আবুহেনা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম এ ব্লগের একজন জ্যেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় ব্লগার ছিলেন। গতরাতে তার আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই!
গত ক'দিন ধরেই ওনার কথা মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। ওনার ব্যাপারে হয়তো কিছুটা খোঁজ দিতে পারবেন, এমন আশা নিয়ে দু'জন ব্লগারের ব্লগপোস্টে মন্তব্য করে, শেষে ওনার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। একজন জানালেন, উনি এখন আগের চেয়ে ভাল আছেন, প্রামানিক এবং সাদা মনের মানুষ রাজশাহীতে গিয়ে ওনাকে দেখে এসেছেন। কিছুটা স্বস্তি পেলাম, আনন্দও পেলাম এই ভেবে যে একজন সহব্লগারের অসুস্থতার খুবর জেনে দু'জন সহব্লগার তাকে দেখতে গেছেন। রাজশাহীতে আমার অনেক আত্মীয় স্বজন থাকেন, তারা প্রায়ই সেখানে যাবার জন্য নেমন্তন্ন করেন, বিশেষ করে আমের সিজন আসলে তো করেনই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, এবারে আমের সময়ে রাজশাহী যাব, এবং অবশ্যই হেনা ভাই এর ঠিকানা সংগ্রহ করে যাব এবং তাকে দেখে আসবো। হায়, সেটা আর কখনো সম্ভব হবে না!
'স্বপ্নবাসর' নামে ওনার আত্মজৈবনিক প্রেমকাহিনী অবলম্বনে রচিত উপন্যাসটি একটি সফল উপন্যাস। প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু উনি কখনো এর দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপান নি, তাই আমিসহ অনেকে ওনার কাছে বইটির একটি কপি চাইলেও উনি দিতে পারেন নি। ওনার মৃত্যুর কিছু আগে অবশ্য উনি বহু কষ্টে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাত দিয়ে ছাপার অক্ষর দেখে দেখে টাইপ করে বইটি সিরিজ আকারে এ ব্লগে প্রকাশ করেছিলেন। আমি কয়েকটি পর্ব পড়েছি এবং যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। বাকি পর্বগুলোও চলমান প্রক্রিয়ায় পড়ে যাবার আশা রাখি। এ ব্লগেরই কোন একটা পোস্টে দেখলাম, ড. এম এ আলী মন্তব্যে বলেছেন, উনি এ ব্লগের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। আমিও তার সাথে একমত। ওনার লেখা যে কয়টি গল্প পড়েছি, আমি প্রত্যেকটা পড়েই অভিভূত হয়েছি এবং সেটা আমার মন্তব্যেও অকপটে বলেছি। উনি যে আমার লেখা পোস্ট খুব বেশি পড়েছেন, তা নয়। কারণ উনি সাধারণতঃ যে ধরনের লেখা পড়তে পছন্দ করতেন আমি সে ধরণের পোস্ট খুবই কম লিখেছি। তবে যেগুলো উনি পড়েছেন সেগুলো পড়ে উদারভাবে প্রশংসা করে গেছেন। আমি যখনই সে ধরণের পোস্ট লিখতাম, লিখেই বলতে পারতাম যে সে পোস্টে হেনা ভাই এর মন্তব্য আসবে।
সাত বছর তিন মাস ধরে তিনি এ ব্লগে বিচরণ করে ২২৯টি পোস্ট লিখেছেন, ৯৪৯৫টি মন্তব্য পেয়েছেন, কিন্তু মন্তব্য করেছেন তার চেয়ে দেড়গুণেরও বেশি, ১৪৮৭৩টি। মন্তব্য পাওয়ার তুলনায় করার এ পার্থক্যটাই বলে দেয়, অন্যের পোস্ট পড়ার এবং সে পোস্টে মন্তব্য করার ব্যাপারে উনি কতটা উদার এবং আন্তরিক ছিলেন। তাকে এ ব্লগে ২৬৬ জন অনুসরণ করছেন, এটাও তার জনপ্রিয়তার একটা সূচক। মাত্র একটি শব্দে উনি ওনার পরিচয় তুলে ধরেছেন- 'লেখালেখি'। ওনার পোস্টগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট।
ওনার অন্তর্দৃষ্টি প্রখর ছিল। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উনি যা দেখতেন, অন্তরে তিনি তা ধারণ করতেন এবং নিজ অনুভবে প্রকাশ করতেন। এ জন্যেই তার লেখাগুলো এতটা জীবনঘনিষ্ঠ ছিল। উনি একজন পরিবারঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, সেটা ওনার লেখাগুলো এবং মন্তব্য/প্রতিমন্তব্য পড়ে বেশ বোঝা যায়। এ বয়সে যেমন সবার হয়, উনি ওনার নাতনি নয়নতারা'র প্রতি খুবই এ্যাটাচড ছিলেন। ওনার প্রোফাইল পিকচারেও সেই নাতনিরই ছবি। ছেলে, ছেলে-বৌ, নাতি নাতনি এবং স্ত্রী কন্যাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে একজন সুখী ব্যক্তি ছিলেন। ওনার লেখা সাবলীল ছিল, ভাষা উন্নত ছিল, ওনার লেখায় কখনো কোন ভুল বানান আমার চোখে পড়েনি। প্রেমের গল্প ছাড়াও উনি রম্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সদালাপী এ মানুষটি ভীষণ কৌতুকপ্রিয়ও ছিলেন। সামু পাগলার আড্ডাঘরে মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে আমি দেখেছি, সেখানে কতটা রসিয়ে রসিয়ে উনি আড্ডার আসর মাতিয়ে রাখতেন। আশাকরি, আড্ডাঘরের আড্ডাবাজরা সময় করে ওনাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা লিখবেন। ওনার সাথে সাদা মনের মানুষ এর একটা বিশেষ আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। তাদের খুনসুটি তাদের মধ্যকার বিভিন্ন মন্তব্য/প্রতিমন্তব্যে প্রকাশ পেত, যা আমি উপভোগ করতাম (এবং সম্ভবতঃ ব্লগের অনেকেই তা করতেন)।
উনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। ব্লগে আমি কখনো ওনাকে কোন ক্যাচালে জড়াতে দেখিনি। আর জড়াবেনই বা কেন, উনি সকলেরই শ্রদ্ধেয় ছিলেন, সকলের প্রিয়পাত্র ছিলেন। এমন একজন সজ্জন ব্যক্তির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি, ক্ববরে এবং পরলোকে উনি শান্তিতে থাকুন, সম্মানে থাকুন! তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। বিশেষ করে নয়নতারা তার নানাকে হারানোর শোক দ্রুত সামলে উঠুক, ঐ ছোট্ট শিশুটির জন্য আমার এ শুভকামনা রইলো।
ঢাকা
০৩ এপ্রিল ২০২১