ছাত্রজীবনে কিছু টুকটাক লেখার অভ্যেস ছিল। তেমন কিছু নয়। কোনদিন কোন পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার কোন লেখা পাঠাই নি, তাই প্রকাশিত হবার তো প্রশ্নই উঠে না। আমার লেখালেখি সীমিত ছিল বিভিন্ন বিশেষ দিবস উপলক্ষে কলেজের দেয়াল পত্রিকায় লেখা ছাপানো, আর কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপানো পর্যন্ত। কর্মজীবনে প্রবেশ করে লেখালেখি একেবারে বন্ধ রেখেছিলাম, তাই কোন জার্নালে আমার কোন লেখা প্রকাশিত হয়নি। কর্মজীবন থেকে অবসর নেয়ার পর থেকে আপন খেয়ালে কিছু লেখালেখি শুরু করি, কোথাও প্রকাশের জন্য নয়। ফেসবুক নোটসে সেগুলো টুকে রাখতে শুরু করি। ২০১৩/১৪ সাল থেকে দু’টি বাংলা এবং একটি ইংরেজী কবিতার ওয়েবসাইটে আমার কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করলাম। শুরু হলো অন্যান্য লিখিয়েদের সাথে মিথষ্ক্রিয়া। বুঝতে শুরু করলাম, আজ কবিতাকে যতই সাধারণ্যে একটি অনাদৃত বিষয় বলে মনে করা হোক না কেন, ভাল কবিতা লিখলে আজও পাঠক পাওয়া যায়। ‘আমি কবিতা বুঝি না’, ‘কবিতা মাথার উপরে দিয়া যায়’ ‘দেশে কাকের চেয়ে কবি’র সংখ্যা বেশি’, ইত্যাদি বলে কবি ও কবিতাকে হেয় প্রতিপণ্ণ করা আজ হাল হামলের একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে ‘কবি-খ্যাতি’ লাভের প্রত্যাশী কোন কোন অর্বাচীন ‘কবিতা লেখক’ (কবি নয়) এর দুর্দমনীয় মোহও অনেকাংশে দায়ী। তারা কবিতা লেখার জন্য নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত না করেই নিজের নামে নিজ খরচে কবিতার বই ছাপিয়ে কবি-খ্যাতি অন্বেষণ করেন এবং আত্মপ্রচারে নেমে নিজেদেরকে হাস্যাস্পদ করে তোলেন।
২০১৫ থেকে “সামহোয়্যারইনব্লগ” এ কবিতা ছাড়াও কথিকা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। এ ছাড়াও ফেসবুক এর কয়েকটি সাহিত্য গ্রুপের পাতায়ও মাঝে মাঝে লিখে থাকি। সম্প্রতি “সামহোয়্যারইনব্লগ” এ ব্লগার ‘রূপক বিধৌত সাধু’ “কে কী কারণে লেখালেখি করেন?” শিরোনামে একটি পোস্ট লিখে ব্লগারদের কাছে এ প্রশ্নটি উল্থাপন করেছেন। তার পোস্টটি পড়ে এ প্রশ্নের উত্তরে আমার বক্তব্য কী হতে পারে, এ নিয়ে ভাবা শুরু করলাম গত ক’দিন ধরে। দেখলাম, আমার উত্তরটাও অন্যান্য লেখক-পাঠকদের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নয়। আমিও পরিচিতির জন্য লিখি না, মনের খুশিতে লিখি। সেটাই ভালো লাগে। কে পড়লো বা না পড়লো, সেটা মূল বিবেচ্য নয়। তবে শৌখিন লেখক হলেও, জীবনের পথচলা থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং কিছু হাল্কা জীবন দর্শনের কথাও বলতে চাই। দু’চোখে যা কিছু দেখি, তার কিছুটা গভীরে প্রবেশ করে নিজের উপলব্ধি ও ভাবনার একটা মিশেল আমার লেখায় তুলে আনতে চাই। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মবিশ্বাস, ইত্যাদি নিয়েও ভাবি, কিন্তু এসব বিষয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না কারণ আমরা জাতি হিসেবে পরমতসহিষ্ণু নই। তা ছাড়া আমি কোন রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক কিংবা ধর্মপ্রচারক নই যে আমাকে এসব বিষয়ে লিখতেই হবে। আমি না লিখলেও, যারা এসব বিষয়ে লিখেন, তাদের লেখা আমি পড়ি এবং নিজের মতের সাথে মিলিয়ে দেখি। আমার জানায় কোন ফাঁক থাকলে তা যাচাই সাপেক্ষে পূরণ করে নেই।
প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক বিষয়সমূহ আমাকে আকর্ষণ করে। সে কারণে পরিবেশও আমার একটা প্রিয় বিষয়। নদী, সাগর, পাহাড়, আকাশ ইত্যাদি সব প্রাকৃতিক সৃষ্টিরই একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ও সৌন্দর্য রয়েছে। লেখকদের মনে এসব সৌন্দর্যের প্রভাব পড়ে। পরিবর্তনশীল প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখতে ভালো লাগে। প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্রের মধ্যে আগে শুধুই বর্ষা-শরৎ-বসন্তকে ভালো লাগতো। পরিণত বয়সে এসে ক্ষণস্থায়ী হেমন্তেরও যে একটা আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে, সেটা চোখে পড়ে। মনের উপর বর্ষার দখলদারিত্ব আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে। শীতের স্থায়ীত্ব দিনে দিনে কমে আসছে। তবুও যে ক’টা দিন থাকে, শিরশিরে বাতাস আর পাতা ঝরার শব্দ মনকে দোলা দিয়ে যায়। গ্রীষ্মের নিদাঘ দুপুরে উদাসী ঘুঘুর ডাক শুনলে এখনও মনটা উদাস হয়ে যায়। এ ছাড়া মানবিক গুণাবলী এবং মনুষ্যোচিত সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা, স্পর্শকাতরতা ইত্যাদির অভিব্যক্তি আমাকে স্পর্শ করে, অনুপ্রাণিত করে, উজ্জীবিত করে, অভিভূত করে। এসব বিষয়ে আমি লিখতে ও পড়তে পছন্দ করি। প্রতিটি মানুষের অন্তরে স্নেহ-মায়া-ভালবাসার ফল্গুধারা সতত বহমান, কিন্তু এর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন আকারে হয়ে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে এসব অনুভূতি চির-অপ্রকাশিত থেকে যায়। তাদেরকে আমরা কঠিন হৃদয়ের মানুষ বলে জেনে থাকি, কিন্তু ঠিকমত স্পর্শ পেলে তাদের অন্তরও অঝোরে ঝরে। এসব বিচিত্র জীবনবোধ নিয়ে আমি পড়তে, ভাবতে এবং লিখতে ভালবাসি।
একটি ঝর্নাধারা যেমন তার উৎসস্থল, কোন পর্বত শিখরে জন্ম নিয়ে আপন গতিতে, আপন প্রবাহে তার গন্তব্যপথ খুঁজে নেয়, আমার লেখালেখিও তেমনি। এদের উৎসস্থল আমার মন, মন থেকে কী-বোর্ডের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে এরা তাদের পথ খুঁজে নেয়। কখনো আশ্রয় পায় কোন সাহিত্য পাতায়, কোন অন্তরঙ্গ পাঠক বলয়ে, কিংবা বই এর অবয়বে কোন সহৃদয় পাঠকের বুক শেলফে, ক্বচিৎ কারো কারো মনেও। কোন কোন ঝর্নাধারা যেমন পথ চলতে চলতে কোন মরু প্রান্তরে হারিয়ে যায়, আমারও অনেক লেখা ঠিক তেমনিভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাতে অনেক সময় কোন লেখার একটা পটভূমি তৈরী করে মনোমধ্যে গচ্ছিত রাখি। সকালে উঠে দেখি দৃশ্যপট পরিস্কার! সেখানে একটি শব্দও নেই। চেষ্টা করেও আর মনে করতে পারিনা। এভাবেই হারিয়ে গেছে আমার অনেক লেখা, অন্য কোন লোকে!
ঢাকা
১৯ জানুয়ারী ২০২২
শব্দ সংখ্যাঃ ৭১০