আজ নিয়ে ক্রমাগত তিন দিন ধরে আকাশটা ঝরছে। ভালই লাগছে। বাংলার প্রতিটা ঋতুর আছে একেকটা আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। কিন্তু অধুনা সেই ঋতু বৈচিত্রেও ঘটছে নানা পরিবর্তন। তবে আমি সেটা নিয়ে চিন্তিত নই। প্রকৃতি তার পথ খুঁজে নেবে, সময় সমন্বয় করে নতুন নতুন সাজে সাজবে। এখন চলছে কার্ত্তিক মাস। আমাদের বাল্যকালে হেমন্ত ঋতুর প্রায় অর্ধেকটা, অর্থাৎ কার্ত্তিকের পুরোটা মাস জুড়েই কৃষকের কপালে দুঃখ লেগে থাকতো। এ সময় তাদের ঘরে খাবার থাকতো না, হাতে কাজ থাকতো না। কার্ত্তিক ছিল কৃষকের দুশ্চিন্তার মাস, আমাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘মঙ্গা’র মাস। এখন দিন অনেক বদলে গেছে, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ পৌঁছে যাওয়ায় কৃষি ছাড়াও দরিদ্র পরিবারগুলো ছোটখাট কাজ কারবার করে অন্ন সংস্থান করতে পারছে। এখন আর কার্ত্তিক নিয়ে কৃষকের দুর্ভাবনা তেমন নেই। কার্ত্তিকের পর থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায় নবান্নের পালা, শীতের আগমন এবং সেই সাথে পিঠেপুলির উৎসব।
ছোটবেলায় বর্ষা ঋতুকে আমি ভাল পেতাম না, এখন ভাল লাগে। তখন শীতকাল খুব ভাল লাগতো। এখনো লাগে, তবে ততটা নয়। ঝরা পাতার কান্না তখন শুনতে পেতাম না, এখন পাই। ছোটবেলায় বিকেল খুব ভাল লাগতো, কারণ সেটা ছিল খেলাধুলো করার অনুমতিপ্রাপ্ত সময়। সন্ধ্যে মোটেই ভাল লাগতো না, কারণ তখন পড়তে বসতে হতো। এখন আর বিকেলের কোন আকর্ষণ নেই, তাই অপেক্ষায় থাকি না। বিকেল বেলাটা এখন নিতান্তই ঘটনাবিরল (আন-ইভেন্টফুল)। তবে এখন সন্ধ্যে ভাল লাগে, কারণ সন্ধ্যের সময় পাখিদের, বানরের ঘরে ফেরা দেখতে পাই। হেমন্তের আকাশটাও প্রায়ই নানা বর্ণিল সাজে সেজে আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে, মেঘে মেঘে মায়াবী আবির ছড়িয়ে যায়। দখিনের, পশ্চিমের জানালা দিয়ে আমি সেসব দৃশ্য দেখি। এই সান্ধ্য আবিরের মায়াবী ছটার মাঝেই ক্লান্ত দিবাকর এক সময় শেষ বিদায় জানিয়ে অস্তাচলে যায়। সেই সাথে আমার মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় পড়া বেগম সুফিয়া কামাল এর ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতার কিছু কথাঃ
“ধীরে ধীরে ধীরে
প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলাশেষে দিবসের তীরে
ডুবিল যে শান্ত মহিমায়,
তাহারি সে অস্তরাগে বসন্তের সন্ধ্যাকাশ ছায়”।
এবং একই কবি’র “পল্লী স্মৃতি” কবিতার শেষে আঁকা কিছু স্বপ্নের কথা জীবন সায়াহ্নে এসে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়ঃ
“আগামী দিনের আশা-ভরসার কত না মধুর ছবি
ফুঁটিয়া উঠেছে আঁখির পাতায় ডুবেছে যখন রবি”।
সায়াহ্নের আযান ধ্বনি প্রথমে কানে বাজে, পরে বাজে বুকে। আযানের পর মাগরিবের নামায পড়েই এক কাপ চা হাতে লেখার টেবিলে ফিরে আসি। সকাল সাঁঝে ডাইনিং টেবিলের একটা কোণাতেই আমি ল্যাপটপ খুলে বসি, এর কারণ ডাইনিং টেবিল থেকে দৃষ্টি মেলে ধরলে সেটা অলিন্দ পেরিয়ে আকাশ অবধি পৌঁছে যায়, বড় বড় গাছ গাছালিও দেখা যায়, সেই সাথে পাখিও। করোনাকালের আগে সন্ধ্যার পর পরই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যেতে হতো। জন্মদিন, বিয়ে, কুটুম বাড়ী, ঘরোয়া আড্ডা, সঙ্গীত সন্ধ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদিতে। এখন সেসব বন্ধ, তাই সন্ধ্যের পরেই আমার মূল লেখালেখির কাজ শুরু হয়, যেটা আমি সানন্দে উপভোগ করি।
এখন থেকে দিন ছোট আর রাত বড় হতে থাকবে। নিস্তব্ধ প্রহরের পরিসর বাড়বে, হয়তো লেখার মানও সেই সাথে। আজ দুপুরে লাঞ্চের পর টেবিলে বসেই দেখি একটা বৃষ্টি ভেজা শালিক কাপড় শুকানোর র্যাকে বসে আছে তপস্যারত। বসে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম তার আরো কিছু সাথী বেশ হৈচৈ করছে, বুঝতে পারলাম ওরা পাশের পাত্রে রাখা আহার মনের সুখে খাচ্ছে। তখনো ঝির ঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। আমাকেও ভাতঘুমে পেয়ে বসেছিল। বিকেলে উঠে দেখি তখনো আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি ঝরছে। আকাশে ঘন মেঘের কারণে সন্ধ্যা নামার আগেই আঁধার নেমেছিল। সেই প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যার কিছু ছবি এখানে শেয়ার করেই আজকের মত এই বেলা অবেলার কথকতা শেষ করছি।
ফটোক্রেডিটঃ আমার গিন্নী।
ঢাকা
২৪ অক্টোবর ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ৫৩৭
লাঞ্চের পর টেবিলে বসেই দেখি একটা বৃষ্টি ভেজা শালিক কাপড় শুকানোর র্যাকে বসে আছে তপস্যারত।
আঁধার ঘনিয়ে এলো....