কাকিনা রেল স্টেশন।
টুনি ফুফুর বাসার দরজায় কয়েকবার কলিং বেল বাজালাম, খোলার মানুষ ছিল না। গেইটের একটা দরজা একটু খোলা ছিল, তাই ভেতর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম, মজিবর ফুফা কেবল গোসল করে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন এবং মাথা আঁচড়াচ্ছেন। আমরা কারো অপেক্ষা না করে ভেতরে প্রবেশ করে সালাম দিলাম। আমার মাথায় একটা গল্ফ ক্যাপ আর মুখে ডাবল মাস্ক পরা ছিল। তাই ওনার চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল, আর তা ছাড়া ওনার সাথে দেখাও হল বহু বছর পর। পরিচয় দিলাম, উনি উচ্ছ্বাসে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। করোনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি বললাম, এখন দূর থেকেই আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। আর তা ছাড়া আমি বাইরে থেকে এসেছি, তাই হাত না ধুয়ে এখন স্পর্শ করা যাবে না। ওনাকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে ওনার স্বাস্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। চেহারা উজ্জ্বল, মুখটাও হাসিখুশি। হেঁটে বেড়াচ্ছেন, যদিও হাতে একটা লাঠি ধরা আছে, তবে উনি ওটাকে ব্যবহার করেছেন না। উনি অনেক কথা বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মাসজিদে যাবেন এটা বুঝতে পেরে আমি ওনাকে বুঝিয়ে সালাম জানিয়ে ওনার কাছ থেকে দোয়া চাইলাম। টুনি ফুফু আমাদেরকে ভেতরের ঘরে বসিয়ে সরাসরি বলেই ফেললেন, বাবা তোমার টুপিটা আর মাস্কটা একটু খুলে রাখো তো, এভাবে তোমাকে দেখে চেনা যাচ্ছে না!
ফুফু সম্প্রতি ফুফাকে নিয়ে আম্মাকে দেখতে উৎপলের বাসায় এসেছিলেন, এ কথা দিয়ে গল্প বলা শুরু করলেন। তারপর আব্বা আর আম্মাকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ শুরু করে দিলেন। ফুফাকে নিয়েও উনি এক নাগাড়ে তার প্রশংসা করেই যাচ্ছিলেন, আমরা দু’জন ছিলাম মূলতঃ শ্রোতা। বুঝতেই পারছিলাম, একটা বয়সে এসে মানুষ শুধুই কথা বলতে চায়, কিন্তু শোনার লোক পায় না। উনি আমাদেরকে কিছু ফলমূল খেতে অনুরোধ করলেন। আমরা না করা সত্ত্বেও উনি একটা মেয়েকে ড্রাগন ফ্রুট কেটে দিতে বললেন। কিছুক্ষণ পর পর উনি বলছিলেন, আমি তোমার কথা অনেক মনে করি বাবা। এই তো সেদিনও তোমার ফুফাকে বলছিলাম তোমাকে ফোন করার জন্য। আল্লাহ’র কি ইচ্ছা, আজই দেখা হয়ে গেল। খুব ভাল লাগছে দেখা হয়ে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে!
এটা ঠিক যে বহুদিন পর পর ওনারা হঠাৎ হঠাৎ করে আমাকে ফোন করে আমার কাছ থেকে সবার খোঁজ খবর নিতেন, আমারই মনে করে ওনাদের খোঁজ খবর কখনো নেয়া হয়নি। এক সময় মজিবর ফুফা নিয়মিতভাবে আমাদের বাড়িতে আসতেন, আব্বার সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন, পরামর্শ বিনিময় করতেন। আব্বাও আদিতমারিতে কোন কাজে গেলে, সুযোগ হলেই ওনাদের বাসাতেও যেতেন। টুনি ফুফু আব্বার আপন বোন নয়, আপন মামাতো বোন। টুনি ফুফুর বাবা আর আব্বার মায়ের (আমার দাদীমা) মধ্যেও খুব ভাব ছিল বলে জেনেছি। আমার কাছে তো মনে হয় ভাইবোনের সে সদ্ভাবটা তাদের সন্তানদের মাঝেও বিস্তৃতি লাভ করেছিলো। এজন্য আব্বা টুনি ফুফুকে অনেক আদর করতেন। তবে আব্বা খুব রাগী মানুষ ছিলেন এবং বয়সে তাদের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন বিধায় ফুফু ও ফুফা উভয়ে তাকে ভক্তি যেমন করতেন, ভয়ও তেমন পেতেন। আব্বা সব সময় ওনাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিতেন এবং ওনাদের বাসায় গেলে ওনার সন্তানদেরকে কিছুক্ষণ পড়িয়েও আসতেন।
এদিকে টুনি ফুফুর মা এবং মজিবর ফুফার মা উভয়ে ছিলেন আমাদের রসিক দাদী। ওনারা দেখা হলেই আমাদের সাথে অনেক হাসি ঠাট্টা করতেন। ফুফু ও ফুফা, এই দু’জনকে আমার কাছে সবসময় একটি আদর্শ জুটি মনে হতো। উভয়ের গড়ন আজীবন হাল্কা পাতলা রয়ে গেছে, উভয়ের গায়ের রঙ ফর্সা। উভয়ে মিশুক এবং নরম স্বভাবের মানুষ। ফুফা লালমনিরহাট সরকারী হাইস্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। তার বহু ছাত্র উচ্চ পদে আসীন থেকে খ্যাতি অর্জন করেছেন, ছাত্র শিক্ষক উভয়ে একে অপরকে নিয়ে এ জন্য গর্ব অনুভব করেন। দীর্ঘকেশী ফুফুকে তার আজানুলম্বিত চুলের জন্য আত্মীয়স্বজন সবাই এক নামে চিনতো। ফুফুর নাম টুনি বিধায় আমরা নিজেদের মধ্যে মজিবর ফুফাকে ‘টোনা ফুফা’ নামে ডাকতাম। তাদেরকে দেখে টোনা-টুনিই মনে হয়। মোটামুটি নির্ঝন্ঝাট একটা জীবন যাপন করে ওনারা ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। তাদের সন্তানেরা সকলেই সুশিক্ষিত এবং নিজ নিজ পেশায় সুখ্যাতি অর্জন করে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
টুনি ফুফুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা তুষভান্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। চলার পথে উৎপল বিভিন্ন রাস্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল এবং কোন রাস্তাটা কোথায় যাচ্ছে তা জানাচ্ছিল। একটা এলাকায় এসে জানলাম, এলাকাটার নাম ‘শুকানদিঘী’ (বেশিরভাগ লোক ‘শুকানডিঘি’ উচ্চারণ করে থাকে)। ছোটবেলায় এ নামটা বহু শুনেছি, তাই এলাকাটার নামকরণ সম্পর্কে উৎপলের কাছে জানতে চাইলাম। ও বললো, ও এতটুকুই শুনেছে যে হঠাৎ একদিন এলাকার মানুষ দেখে যে একটি শুকনো এলাকায় একটা বিশাল দিঘী খনন করা হয়েছে। কে বা কারা সেটা খনন করেছে, এলাকাবাসী তা জানে না। আমার আগ্রহ দেখে সে একটু ঘুরে ফিরে সেই শুকানদিঘীর পাড়ে এসে থামলো। আমি নেমে কয়েকটা ছবি তুললাম। এক চঞ্চলা কিশোরীকে দেখি একটা সরু বাঁশের মাথায় কাঁচি বেঁধে (স্থানীয় ভাষায় যেটাকে ‘কোটা’ বলা হয়) একটা গাছ থেকে যেন কি পাড়ছে। তার সাথে আমার কথোপকথন এভাবে হলোঃ
-‘তুমি কী পাড়ছো’?
-‘কামরাঙা’।
-এই দিঘীটার নাম কী?
-‘শুকানদিঘী’।
-এর ইতিহাস সম্পর্কে তুমি কি কিছু জানো?
-হ্যাঁ, জানি। বহু আগে এক রাতের মধ্যে এ দিঘীটি খোঁড়া হয়েছিল।
-কে খুঁড়েছিল?
-“দ্যাও” – বলেই সে খিলখিল করে হেসে চলে গেল।
(দেও বা দেবতা বা কোন অদৃশ্য শক্তিকে স্থানীয় বচন অনুসারে ‘দ্যাও’ বলা হয়। সাধারণতঃ ভূত, প্রেত, পেত্নী বা পাপাত্মাকেও এ নামে ডাকা হয়)!
অনতিদূরে আমি একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। অনুমানে তার বয়স আমার কাছে ৬০-৬৫ হবে বলে মনে হলো। তাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন,
-আমাদের সময় তো বয়স কোথাও লিখে রাখা হতো না, তাই সঠিক বয়স বলতে পারবো না।
-আপনার নাম?
-মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ।
-স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কত বড় ছিলেন?
-তখন আমি ‘দুই ছাওয়ার বাপ’।
এ থেকে আমি বুঝলাম যে আমার প্রাথমিক অনুমানটা ভুল ছিল। তার বয়স অন্ততঃ সত্তর বা তার কিছু বেশি হবে। উনি জানালেন, ওনার দাদারা তাদের দাদাদের কাছে শুনেছিলেন, কোন এক সময় এক রাতের মধ্যে ঐ এলাকায় কাছাকাছি তিনটে দিঘী খোঁড়া হয়, যার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। দ্বিতীয়টির নামটাও তিনি আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু আমি সেটা এখন ভুলে গেছি। আর সব শেষে খোঁড়া হয় তৃতীয়টি, যেটা খুঁড়ে সব কোদাল ধুয়ে ফেলা হয়, যার জন্য তৃতীয় দিঘীটির নাম দেয়া হয় ‘কোদালধোয়া দিঘী’। কে খুঁড়েছে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনিও একই কথা বললেনঃ “দ্যাও এর ঘর” (মানে দ্যাও-সকল, অর্থাৎ ভুত-প্রেতরা )।
সেই প্রবীণ ব্যক্তিকে ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে আমরা কাকিনা ও তুষভান্ডার যাওয়ার রাস্তা সম্বন্ধে জেনে নিলাম। তুষভান্ডার যাবার পথে কাকিনা ডাকবাংলো এবং কাকিনা রেল স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিলাম। কাকিনা কোন উপজেলা নয়, উপজেলা প্রশাসন পদ্ধতি চালু হবার আগে কখনো প্রশাসনিক থানাও ছিলনা, এটি একটি ইউনিয়ন মাত্র। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষায় এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এ এলাকার জনগণ গত দুই/তিন শতাব্দী পূর্বে অনেক অগ্রসর ছিলেন। এর কারণ, ১৬৮৭ সালে কাকিনা পরগণায় জমিদার রাম নারায়ণ এর নিযুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু হয় এবং জমিদারের নিবাস কাকিনা হওয়াতে এতদঞ্চলের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ‘কাকিনা’ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কাকিনা ডাকবাংলোটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে কিংবা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে দূর দূরান্ত থেকে আগত কাকিনার রাজার দর্শনার্থীদের বিশ্রাম ও রাত্রিযাপনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে অনুমিত হয়। ১৬৮৭ সালে শুরু হওয়া কাকিনার জমিদারি বিলুপ্ত হয় ১৯২৫ সালে, সপ্তম জমিদার মহেন্দ্র রঞ্জন রায় চৌধুরী এর শাসনামলে। তার অপরিণামদর্শী খরচ এবং বিলাসিতার কারণে কাকিনা জমিদারি শেষ পর্যন্ত নিলামে উঠে। তবে তার বাবা মহিমা রঞ্জন রায় চৌধুরী একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৮৫৩ সালে জমিদারি লাভ করে ১৮৫৮ সালে একটি জুনিয়র হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে অনেক দূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা শিক্ষালাভের জন্য আসতো। ভাল শিক্ষকের জন্য সে আমলে স্কুলটির অনেক নাম ডাক ছিল। ১৯০৯ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর মহেন্দ্র রঞ্জন রায় চৌধুরী কাকিনার সপ্তম জমিদার হিসেবে আসীন হবার পর চার মাসের মধ্যে স্কুলটিকে ‘হাই ইংলিশ স্কুলে উন্নীত করেন এবং তার পিতার নামানুযায়ী ‘মহিমা রঞ্জন মেমোরিয়াল হাই ইংলিশ স্কুল’ নামে নামকরণ করেন। স্কুলটি বর্তমানে ‘কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে অভিহিত। বহুদিন পূর্বে এ স্কুল থেকেই আমার আব্বা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় (এসএসসি) উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেই আমল থেকেই এই স্কুলের সম্মুখ প্রাঙ্গণে ঐতিহ্যবাহী ‘কাকিনার হাট’ বসতো। আমি যখন সম্ভবতঃ নবম শ্রেণীর ছাত্র, একবার বাড়ি এসে আব্বার সাথে এই কাকিনার হাটে এসেছিলাম। সেখানে আব্বা হঠাৎ করে তাঁর একজন বয়োবৃ্দ্ধ প্রাক্তন শিক্ষকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সেদিন দেখেছিলাম গুরু শিষ্যের ভক্তি-স্নেহ কাকে বলে! আব্বা তাকে এক হাট মানুষের সামনে পা ধরে সালাম করেছিলেন, তিনিও তাকে অনেকক্ষণ বুকে জাপটে ধরে রেখেছিলেন।
ভ্রমণঃ ২৫ জুন ২০২১
লিখনঃ ২৭ জুন ২০২১
স্থানঃ রংপুর
শব্দ সংখ্যা ১২৪৬
আমদের টুনি ফুফু।
‘শুকানদিঘী’র পাড়ে....
‘শুকানদিঘী’র পাড়ে....
প্রায় ৭৫ বছর বয়স্ক মোঃ আব্দুল লতিফ এর কাছ থেকে ‘শুকানদিঘী’ এর কিছুটা ইতিহাস জানা হলো।
প্রায় ৩৫০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত কাকিনা ডাকবাংলো (সংস্কারকৃত)।
স্কুলটি বর্তমানে ‘কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে অভিহিত।
১৯০৯ সালে স্থাপিত স্কুলটির ফাউন্ডেশন প্লেক।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:২৩