠকদের জন্য এমন কোন সুবিধার কথা ভাবা যায় না, যা নেই। এখানে আবার আসতে হবে, মনে এই আশা রেখে বাসায় ফিরতে হয়েছিল উইনিপেগ যাবার পূর্বে জরুরী কিছু প্রস্তুতির জন্য। আজ আবার সপ্তাহান্ত; শনি রবির পর সোমবার কানাডার সরকারি ছুটি ভিক্টোরিয়া ডে উপলক্ষে। আদনান আর সবুজ তার সাথে আরও একদিন ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে উইনিপেগ যাওয়ার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রেখেছে।
আমরা দুটো পরিবার দুই গাড়িতে একসাথে রওনা হলাম। আমরা যে প্রভিন্সে আছি, সেই সাচকাচুয়ানের পূর্বদিকের প্রভিন্সটির নাম ম্যানিটোবা, তার রাজধানী উইনিপেগ। রিজাইনা থেকে উইনিপেগ গাড়িতে ছয় ঘণ্টার পথ, ৫৭৫ কিলোমিটার সোজা পূর্বে। আমরা যে হোটেলটিতে উঠবো, সেটা আরও কিছুটা দূরে। রিজাইনা থেকে সেটার দূরত্ব মোট ৫৮৫ কিমি। শহরটিতে ছয় শতাধিক মুরাল এবং অসংখ্য স্ট্রীট আর্ট রয়েছে। এখানকার রয়্যাল উইনিপেগ ব্যালে কানাডার প্রাচীনতম নৃত্যকলা প্রতিষ্ঠান। ইমিগ্র্যান্টদের জন্য সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হিসেবে টরন্টো, ক্যালগেরি এবং ভ্যাঙ্ক্যুভার এর পরই উইনিপেগ এর স্থান, কারণ affordablity and a better work-life balance এর কথা বিবেচনা করলে উইনিপেগ অন্যান্য শহরগুলোর চেয়ে অগ্রগণ্য। এটাই বিশ্বের প্রথম শহর, যা জরুরী পুলিশ সাহায্যের জন্য '৯১১ ইমারজেন্সি কল-বার্তা' এর প্রচলন করে। কানাডায় নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগও সর্বপ্রথমে এখান থেকেই শুরু হয়। তাছাড়া আদিবাসীদের প্রতি এবং দরিদ্রদের প্রতি এ প্রভিন্সটি অন্যান্যগুলোর তুলনায় মোটামুটি সংবেদনশীল ছিল বলে ইতিহাসে সুখ্যাত।
রিজাইনা থেকে উইনিপেগ, বলা চলে পূবে-পশ্চিমে সরলরেখার মত একটানা সোজা রাস্তা, কোথাও তেমন কোন বড় বাঁক টাক নেই, কেবলমাত্র এক্সিট ছাড়া। আমরা যাচ্ছিলাম পশ্চিম থেকে পূবে। রাস্তার দু'পাশেও প্রায় একই রকম দৃশ্য- যেন সবুজ গালিচা আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ প্রান্তর; কোন স্ট্রাকচার নেই, মাঝে মাঝে কিছু ছোট ছোট জলাশয় দেখা যায়, আর তার আশে পাশে স্বাধীনভাবে বিচরণরত কিছু দড়ি-খুঁটাবিহীন গবাদি পশু। অনেক দূর পর পর বড় বড় গাছপালা পরিবেষ্টিত কিছু ঘরবাড়ি দেখা যায়, এগুলোকে বলে 'একরেইজ হোম' (acreage home)। শহরে বসবাসরত কিন্তু শহর থেকে দূরে, গ্রামীণ এলাকায় ভূমিসত্ত্বের অধিকারী ভূস্বামীগণ ফসল তোলার সময় মাঝে মাঝে এসব বাড়িতে এসে কিছুকাল অবস্থান করেন। ঝড় বৃষ্টির সময় বায়ুর গতিবেগ কিছুটা হলেও রোধ করার জন্য এসব বাড়িঘর গাছপালা পরিবেষ্টিত রাখা হয়। এই গাছের সারিগুলোকে তাই 'উইন্ডব্রেক' বলা হয়।
একেতো এরকম একটানা, বৈচিত্রহীন রাস্তায় মনোটোনাস ড্রাইভিং এমনিতেই চালকের চোখে ঘুম টেনে আনে, তার উপরে আবার আমাদের অনুরোধে গাড়িতে বাজছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি নিজেও মাঝে মাঝে ঘুমে টুপছিলাম। সম্বিৎ ফিরলেই আদনানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম ওর চোখও ঘুমে ঢুলুঢুলু কিনা। ওকে জিজ্ঞেস করলেই বলে, সামনের Tim Hortens এ কফি ব্রেক নেবে। সবুজ ওদের গাড়িটা চালিয়ে ঠিক আমাদের পিছে পিছেই আসছিল। সেখান থেকে তানিয়া মাঝে মাঝে ফোন করে আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছিল এবং এটা ওটা জিজ্ঞেস করছিল। এতেও আমাদের ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যাচ্ছিল। আমরা বাসা থেকে রওনা হয়েছিলাম সকাল ০৮-২৩ এ। Costco মোড়ে হাল্কা স্ন্যাক্সসহ চা পান করে সেখান থেকে পুনরায় রওনা হ'লাম ঠিক নয়টায়। ক্যু'পেল, ওলসলী, গ্রেনফেল, এস্টেভান ইত্যাদি সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় খুব বড় বড় কয়েকটি বায়ুকল বা Windmill চোখে পড়লো। Windmill সম্পর্কে আনায়া বই পড়ে বা কার্টুন দেখে কিছুটা ধারণা আগেই পেয়েছিল। এবারে স্বচক্ষে তা দেখে কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করলো। মেলভিল, ব্রডভিউ, হোয়াইটউড, মুজ মাউন্টেইনস, ওয়াপেলা, মুসোমিম, ল্যাঙ্গেনবার্গ ইত্যাদি এলাকার সাইনবোর্ড পার হয়ে আমরা ঠিক এগারটায় স্থানীয় Tim Hortens এ কফি ব্রেক নিলাম। ততক্ষণে আমরা মাত্র ২৩৩ কিমি পথ অতিক্রম করেছি, গন্তব্য থেকে তখনও ৩৫২ কিমি পথ পেছনে।
সকাল ১১-৪৫ এ আমরা ম্যানিটোবা প্রভিন্সের সীমানায় প্রবেশ করলাম। রিজাইনা ও উইনিপেগ এর ঠিক মধ্যবর্তী স্থান ভারডেন অতিক্রম করলাম ০১-০৭ এ। ততক্ষণে আরেকটি ব্রেক নেয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু এবারে শুধু রেস্টরুম ভিজিট আর গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্ক টপ আপ করে দু'জন চালকই সাব্যস্ত করলো যে পরবর্তী বিরতি হবে লাঞ্চ ব্রেক, ব্রান্ডনে। ব্রান্ডন তখনও প্রায় এক-দেড় ঘণ্টার পথ দূরে। যাহোক, ব্রান্ডনে লাঞ্চ শেষে চালক দু'জন বাকি পথের দূরত্ব হিসেব করে জানালো, গন্তব্যে পৌঁছতে সাতটা-সাড়ে সাতটা বেজে যাবে। পুনরায় যাত্রা শুরু করে আদনান ফোন করে হোটেল রিসেপশনে আমাদের পৌঁছাবার পরিবর্তিত সময়টা জানিয়ে দিল। তখনও আমরা ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারিনি, সামনে আমাদের জন্য কি ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে!
ব্রান্ডন থেকে ৭০-৭৫ কিমি আসার পর পেছনের গাড়ি থেকে তানিয়া ফোনে জানালো যে তাদের গাড়িতে হঠাৎ করে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। একটা বিকট শব্দ করে গাড়িটা কাঁপছিল আর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সবুজ কোন রকমে গাড়িটাকে একটু সাইডে নিয়ে থামিয়েছে। ওর কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলাম, ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা উভয়ে কিংকর্তবত্যবিমূঢ়! বিশেষ করে ওদের গাড়িতে দুটো ছোট বাচ্চাও ছিল বিধায় আমরাও খুব চিন্তিত বোধ করতে শুরু করলাম। আদনানকে বললাম গাড়ি ঘুরাতে। এসব হাইওয়েতে গাড়ি ঘুরাতে হলেও অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তবেই ঘুরানো সম্ভব হয়। সৌভাগ্যক্রমে তানিয়ার ফোন পাবার পর আমরা যে জায়গাটাতে থেমেছিলাম, সেখান থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যেই ইউ-টার্ন এর সুযোগ পেলাম। সমান্তরাল রাস্তায় ইউ-টার্ন নিয়ে, ওদের গাড়ি অতিক্রম করে আবার পেছন থেকে ইউ-টার্ন নিয়ে আমরা ওদের পেছনে এসে থামলাম। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি ওদের গাড়িটার ডান দিকের পেছনের চাকাটা ফেটে একেবারে ফালা ফালা হয়ে গেছে। আপাতঃদৃষ্টিতে যে কেউ মনে করতে পারে, এ আর তেমন কী সমস্যা? এমন সমস্যার সম্মুখীন তো পথ চলতে গিয়ে যে কেউ হতেই পারে! স্পেয়ার হুইল লাগিয়ে নিয়ে সামনের কোন দোকান থেকে নতুন একটা টায়ার কিনে নিলেই তো হয়! কিন্তু আমাদের জন্য সমস্যার সমাধানটা এত সহজ ছিল না। নানারকমের ইফস এ্যাণ্ড বাটস এসে সমাধানের পথটা জটিল করে তুলেছিল। সৌভাগ্যক্রমে, এমন জটিল পরিস্থিতিতেও আমরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিতে পেরেছিলাম। কিভাবে, সেটা পরবর্তী পর্বে বলছি।
রিজাইনা, কানাডা
২০ মে ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৮৮০
Brandon এর দিকে, Winnipeg এর পথে.....
20 May 2023, 13:51
Brandon থেকে ৭০ কিমি সামনে, Portage la Prairie এর দিকে....
সেলফোনে সমাধান খোঁজার চেষ্টায় দুই চালক
20 May 2023, 16:29
A closer view
20 May 2023, 16:40
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২৩ সকাল ১১:১১