এ ব্লগটা একটা পাবলিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে ব্যক্তিগত কথা না বলাই ভাল, এ আমি ভাল করেই জানি। তবুও এখানে আমার অনেক লেখাই আছে, শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নিয়ে। আমার লেখা ভ্রমণ কাহিনীগুলোতেও প্রায় সময় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বিবৃত হয় বেশী। এটা ব্লগের হয়তো অনেকে পছন্দ করেন না, তবে এর পেছনে আমার একটা লক্ষ্য থেকে থাকে। এসব পাঁচালিতে আমি মানবতার কথা বলতে চাই, আমার চোখে দেখা প্রকৃতির সৌন্দর্যের কথা বলতে চাই, আমার সময়ের একটা চিত্র তুলে ধরতে চাই, নিজস্ব পরিমণ্ডলে দেখা আমার সময়ের কিছু ভাল মানুষের ভাল কাজের কথা বলতে চাই। এতে কতটা সফল হই, তা নির্ধারণের ভার পাঠকের ওপর ন্যস্ত।
আজ আমি অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, আমার বাল্যবন্ধু আবুল হাসানাৎ ফাহিয়ান গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখে স্থানীয় সময় দুপুর দুইটায় চেক প্রজাতন্তের য্লীন (ZLIN) শহরের এক হাসপাতালে কিডনী প্রতিস্থাপনোত্তর অসুস্থতায় মাসাধিককাল ভোগার পর অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। সে বিধবা স্ত্রী আর তিন পুত্র সন্তান রেখে গেছে। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তাঁর অপার করুণা ও দয়ায় ফাহিয়ানের সকল দোষ-ত্রুটি, ছোট বড় সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তার রূহের প্রতি সদয় হউন এবং তাকে শান্তিময় পরলোক দান করুন! আগামী ২২ এপ্রিল বুধবার, দুপুর একটায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যে সাতটায়) চেক প্রজাতন্ত্রের য্লিন শহরেই তাকে সমাধিস্থ করা হবে।
আমার এ বন্ধু সম্পর্কে একটা প্রাথমিক পরিচয় আমি আমার প্রথম দিকের পোস্ট আমার কথা - ৩ এ উল্লেখ করেছিলাম। বাবার কঠিন শাসনে মানুষ হওয়া এ বন্ধুটি নিজ গৃহকে বন্দীশালার মত মনে করতো। এজন্য যখনই সে কোন বন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করতো, তখনই তার সাথে মন প্রাণ খুলে মিশতো। এ কারণেই, বন্ধুদের সান্নিধ্যে সে সবসময় হর্ষোৎফুল্ল থাকতো, হাসি তামাশা করতো, উচ্ছ্বাস নিয়ে গল্প করতো, আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনতো, এবং সুযোগ পেলেই, দুষ্টুমিও করতো। শেষোক্ত কাজটাতে সে খুবই পারদর্শী ছিল। এমন একটা চঞ্চল ছেলে ঘরে কী অবস্থায় থাকতো, সেটা আর এখানে পুনরুল্লেখ করতে চাই না। উপরে উল্লেখিত আমার পোস্টটা পড়লে (লিঙ্ক দেয়া হয়েছে) খুব সহজেই সেটা বোঝা যাবে।
ফাহিয়ান পোল্যান্ড সরকারের বৃত্তি লাভ করে পোল্যান্ডের মেরিন একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম জীবনে পেশা হিসেবে জাহাজের চাকুরী শুরু করেছিল। কালক্রমে জাহাজের ক্যাপ্টেন পদবীতে উন্নীত হবার পর চিরচঞ্চল ফাহিয়ানের এ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন আর ভাল লাগেনি। সে চিরকাল ছিল বৈচিত্র সন্ধানী। ও যে এতটা দিন জাহাজের চাকুরীতে একাদিক্রমে লেগে থাকতে পারবে, এটাই ছিল আমার জন্য এক বিস্ময়! যাহোক, সে ক্যাপ্টেন হিসেবে কয়েক বছর চাকুরী করার পর জাহাজের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে নিজেই একটা ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। (এ ব্লগে কয়েকজন প্রাক্তন সিনিয়র মেরিনার আছেন বলে জানি। তাদের কেউ কেউ ফাহিয়ানকে চিনলেও চিনতে পারেন)। চঞ্চল হলেও সে স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিল। সে একজন ভাল ক্রীড়াবিদ ছিল, ছাত্রজীবনে এথলেটিক্সে সে চ্যাম্পিয়ন হতো। কলেজে থাকতে তাকে দেখতাম, স্পেয়ার টাইমে অন্যরা যখন গল্পগুজবে মশগুল, ও তখন মাঠে নেমে একা একাই দৌড় প্র্যাকটিস করে নিজের উৎকর্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট। অর্থাৎ, ওর যখন যে কাজটা ভাল লাগতো, সেটাতে সে পুরোটাই আত্মনিবেদিত থাকতো। ফলে, সাফল্য অনায়াসে তার করায়ত্ত্ব হতো। তাই, চাকুরীতে ইস্তফার পর সে তার নতুন উদ্যোগে সাফল্য লাভ করবে, এটা আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। ব্যবসার সূত্র ধরে তাকে বেশ কয়েকবার মালয়েশিয়া যেতে হয়েছিল। সেখানে সে বেশ কয়েকজন মালয়েশীয় ধনাঢ্য শিল্পপতির সখ্য লাভ করে। দু’ দু’বার সে ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ আলোচনার জন্য তখনকার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মাদ এর সাথে নৈশভোজে মিলিত হয়। তার সাথে আলাপচারিতায় জেনেছি, মাহাথির সম্পর্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশ এবং আমরা বাংলাদেশীরা যে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকি, ওর ব্যক্তিগত ধারণা ততটা উচ্চ নয়।
ঘন ঘন মালয়েশিয়া যাওয়া আসা করতে করতে একসময় সে অদৃষ্টের অলঙ্ঘ্য ইশারায় সেখানকার বাটা কোম্পানীতে কর্মরত এক ইউক্রেনীয় মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং কয়েক বছর প্রেমের পর ওরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। একসময় তার স্ত্রী মালয়েশিয়া থেকে চেক প্রজাতন্ত্রের য্লিন শহরে অবস্থিত বাটা’র সদর দপ্তরে বদলী হলে ওরা উভয়ে য্লিন শহরে এসে বসতি গড়ে। আমরা হয়তো অনেকেই জানি, চেক ব্যবসায়ী টমাস বাটা ১৮৯৪ সালে এই য্লিন শহরেই বাটা’র ফ্যাক্টরি এবং সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি এক ঐতিহ্যবাহী জুতো ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখনকার হিসেবেই প্রায় তিনশ’ বছর ব্যাপী আট পুরুষ ধরে তার পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে ওদের সে বসতি শান্তির বসতি হিসেবে খুব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। য্লিনে আসার কয়েক বছর পর ওদের বড় ছেলের জন্ম হয়। তার কয়েক বছর পরে ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ভাঙা সংসার, ভাঙা হৃদয় নিয়ে ফাহিয়ান একেবারে মুষড়ে পড়ে। জাহাজের প্রাক্তন নাবিকের তখন নিজের জীবনতরীর বেহাল অবস্থা। কিন্তু এ অবস্থা সে বেশীদিন চলতে দেয়নি, সে ঘুরে দাঁড়ায়। সে তার কাজে মনোনিবেশ করে, ধীরে ধীরে সাফল্যও তাকে ধরা দিতে থাকে। ব্যবসায়ে যখন সে নতুন করে আত্মনিয়োজিত, তখন এক রুশ রমণী (পেশায় স্থপতি) তার প্রতি সদয় হয়ে তার ভাঙা সংসারের হাল ধরতে সম্মত হয়। এভাবেই তার জীবনটা এক নতুন বাঁক নেয়। ফাহিয়ানের নতুন স্ত্রী তানিয়া (তাতিয়ানার সংক্ষিপ্ত সম্বোধন) রূপকথার সৎ মাকে হার মানিয়ে পরম মমতাভরে তার প্রথম সন্তানকে সাথে নিয়ে নতুন করে সংসার সাজাতে শুরু করেন। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজেও তিনি যোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে ফাহিয়ানকে সহযোগিতা করতে থাকেন। কালক্রমে ব্যবসায়ে যেমন উন্নতি হতে থাকে, তাদের নতুন সংসারেও আরো দুটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে।
ফাহিয়ানের বড় দুই ছেলে তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে আজ স্বপ্রতিষ্ঠিত। শেষের জন শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মা বাবা ও তিনভাই মিলে ওদের একটি সুখী পরিবার ছিল। ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, ঢাকার গুলশানের গ্লোরিয়া জীন্স কফিশপে। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সেখানে একত্রিত হয়েছিলাম। সেবারেই সে শেষ ঢাকা এসেছিল, এবং অসুস্থতার কারণে সফর সংক্ষিপ্ত করে য্লিন ফিরে গিয়েছিল। তার পরে পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিডনী প্রতিস্থাপনের জন্য ডোনারের অপেক্ষায় তাকে ‘অপেক্ষা তালিকা’য় রাখে। গত ডিসেম্বরে তার কিডনী প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল য্লিন হাসপাতালে। প্রতিস্থাপনের পর সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করছিল। আমাদের সাথে গত জানুয়ারী থেকে হোয়াটসএ্যাপে পুনরায় তার স্বভাবসুলভ হাসি ঠাট্টা ও কৌতুকভরা আলাপচারিতা শুরু করেছিল। সে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিল, ডাক্তারদের কঠোর তদারকির কারণে এ বছরটাতে সে আমাদের কারো সাথে দেখা করতে পারবে না, কিন্তু আগামী বছরের শেষের দিকে হয় সে বাংলাদেশে এসে আমাদের সাথে দেখা করবে, নয়তো আমরা য্লিনে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে পারবো। কিন্তু মানুষ ভাবে এক রকম, আর তার নিয়তিতে লেখা থাকে আরেক রকম। হোয়াটসএ্যাপে আমি ওর সর্বশেষ বার্তাটি পেয়েছিলাম ০৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে। মাত্র ৪৩ দিনের মাথায় জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ কেমন করে ‘নাই’ হয়ে গেল!
আজ যখন পেছনের দিকে তাকাই, দেখতে পাই সদাচঞ্চল, সদাহাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটির ভেতরে আরেকটি ধীর স্থির, বিচক্ষণ, দয়ালু, মানবিক, সঙ্গীতপিপাসু, সৌম্যকান্তি মানুষের প্রতিচ্ছবি। মনে পড়ে, ২০১১ সালে আমরা কয়েকজন বন্ধু ও সতীর্থ মিলে নিজেদের অনুদানে এবং পরিচিত দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি তহবিল গঠন করে ‘আইলা’ বিধ্বস্ত খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল কয়রা উপজেলায় ১৫/১৬টি পুকুর সংস্কার করে স্থানীয় দরিদ্র জনগণের জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রকল্পটা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। প্রথমে পুকুরগুলোকে জলমুক্ত করে পুনঃখনন করা হয়েছিল। তারপরে সেগুলোকে লবণমুক্ত রাখা এবং সেখানে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ কাজে আমরা আমাদেরই কলেজের এক ছোট ভাই, যিনি ‘ওয়াটার এইড’ নামে একটি এনজিও’র কান্ট্রি চীফ ছিলেন, তার স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা পেয়েছিলাম। ফাহিয়ান যখন জানতে পারলো যে আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন একটা বড়, দরিদ্রবান্ধব কাজ হাতে নিয়েছি, তখন সে সাথে সাথে একটা বড় অংকের অনুদান পাঠিয়েছিল। এ সংস্কার কাজের ফলে বিশেষ করে উপকৃত হয়েছিলেন এলাকার দরিদ্র নারীকূল, কেননা তাদেরকে প্রতিদিন বহু মাইল পথ কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো সাঁতরে পাড়ি দিয়ে এক/দুই কলস পানীয় জল সংগ্রহ করতে হতো।
ফাহিয়ানের নরম মনের পরিচয় পাই ওর পেছনের ইমেইলগুলো ঘাঁটাঘাটি করার সময়। গত ০৩ জুলাই ২০১৭ তারিখে লেখা ওর এই মেইলটা পড়ে এখনও আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেঃ
প্রিয় খায়রুল,
তোকে আরেকটা দুঃখজনক ঘটনার কথা বলি, যেটা উত্তর রাশিয়ার একটা শহর ‘কাযান’ এ ঘটেছিল। মাত্র আড়াই বছর আর ছয়মাস বয়সের দুটি শিশু সন্তান নিয়ে এক ‘সিঙ্গেল মাদার’ সেখানকার এক কলোনীর ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। তার বয়স ছিল চব্বিশ এর আশেপাশে। দুটি শিশু সন্তান নিয়ে এই কঠিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য তিনি দেহ বিক্রয়ের আদিম ব্যবসাকে বেছে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিল না, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন একজন এতিম। তার উপর দুটো বাচ্চাকে লালন করার মত কেউই তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে ইচ্ছুক ছিল না।
কাজেই, বাচ্চাদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেয়ার জন্য তিনি সন্ধ্যেবেলায় তাদের ঘুম পাড়িরে রেখে রাতে বের হতেন জীবিকার অন্বেষণে। মাঝে মাঝে বাচ্চারা রাতে উঠে যেত এবং অনেক কান্নাকাটি করতো। পড়শিরা এতে ভীষণ বিরক্ত হতেন, কিন্তু তবুও তারা তাকে কোন প্রকার সাহায্য করতেন না। তারা সবাই তার সম্পর্কে জানতেন, তাই তাকে সব বিষয়ে এড়িয়ে চলতেন।
কোন এক সন্ধ্যেয় বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়ার মত তার ঘরে কোন খাদ্য বা দুধ ছিল না, তাই তাকে রাস্তার ওপারের একটি দোকান থেকে কিছু খাদ্য এবং দুধ কেনার জন্য যেতে হয়েছিল। সেটি ছিল একটি অত্যন্ত ব্যস্ত সড়ক। রাস্তা পার হবার সময় দ্রুতবেগে একটি গাড়ী এসে তাকে চাপা দেয় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সাথে সাথে পুলিশের গাড়ী এবং এম্বুল্যান্স এসে উপস্থিত হয়। ওরা তার মৃত্যু হয়েছে, শুধু একথা নিশ্চিত করেই মৃতদেহ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে বসে পুলিশ একটি রিপোর্ট তৈরী করে, কিন্তু মৃতের পরিচয় উদঘাটনের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয় না, কেউ তার সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারবে কিনা, সেটা বের করতেও তারা তৎপর ছিল না।
এদিকে বাসায় ক্ষুধায় কাতর বাচ্চারা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতেও তারা কয়েকবার উঠে আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। পড়শিদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না কারণ তারা এতে অভ্যস্ত ছিল। আস্তে আস্তে এক সময় কান্নার আওয়াজ থেমে আসে, পড়শিরা এ নিস্তব্ধতায় খুশী হয়। বাসাটা এভাবে দুই দিন শান্ত থাকে, পড়শিরা মহিলাকে এ দু’দিন দেখতে পায় না। একই বিল্ডিং এর আরেক মহিলা একদিন রাস্তার ওপারের সেই দোকানটিতে কিছু কেনার জন্য গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দু’দিন আগে রাস্তায় গাড়ী চাপা পড়ে এক মহিলার নিহত হবার খবর পান। সন্দেহ হওয়াতে উনি দৌড়ে এসে সেই মহিলার দরজায় করাঘাত করতে থাকেন, কিন্তু কেউ তখন দরজা খুলেনি। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি পুলিশ ডাকেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে দেখতে পায়, দুটি শিশু মৃত পড়ে আছে। ক্ষুধায় এবং দেহে জলশূন্যতায় ওদের মৃত্যু হয়েছিল।
মৃত ঐ শিশু দুটির জন্য সেদিন আমি শুধুই কেঁদে কাটিয়েছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, মানুষের অবহেলার জন্য কেন ওদের এভাবে মৃত্যু হবে? এর কোন জবাব পাইনি। খোদাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন, কেন, কেন? কিন্তু কোন উত্তর নেই। আজও যখন আমি ঐ ঘটনাটার কথা স্মরণ করি, আমার চোখ দুটো জলে ভিজে আসে!
শুভেচ্ছা---
ফাহিয়ান
(উল্লেখ্য, মেইলটি ছিল ইংরেজীতে লেখা, ভাষান্তর আমার। আর মেইলে উল্লেখিত ‘কাযান’ ওর শ্বশুরবাড়ী, ঘটনাটি ঘটার সময় ও সেখানে অবস্থান করছিলো।)
ফাহিয়ান খুব ভাল গান গাইতে পারতো, যদিও এ ব্যাপারে তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। হোয়াটসএ্যাপে ওর সাথে আমার সর্বশেষ বার্তা বিনিময়টাও হয়েছিল ওর পছন্দের একটা গান নিয়ে, যেটার একটা ইউটিউব লিঙ্ক আমি পাঠিয়েছিলাম। আজ মেইল ঘেঁটে বের করলাম, ও শুধু লঘু সঙ্গীতেরই ভক্ত ছিল না, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেরও অনুরাগী ছিল। ২৩ জুলাই ২০১৯ তারিখে লেখা ওর পুরনো ইমেইলটা আজ আমাকে সেকথাটি পুনর্বার মনে করিয়ে দিলঃ
প্রিয় খায়রুল,
আমি আজ তোকে কোন ‘পথের পাঁচালি’ নয়, ‘রাতের পাঁচালি’ লিখতে বসেছি। সে রাতটা ছিল চন্দ্রালোকিত। বাইরের তাপমাত্রা ছিল ২৩-২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, পূর্ণিমার সে রাতটিতে আমি বরাবরের পূর্ণিমার রাতের মতই ছিলাম নিদ্রাহীন। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম আর খোলা জানালাটা দিয়ে চাঁদ, তারা দেখছিলাম। একসময় সেলফোনটা হাতে নিয়ে ইউটিউবে গান ছেড়ে দিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল সিতার শুনবো। সেলফোনের পর্দায় অনেক বাঘা বাঘা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞের নাম ভেসে উঠলো, তার মধ্যে ওস্তাদ রবি শংকরের নামই বেশী জায়গায় দেখা দিল। পর্দায় চোখ বুলোতে বুলোতে এমন একজনের নাম চোখে পড়লো, যার নাম এর আগে আমি কোনদিন শুনিনি- তিনি সুজাত হোসেইন খান। আমি তাঁরই নামটাতে ক্লিক করলাম, আর তার পরিবেশনা শুনতে শুনতে বিহ্বল হতে থাকলাম, ক্রমেই যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম!
ওস্তাদজী রবি শঙ্কর এর তুলনায় তাঁর পরিবেশনাকে আমার কাছে একদম অন্যরকম মনে হলো, অনেক বেশী শান্ত ও প্রশমিত। উনি যখন সিতার বাজান, তখন তাঁর হাতে সিতার কথা বলে, তবলার সাথে যুগলবন্দী হয়ে এক অনন্য মূর্ছনার সৃষ্টি করে। ...... তুই যদি কিছুক্ষণ চোখ দুটো বুঁজে ওনার কন্ঠ এবং বাদ্যের সুর মূর্ছনা শুনিস, অবশ্যই তুই ওনার ঐশ্বরিক সঙ্গীতে সম্মোহিত হয়ে একেবারে যেন স্বর্গে পৌঁছে যাবি। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিশাল শূন্যতায় তোর হৃদয়টা দুলে দুলে, উড়ে উড়ে বেড়াবে। আমারটা যেমন চন্দ্র তারকা গ্রহ নক্ষত্রে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তবে যখন চোখ খুললাম, তখন দেখি, বিছানাতেই পড়ে আছি!
শুভেচ্ছা---
ফাহিয়ান
(এ মেইলটিও ছিল ইংরেজীতে লেখা, ভাষান্তর আমার।)
ফাহিয়ান আমাকে বহুবার আম্নত্রণ জানিয়েছে, যেন আমি চেক প্রজাতন্ত্রে গিয়ে কয়েক দিনের জন্য হলেও ওর আতিথ্য গ্রহণ করি। ও বলেছিল, ওর জীবনের অনেক ছোট বড় গল্প ও কাহিনী রয়েছে, যেগুলো নিয়ে একটা বই লেখা যায়। ও বলেছিল, আমি আমার গল্প বলে যাবো, আর তুই লিখে যাবি। লেখা শেষ হলে আমার এখান থেকে ইংরেজী ও চেক ভাষায় বইটা প্রকাশ করবো। আর তুই বাংলাদেশে গিয়ে সেটা বাংলা ভাষায় প্রকাশের ব্যবস্থা করবি। আমি বলেছিলাম, আমি কখনো ইউরোপে যাইনি। যদি কখনো যাই, তবে য্লিন থেকেই আমার ইউরোপ যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু তার আগেই তো সে তার গল্প বলার জন্য লোকান্তরে পাড়ি জমালো!!!
সদা হাসিখুশী, সদা ইজী-গোয়িং, প্রাণচঞ্চল পিতা ও স্বামীকে হারিয়ে ওর স্ত্রী-সন্তানেরা আজ শোকে মূহ্যমান। এত তাড়াতাড়ি তাকে চিরবিদায় জানানোর কোন প্রস্তুতি না তাদের ছিল, না বন্ধু হিসেবে আমাদের। আমরা ওর পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছি। ওদের বাবার যে এত এত বন্ধু ও শুভাকাংখী ছিল, তা ওর ছেলেরা নতুন করে জানতে পেরে অভিভূত হয়ে গেছে। বারে বারে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। কিন্তু আমরা আর খোঁজ খবর নেবই বা কয়দিন! লসটা তো ওদেরই পার্মানেন্টভাবে হয়ে গেল!!
ঢাকা
১৮ এপ্রিল ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ২০৪৩
পোস্ট স্ক্রিপ্টঃ আমার বন্ধু ফাহিয়ানের জ্যেষ্ঠ্য ভাই, জনাব আবুল হাসানাৎ ফারুক গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি হার্ট, কিডনী এবং ফুসফুসের রোগে ভুগছিলেন, এ ছাড়াও তার ডায়েবেটিসও ছিল। সর্বোপরি, মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি কোভিড-১৯ ভাইরাসেও আক্রান্ত হয়েছিলেন।
মাত্র ১৬ দিনের ব্যবধানে দুই ভাই দুই দেশে সমাহিত হলেন। এটাই জীবন, এটাই নিয়তি! কার কোথায় শেষ ঠিকানা হবে, তা কারও জানা নেই।
জনাব ফারুক পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি খিলগাঁও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিনেন এবং পরে গভঃ ল্যাবরেটরী হাই স্কুলেরও প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমাদের ব্লগের কেউ কেউ হয়তো তাঁকে একজন শিক্ষক হিসেবে পেয়ে থাকতেও পারেন।
উভয় ভ্রাতার জন্য দোয়া কাম্য।
ঢাকা
০২ মে ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১০:৩৮