আজ সকাল থেকে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। নিবিষ্ট মনে কাজ করার সময় আমি সাধারণতঃ সেলফোনটাকে দূরে রাখি, কাছে রাখলেও শব্দহীন করে রাখি। আজ কাজ করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, একটা নাম্বার থেকে কল আসছে। সাধারণতঃ লেখার সময় আমি ফোনের দিকে তাকাই না। আর তাকালেও, নামের বদলে নাম্বার ভেসে উঠলে তো ধরিই না। কিন্তু আজ ধরলাম। ও প্রান্ত থেকে একজন ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো, খায়রুল আহসান বলছো?” আমি একটু অবাকই হ’লাম, কারণ এ রকম নাম ধরে ডাকার মত লোক তো দিনে দিনে এখন অনেক কমে গেছে এবং যাচ্ছে। হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে ওনার পরিচয় জানতে চাইলাম। উনি বললেন, “আমি এম এস দোহা বলছি, তোমাদের দোহা স্যার, কলেজে ইতিহাস পড়াতাম”!
চমকে উঠলাম। কারণ, কোন সূত্র ছাড়াই গত দু’সপ্তাহে উনি কয়েকবার আমার মনে উদিত হয়েছিলেন। আমিও সেই ‘কয়েকবার’ই উদ্যত হয়েছিলাম ওনার টেলিফোন নাম্বারটি খুঁজে বের করে ওনার সাথে কথা বলতে। ওনার নাম্বারটি আমার সেলফোনে সেভ করা ছিল বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু খুঁজে দেখলাম, তা নেই। আর তা থাকবেই বা কী করে, ওনার সাথে গত চার যুগে কথা হয়েছিল একবারই মাত্র, তাও সাক্ষাতে, সম্ভবতঃ ৫/৬ বছর আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। যদিও তার সাথে আগে কখনো সেলফোনে কথা হয়নি, তবুও মনে হচ্ছিল যে ওনার নাম্বারটি আমার সংগ্রহে আছে, একবার ওনার অসুস্থতার খবর পেয়ে কথা বলার জন্য সেটা জোগাড় করেছিলাম। ক’দিন আগে নাম্বারটি খুঁজে না পেলেও আমি জানতাম যে সেটা বের করা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু কী উপায়ে তা করা যায়, সেই অপশনগুলি নিয়ে ভাবতে ভাবতে চিন্তার গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়, আমার ভাবনা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়। তবু, বিষয়টি আমার খেয়ালে ছিল, শীঘ্রই আবার ওনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। আজ আকস্মিকভাবে ওনার ফোন পেয়ে ওনার উচ্ছ্বাসভরা কন্ঠে আমি শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম ওনার কথা, আর মনে মনে ভাবছিলাম, আমি যা চাচ্ছিলাম তাই তো হলো, একেই কি বলে ‘টেলিপ্যাথী’?
এই দোহা স্যার আমার একজন অত্যন্ত সম্মানীয় শিক্ষক। ক্যাডেট কলেজে যাবার পর আমি প্রথম ‘হাউস টিউটর’ হিসেবে পেয়েছিলাম জনাব মোহাম্মদ শামসুদ্দোহাকে। লম্বা, ফর্সা, সৌম্যকান্তি এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার কলেজে এক প্রকারের ‘ফ্লু’ মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে অনেকটা প্যান্ডেমিক আকার ধারণ করে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী আদেশে আকস্মিকভাবে কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সবাই যার যার বাড়ী চলে যায়, শুধু আমি এবং আমার মত আক্রান্ত আরো কয়েকজন অভাগা ক্যাডেট ছাড়া। আমরা যখন জ্বরে কাতর হয়ে হাউসে একা পড়ে রয়েছিলাম, দোহা স্যার তখন আমাদের পাশে এসে সান্তনা দিতেন, সাহস যোগাতেন। তিনি আমাদের ইতিহাস পড়াতেন, মাঝে মাঝে ইংরেজী শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে ইংরেজীও পড়াতেন। পরে শুনেছি, ওনার নিয়োগটা ওভাবেই হয়েছিল, অর্থাৎ উনি ছিলেন “Lecturer in History/English”। আমার মনে পড়ে, তাঁর খুব পছন্দের বিষয় ছিলো ঐতিহাসিক Stanly Lane Pool এর কোটেশন। ইতিহাসের খাতায় তার প্রচুর কোটেশন ঐ ছোট ক্লাসেও (৭ম-৮ম) মুখস্থ লিখে আমি ওনার কাছ থেকে খুব ভালো নম্বর পেতাম। এত যুগ পরে সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দোহা স্যারের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আমার এসব স্মৃতির কথা স্পষ্ট মনে রেখেছেন এবং আমার স্ত্রীকেও এর কিছু কিছু বলেছেন। তিনি আমার মা এবং মরহুম পিতা সম্পর্কেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে তাঁদের কুশল জেনে নিয়েছিলেন।
আমার আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথার বই “জীবনের জার্নাল” এ আমি দোহা স্যার সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করেছিলাম মাত্র একটি অনুচ্ছেদে। সেই বইটির একটি কপি আমি আমাদের সে সময়ের ‘হাউস বেয়ারার’ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ ভাইকে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম, কারণ বইটির একটি অধ্যায়ে আমি তার সম্বন্ধেও আলোচনা করেছিলাম এবং কোন এক পুনর্মিলনি অনুষ্ঠানে তার সাথে আমার তোলা আমাদের উভয়ের বৃ্দ্ধ বয়সের (৬০+) একটি ছবি সংযোজন করেছিলাম। রউফ ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে বইটি পড়েছিলেন, এবং দোহা স্যারকে এক সময় সাক্ষাতে জানিয়েছিলেন যে আমি ওনার সম্বন্ধেও বইটিতে কিছু কথা লিখেছি। দোহা স্যার তার কাছ থেকে বইটি চেয়ে নেন, সে প্রায় চার পাঁচ বছর আগের কথা। আজ দুপুরে স্যার আমাকে ফোন করে বইটিতে লেখা আমার সেই একটি অনুচ্ছেদের জন্যই অকাতরে প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন এবং আমি যে তাঁকে এমন নিবিড়ভাবে এখনো স্মরণে রেখেছি, সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। আমি যা কিছু লিখেছি, তার সবকিছুই তিনি মুখস্থের মত বলে গেলেন। একটি কথা তিনি বারবার বলে যাচ্ছিলেন, “তোমাদের ‘ভালবাসা’ পেয়ে আমি ধন্য”। কথাটা আমার কানে আটকে র’লো। আমি তাঁর কথা শুনছিলাম এবং নিজেকেই মনে মনে প্রশ্ন করছিলাম, ‘কোনটা বড়, ভালবাসা না সম্মান’? জবাব পেলাম, ভালবাসা না থাকলে সম্মান করা যায় না। কোন কোন সময় ভালবাসা সম্মানের চেয়েও ওজনে ভারী হতে পারে।
স্যার এক নাগাড়ে ৪৫ মিনিট+ কথা বলেছেন। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে গিয়েছেন, নিজের জীবনের অনেক কথা শেয়ার করেছেন এবং মাঝে মাঝেই ফিরে এসে বলেছেন যে আমাকে ধন্যবাদ জানাতেই তিনি ফোন করেছেন, তাঁর নিজের কথা বলার জন্য নয়, এবং তিনি মনে করেন যে তাঁর আরো আগে ফোন করা উচিত ছিল। আমার ফোন নাম্বারটি সংগ্রহ করতেই তাঁর এতটা সময় লেগেছে। তাঁর শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, তাঁকে দৈনিক ১৪টা করে ঔষধ খেতে হয়। আমারই ব্যাচমেট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (ডাক্তার) মোঃ ফজলুল হক (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ‘চীফ ফিজিশিয়ান) এর ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি জানালেন যে ফজলু তাকে অনেক যত্ন করে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে এবং তার চিকিৎসায় তিনি খুবই সন্তুষ্ট। কয়েক বছর আগে তার হার্টেও স্টেন্টিং করতে হয়েছে, তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন তার আরথ্রাইটিস (বাত) রোগের কারণে। তার আংগুলে এবং শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ভীষণ ব্যথা হয়। অনেক ক’টা আংগুল বাঁকা হয়ে গেছে। ভারতে গিয়েও তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন, কিন্তু দেশের এবং ভারতের উভয় চিকিৎসকগণ তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন যে এ জীবনে তিনি এ বেদনার পুরোপুরি উপশম আর কখনোই পাবেন না। খুব বেশি কষ্ট হলে হাই ডোজের ব্যথানাশক ঔষধ খেতে হবে, যা আবার কিডনীর জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক। ফজলু তাকে বলেছে, ‘স্যার, খুব সাবধানে চলাফেরা করবেন। একবার পড়ে গেলে কিন্তু আপনি আর উঠতে পারবেন না, কারণ আপনার হাড্ডিগুলো ভঙ্গুর হয়ে গেছে। সামান্য আঘাতেই ওগুলো গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে’।
দোহা স্যার অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সেই আমলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বোর্ডে (তখন সমগ্র ঈস্ট পাকিস্তান মিলে একটাই শিক্ষা বোর্ড ছিল) মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। এমসিসি তে আসার আগে তিনি দুটো সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে খুলনার বিএল কলেজ এবং পরে আরেকটা সরকারী কলেজে, যার নামটা এখন আর স্মরণ করতে পারছি না। ১৯৬৬ সালে তিনি এমসিসি তে ইতিহাস/ইংরেজীর প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তার উচ্চমানের একাডেমিক রেজাল্ট দেখে ইন্টারভিউ এর সময় এমসিসি’র প্রথম অধ্যক্ষ মাইকেল উইলিয়াম পিট (ব্রিটিশ কাউন্সিলের তৎকালীন একটা শিক্ষা কর্মসূচীর অধীনে আগত) তাঁকে বারে বারে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে নিয়োগ পেলে তিনি প্রভাষক হিসেবে চাকুরী অব্যাহত রাখবেন, নাকি ক্যাডার সার্ভিসে সুযোগ পেলে সেখানে চলে যাবেন। তিনি তাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি থাকবেন। পরে অবশ্য তিনি ঠিকই ইপিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু অঙ্গীকার অনুযায়ী তিনি ক্যাডেট কলেজেই রয়ে যান। তবে ইংরেজী ভাষার উপর তার দখলের প্রমাণ পেয়ে ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল তাকে উভয় বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন এবং তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। তিনি একটানা ১৫ বছর এমসিসি তে চাকুরী করে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে বদলী হন। সেখান থেকে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে পদোন্নতি পেয়ে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে নিযুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে অবসরে চলে যান। ক্যাডেট কলেজের চাকুরী শেষে তিনি কিছুকাল বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট মিলেনিয়াম ইংলিশ ভার্সন স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অবসরে যাবার সময় তিনি মাসিক পেনশন পেতেন মাত্র ছয় হাজার টাকা। তিনি জানালেন, গত ২৪ বছরে সেটা ‘বাড়তে বাড়তে অনেক বেড়েছে’, কিন্তু এখনো সেটা বিশ হাজারের নীচে রয়ে গেছে।
কথা প্রসঙ্গে স্যার আমাকে জানালেন যে তিনি একটি আত্মজীবনী লিখছেন। তার এ কথা শুনে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বইটি কোথায় পাওয়া যাবে তা জিজ্ঞেস করলাম। উনি জানালেন যে বইটি এখনো ছাপানো হয় নাই। পান্ডুলিপি সম্পাদনা চলছে। কলেবরে ১০০ পৃষ্ঠার কিছু কম হবে, ইংরেজীতে লিখা। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওনার বই এর প্রুফ-রীডিং করে দিতে চাইলাম। এ জন্যে (তার যদি আপত্তি না থাকে) পান্ডুলিপির একটি সফট কপি আমাকে ইমেইল করে পাঠাতে বললাম। উনি জানালেন যে উনি কম্পিউটার লিটারেট নন। তাই বাঁকা হয়ে যাওয়া আংগুল দিয়ে তিনি কষ্ট করে হাতেই লিখে চলেছেন। এমনকি তার কোন ইমেইল ঠিকানাও নেই। অন-পেমেন্টে কাউকে দিয়ে উনি পান্ডুলিপি কম্পিউটারে প্রিন্ট করে নিয়ে এক কপি আমাকে পাঠাবেন বলে জানালেন। উনি একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন, আমি ন্যূনতম ইন্টেরাপশন করে মন দিয়ে তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। আমি ইতোমধ্যে বেশ ভাল করেই বুঝে গেছি, একটা বয়সে এসে মানুষ অনেক কথা বলতে চায়, স্মৃতিকথা লিখতে ও বলতে চায়, নিজ জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চায়, কিন্তু ততদিনে সে শ্রোতাশূণ্য হয়ে যায়। তার কথা শোনার মত কেউ কাছে থাকে না। আমি ওনার সব কথা শুনতে আগ্রহী। কারণ, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে পরিণত বয়সে মানুষের হঠাৎ করে কথা বলার এ অদম্য ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তার কথা ফুরিয়ে আসার আগাম সংকেত হিসেবে। আস্তে আস্তে তাকে ডিমেনশিয়া ধরে ফেলে, তার সারা জীবনের স্বগতোক্তিমূলক কথাগুলোর অনেক কাটাকুটি করা রাফ খাতাটা এক সময় হঠাৎ করে ‘সাদা কাগজ’ এ পরিণত হয়ে যায়। তখন আর তার বলার কিছু থাকে না, তার সব কথা স্মৃতিভ্রমের নিকষ কালো অতল গহ্বরে চাপা পড়ে যায়। এ জন্যেই আমি স্যারকে খুব তাগিদ দিলাম, তিনি যেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর এই বই লেখার কাজটি শেষ করেন। গত কয়েকমাসে আমরা ইয়াকুব স্যারকে হারিয়েছি, তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছি এবং নূরুল ইসলাম স্যারকে হারিয়েছি। তার আগে হারিয়েছি মহসীন স্যারকে, আব্দুল্লাহ–আল-আমীন স্যারকে, নাজমুল হক স্যারকে, তারও আগে সাদেক স্যারকে। তাদের কোন কথা তারা আমাকে বলে যান নি। ইনি বলেছেন, আরো বলতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কথা আমাকে শুনতেই হবে, সম্ভব হলে শোনাতেও হবে।
আমাদের দোহা স্যার, ছবিটা ষাটের দশকের শেষের দিকে তোলা।
ঢাকা
১২ এপিল ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ১৪৫০