এর আগের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে.... (৩)
আজ ২৪ মার্চ ২০২০, সকাল। ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে থেকে আকাশে প্লেনের ওঠানামা দেখলাম এবং ভূমিতে বিমান ও বিমানবন্দর সচল রাখার জন্য যেসব ভিন্ন ভিন্ন পেশার উপদল সাধারণতঃ আমাদের চোখের আড়ালে থেকে কাজ করে যায়, তাদের তৎপরতা দেখতে থাকলাম। এদেরকে দেখে আমার পিঁপড়ের সারির কথা মনে পড়লো, আর সেই সাথে পিঁপড়েদের নিয়ে লেখা আমার একটা কবিতার কথাওঃ
“পিঁপড়েরা সব সারি বেঁধে যায়, সারি বেঁধে আসে,
মাঝে যদি উল্টো পথে দেখা হয় কারো সাথে,
ঝটপট জরুরী কিছু কথা চটজলদি সেরে নেয়,
তারপর আবার একান্তে পথ চলা শুরু করে দেয়।
পিঁপড়েদের মত এত অধ্যবসায়ী আর কেউ নেই,
পিঁপড়েদের মত এত শক্তিশালী আর কেউ নেই।
ওরা নিঃশব্দে পথ চলে, আর খুব কম কথা বলে।
স্ব-ওজনের বিশ গুণ বোঝা ওরা বয়ে নিয়ে চলে”।
(আমারই একটি কবিতা থেকে, “পিঁপড়ের মত”)
চায়না সাউদার্ন একটি দ্রুত প্রসারমান এয়ারলাইন ছিল। অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের আজ প্রায় সব এয়ারলাইনই মুখ থুবরে পড়ে আছে। চায়না সাউদার্ন এখনো তবু কিছুটা সচল আছে। দিনে রাতে চব্বিশ ঘন্টায় ৭/৮ টি করে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলে, আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলে প্রতি ঘন্টায় কয়েকটি করে। বালকসুলভ যে কয়েকটি অভ্যেস আমি এই বুড়ো বয়সেও পরিত্যাগ করতে পারিনি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আকাশে উড়ন্ত প্লেনের আনাগোনা দেখে আনন্দিত হওয়া। তাই সাত সকালে সবাই যখন ঘুমিয়ে, আমি তখন গুয়াংঝু’র বাইয়ুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে অনন্ত আকাশে ছোট বড় মাঝারি, সব ধরণের প্লেনের আনাগোনা দেখছিলাম। আবারো আমারই লেখা একটি কবিতার কথা মনে পড়লোঃ
“বিকট গর্জনে ভেসে যায় এক উড়ন্ত প্লেন,
একটি প্রতিকী পতাকা লেজে তার আঁকা।
উড়তে উড়তে সেটি হুট করে ঢুকে যায়
ভাসমান একটা মেঘের দ্বীপের ভেতর।
ভেতরে তার মেঘবালিকাদের আনাগোনা।
একটু পরেই আবার ওটা বেরিয়ে আসে
মেঘ ভেদ করে। আমি নিঃশব্দে নির্নিমেষ
তাকিয়ে দেখি যতক্ষণ, যতদুর দেখা যায়,
ঐ দূর নীলিমায়। যেতে যেতে অবশেষে
ওটা বিন্দু হয়ে হারিয়ে যায়, এক সময়”।
(আমারই একটি কবিতা থেকে, “চলে যাওয়া...”)
আমি বসে থাকতে থাকতেই দেখি, ফিতের ওপাশে এক নীরব চীনা কর্মী আনমনে সারিবদ্ধ হুইল চেয়ার গুলো স্প্রে করে জীবানুমুক্ত করছে। মাঝরাতে একবার ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখি, ছোট একটি চলন্ত যান দিয়ে যান্ত্রিক উপায়ে মেকানিক্যালী ফ্লোর ক্লীনিং এবং স্যানিটাইজিং চলছে। বাকী সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসার জন্য ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হ’লাম। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ৪৮ ঘন্টার এই কঠিন যাত্রাবিরতির সময়ে দেখা আমার সবচেয়ে ভাল কী লেগেছে? আমি নিঃসন্দেহে বলবো, ঝকঝকে তকতকে, spick and span ওদের ওয়াশরুমগুলো। ওয়াশরুমে ঢুকেই মন ভাল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে চীনাদের তৎপরতা অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চমানের। ২৪ ঘন্টা ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়ানো থাকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত পোশাকে দু’জন ক্লীনার। সুপ্রশিক্ষণপাপ্ত সৈনিকের ন্যায় নিখুঁত ও যান্ত্রিক তাদের কাজ। প্রতিবার, প্রতিজনের ব্যবহারের পর ওরা আসছে, শুধু কমোড, বেসিন এবং বেসিন প্ল্যাটফর্ম নয়, পুরোটা মেঝে ওরা স্প্রে দিয়ে স্যানিটাইজ করছে, তার পর মুছে দিয়ে মেঝে শুকনো রাখছে। হ্যাঁ, এটা ওরা করছে কোন ঘন্টা মিনিট ধরে নয়। প্রতিবার, যখনই কেউ (অবশ্য ঐ এলাকায় যাত্রীদের সংখ্যাও খুব বেশী ছিল না) ওয়াশরুম ব্যবহার করতেন, তার পরে পরেই এসে ওরা রুটিনমাফিক এ কাজগুলো করতেন। ক্লীনার বলে ওদের সরকার ওদের নিরাপত্তাকে ছোট করে দেখেনি। ওদের গায়ে যে পোশাক দেখলাম, বোধকরি অনেক উন্নত দেশের ডাক্তারদেরও আজকের এই দুঃসময়ে সেরকম সুরক্ষিত পোশাক পরার সৌভাগ্য হয় নি। হাতে ওদের দুই লেয়ারের গ্লোভস, মাস্কের পরেও মাথা থেকে থুতনি পর্যন্ত আরেকটি আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। পায়ে স্যানিটাইজড জুতোর পরেও বাহির দিয়ে আচ্ছাদিত আরেক বিশেষ ধরণের জুতোমোজা। লক্ষ্য করেছি, বার ঘন্টার প্রতিটি শিফট ডিউটির পর ওরা নতুন করে এসব পোশাক পায়, এবং হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহকারী এক ধরণের বিশেষ যন্ত্রচালিত মেশিন চালিয়ে কেউ একজন এসে সেসব পরিত্যাক্ত পোশাকগুলো নিরাপদ ডিস্পোজালের জন্য নিয়ে যায়।
ফিতে ঘেরা আমাদের বিরতি এলাকাটা থেকে বের হলেই পাওয়া যায় ঠান্ডা, ইষদোষ্ণ এবং গরম পানির ডিস্পেন্সার। ভিন্ন তিন মাত্রার উষ্ণতার পানি পাওয়া গেলেও, ডিস্পেন্সারের উপরে একটা সুপারিশ লেখা আছে সুস্বাস্থ্যের জন্য গরম পানি পান করার জন্য। আমি তাই যতবার সেখান থেকে পানি পান করেছি, গলা যতটা গরম সহ্য করতে পারে, ততটা গরম পান করেছি। ফিরে এসে সেলফোন চার্জে দিয়ে মেইল খুলে দেখলাম, ছেলেরা সবাই ওদের মায়ের ছবি দেখতে চাচ্ছে। প্রথমে গিন্নীকে ছবি তোলার কথা বলায় তিনি রাজী হলেন না, ছেলেদের কথা বলায় রাজী হয়ে গেলেন। তাকে নিয়ে কয়েকটি ভিন্ন স্পটে ছবি তুলে তা এটাচ করে ফ্যামিলী মেইলগ্রুপে পাঠালাম। কিছুক্ষণ পর থেকেই ছেলে এবং বৌমাদের কাছ থেকে খুশীর প্রতিক্রিয়া পেতে থাকলাম। আমরা একটু পরে নিজ জায়গায় ফিরে এসে দেখি, ততক্ষণে বাকী পাঁচজনও ঘুম থেকে উঠে গেছেন। সিডনীগামী অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোককে রাতে ঘুমের চোখে দেখে ও কথা বলে মধ্যবয়স্ক ভেবেছিলাম। সকালে দেখে মনে হলো আমাদের ছেলের বয়সী। তার স্ত্রীর (পরে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ওরা জানিয়েছে, ওরা স্বামী স্ত্রী নয়, “পার্টনার”। রাতে যদিও “স্ত্রী”ই বলেছিলেন)। নাকের অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করাতে মহিলা নিজেই উঠে এসে, সুপ্রভাত সম্ভাষণ জানিয়ে আমার স্ত্রীর দেয়া স্কার্ফটির জন্য প্রভূত ধন্যবাদ জানাতে শুরু করলেন। আমি বললাম, এটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার ছিল। তার পর তাদেরকে বললাম, লস এঞ্জেলিসগামী পাশের ঐ মহিলাদ্বয় রাতে আমাদেরকে তাদের কম্বল বালিশ পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন, আমাদের প্রয়োজন ছিল না বলে আমরা তা নেই নি। আপনাদের প্রয়োজন ছিল, তাই আপনারা আমাদের এ সামান্য জিনিসটি চেয়ে নিয়েছেন বলে আমরা খুশী হয়েছি। এ কথা শুনে মহিলার চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো। অস্ফূট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, পৃথিবীর মানুষ এখনো এত ভালো!!!
ধীরে ধীরে আমরা সাতজন একটু একটু আলাপচারিতার মাধ্যমে একে অপরের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম। অস্ট্রেলীয় দম্পতির সাথে আসা অপর মহিলার সম্পর্কটা কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলাম না। দুই মহিলা দেখতে বোনের মত নয়, আবার কথোপকথন শুনে তাদেরকে বান্ধবীও মনে হচ্ছে না। গিন্নী এক ফাঁকে ওদের সাথে কথা বলে আমাকে জানালেন, অস্ট্রেলীয় দম্পতির সাথে আসা অপর মহিলা আলাদা এসেছেন, কানাডিয়ান, এই বিমান বন্দরেই তাদের মাঝে পরিচয় হয়েছে। তাহলে দাঁড়ালো, আমরা এখানে সাতজন মানুষ, চারটে গ্রুপ। কাদের ফ্লাইট কখন, সেটাও জানা হলো। আজ রাতে প্রথমে বিদায় নেবেন অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি, রাত নয়টায়। তার পরে যাবেন লস এঞ্জেলিস দম্পতি, রাত সাড়ে নয়টায়। পরের দিন দুপুর আড়াইটায় যাবেন অপর মহিলা, যিনি বেজোড়, কানাডার ভ্যাঙ্ক্যুভারে। আর তার পরে ঐ দিনই আমরা রওনা হবো ঢাকার উদ্দেশ্যে, রাত নয়টায়। আমরা নিজেদের মাঝে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে গ্রুপ হিসেবেও একে অপরের সাথে মাঝে মাঝে কিছু কথা বলছিলাম। আলাপচারিতায় জানলাম, অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোকের নাম কিয়াল স্মিথ, মহিলার নাম ইমা মিশেল। ওরা প্রায় দু’মাস ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করে, বাকী সফর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দেশে ফেরার কারণ, ইমার বাবা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এটা শোনার পর থেকে ইমার আর কোন কিছু ভাল লাগছিল না, তাই ওরা যত দ্রুত সম্ভব, দেশে ফিরে যাচ্ছেন। বাসায় ইমার বাবাকে দেখাশোনা করার মত কেউ নেই, কারণ স্ত্রীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছে। তিনি চেইন স্মোকার, তাই তার ফুসফুস আগে থেকেই ঝরঝরা ছিল। ইমা শঙ্কিত যে তার বাবা এ যাত্রায় সার্ভাইভ করতে পারবেন না। তাই, করোনা ভাইরাস যতই সংক্রামক হোক, তার বাবার জীবনের এ সংকটময় মুহূর্তে তিনি বাবার পাশেই থাকতে চান। শুনে অবাক হ’লাম যে তার বাবার বয়স আমার চেয়েও কম!
ইমা ও কিয়ালদের পরে যাবেন লস এঞ্জেলিসগামী সেই দুই মহিলা। তাদের নামও বলেছিলেন, কিন্তু নাম দুটো একটু শক্ত হওয়ায় মাথায় গাঁথে নি। শ্বেতাঙ্গিণীর বয়স আনুমানিক ৩৫ এর আশে পাশে হবে, তার সাথে থাকা শ্যামলা মহিলার ২৫ এর আশে পাশে। কনিষ্ঠজন সারাক্ষণ হয় একটি বই পড়ছিলেন, নয়তো সেলফোনে গেইম খেলছিলেন। জ্যেষ্ঠ্যজন খুব করে ঘুমিয়ে নিচ্ছিলেন। তারা উভয়ে অস্ট্রেলীয় দম্পতির তুলনায় স্বল্পভাষী, ক্ষীণ কন্ঠে কথা বলেন। আলাপচারিতায় জানলাম, ওনারাও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফরের পর নিজ দেশে ফিরছিলেন এবং তাদের মত ওনারাও ব্যাকপ্যাকার। লস এঞ্জেলিস থেকে ওনারা অন্য কোন একটা ডমেস্টিক এয়ারপোর্টে ফ্লাই করবেন, সেখান থেকে তাদের আড়াই ঘন্টার মত রোড জার্নি করে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। ওনাদের পরের দিন দুপুরে যাবেন সেই কানাডীয় মহিলা, রোযালী রিকার্ড। তাকে মহিলা না বলে তরুণী বলাই ভাল, কারণ তার বয়স মাত্র ১৯। প্রথম দিকে তাকে বেশ রিজার্ভড মনে হলেও, আলাপ সালাপের পর দেখা গেল তিনি সবার সাথে টীনএজার সুলভ উচ্ছ্বাসে খোলা মনে কথা বলছেন। অপর দুই গ্রুপের তুলনায় উনি আমাদের সাথে প্রায় ১৮/১৯ ঘন্টা সময় বেশী কাটিয়েছেন, তাই ওনার সম্বন্ধে জেনেছিও বেশী। আর তা ছাড়া উনি কথা বলতে ভালবাসেন।
রোযালী’র পরিবার ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান। এ সফরে আসার আগে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় দেশ মরক্কো সফর করেছেন। মরক্কো একসময় ফরাসী উপনিবেশ ছিল বিধায় সে দেশটি চষে বেড়াতে তার কোনই অসুবিধে হয়নি। তার আগে তিনি কাজিনদের সাথে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ ঘুরে এসেছেন। তখনো তার বয়স ১৮ বছর হয়নি বিধায় বয়সে বড় কাজিনদের সাথে যেতে হয়েছিল। এবারে তিনি বয়ফ্রেন্ডসহ প্রথমে সফর করেছেন জাপান, দু’সপ্তাহব্যাপী। তার বয়ফ্রেন্ডের হাতে ছুটি না থাকায় উনি ফিরে গিয়েছেন কানাডায়, আর এই ১৯ বছর বয়সের তরুণী এক মাস ধরে একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছেন ভিয়েতনামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। উনিও একজন ব্যাকপ্যাকার। এ রকম পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের কাছে প্রকৃতির দুটো বড় আকর্ষণ থাকে- হয় সাগর না হয় পাহাড়, না হয় দুটোই। ওনার দুটোই ভাল লাগে, তবে সাগরের চেয়ে পাহাড়ের প্রতি তার আকর্ষণটা বেশী। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারেও তিনি বেশ আগ্রহী। এক মাস ভিয়েতনামে থেকে তিনি বাসে করে যান ক্যাম্বোডিয়া, সেখানে দু’সপ্তাহ ঘুরে তিনি চলে যান লাওস। লাওস থেকে থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল সফর করেন, সেখান থেকে দক্ষিণাঞ্চলেও যাবার কথা ছিল। ধনী দেশের নাগরিক রোযালী’র কাছে ভিয়েতনাম, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ড এর গল্প শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। খুব সুন্দর করে উনি সেসব দেশের ইতিহাসের, ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এবং সেসব দেশের সাধারণ মানুষের সৌহার্দ্যমূলক আচরণের প্রশংসা করেছেন। সেসব দেশের মধ্যে কেবল থাইল্যান্ডে আমরা একাধিকবার সফর করেছি। চীয়াং মাই, চীয়াং রাই এর কথা যখন তিনি বলছিলেন, আমরা তা রিলেট করতে পারছিলাম। থাইল্যান্ড এর পর তার যাবার কথা ছিল ইন্দোনেশিয়া, সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনী। সিডনী থেকে তার নিজ দেশে ফেরার কথা ছিল। এত বড় একটা সফরসূচী উনি সম্পন্ন করেছেন স্রেফ একা একাই। ইতোমধ্যে করোনার কারণে বাকী দেশগুলোতে ‘লকডাউন’ ঘোষিত হওয়ায় তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে ব্যাংকক-গুয়াংঝু-বেইজিং-মন্ট্রীয়েল এর টিকেট কিনে এখানে আসেন। কিন্তু গুয়াংঝুতে নেমে তিনি জানতে পারেন যে চীনের ভিসা না থাকার কারণে তিনি বেজিং যেতে পারবেন না। এর ফলে তাকে তিন হাজার ইউ এস ডলার গচ্ছা দিয়ে রি-রুটিং করে পুনরায় টিকেট ক্রয় করতে হয়েছে। তাও সরাসরি মন্ট্রীয়েল এর টিকেট পান নি বলে ভ্যাঙ্ক্যুভার পর্যন্ত টিকেট করেছেন। বাকীটা সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল আমরা ছাড়া বাদ বাকী সবার বাড়ী পৌঁছতে হবে একাধিক স্টেশন টাচ করে এবং ওদের ফ্লাইট টাইম ছিল দশ থেকে তের ঘন্টার। আমাদেরটা পৌনে চার ঘন্টার, এবং সরাসরি। আমরা বয়স্ক, তাই আমাদের সফরের বাকী অংশটা সরাসরি এবং সংক্ষিপ্ত হবে, একথা জেনে ওনারা সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
চায়না সাউদার্ন এর একজন স্টাফ এসে লাঞ্চ এবং ডিনারে আমরা কী খেতে চাই, তা টুকে নিল। অপশন মাত্র দুটোই ছিলঃ ভেজিটারিয়ান অথবা ‘অর্ডিনারী’ ডায়েট। ভেজিটারিয়ান না হয় বুঝলাম, কিন্তু ‘অর্ডিনারী’ ডায়েটে কী থাকবে তা জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, না দেখে উনি তা বলতে পারবেন না। অগত্যা আমরা ভেজিটারিয়ান ডায়েটই অর্ডার করলাম, লাঞ্চ এবং ডিনার, দুটোর জন্যই। ভাবলাম ভেজি ডায়েট, না জানি কেমন হবে! ওরা লাঞ্চ সার্ভ করে ঠিক দুপুর ১২ টায়, ডিনার সন্ধ্যে ৬ টায়। লাঞ্চবক্স হাতে পেয়ে কৌতুহল বশতঃ সাথে সাথে খুলে ফেললাম। লাঞ্চ দেখে তো পছন্দই হলো, এখন খেতে না জানি কেমন হয়! পরিমাণ মত সাদা ভাত, কচি শসা হালকা করে কাটা, আধা সেদ্ধ ফুলকপি, কাঁচা বাঁধাকপি ও লেটুস পাতা, চিকণ করে কাটা আলু হাল্কা ফ্রাই এবং মাশরুম ও কাটা জলপাই এর মিশ্রণ হাল্কা ফ্রাই। সবগুলোই খুব সুস্বাদু ছিল, শেষোক্তটা একটু বেশী। আগের রাতে অভুক্ত ছিলাম, তাই মুখে যেটাই দিচ্ছিলাম, সেটারই স্বাদ খুব মুখরোচক মনে হচ্ছিল। পেট ভরে গেল। বাকী পাঁচ জনের মধ্যেও তিন জন ভেজি ডায়েটই নিয়েছিলেন। যে দুই জন অন্য ডায়েট নিয়েছিলেন, সেখানে সসেজ ছিল, মীট ছিল, আর সালাদ ছিল।
খেয়ে উঠে যোহরের নামায পড়ে একটু চেয়ারে হেলান দিলাম। লক্ষ্য করলাম, কিয়াল স্মিথ খেয়ে দেয়ে উঠে আমার পাশের চেয়ারে বসে তার ল্যাপটপ খুলে বসেছে। ইমা মিশেলও তার পাশে বসে দেখছে। ল্যাপটপের পর্দায় চোখ পড়তেই বুঝলাম যে ওরা ফেইসবুক দেখছে। অবাক হ’লাম, চীনে না ফেইসবুক নিষিদ্ধ! আমি ওপাশে মাথা ঘুরিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম, ঘুমিয়েও পড়লাম। একটু পরে ওদের হাসাহাসিতে ঘুম ভাংলো। দেখি ওরা সবাই গল্পে মশগুল। ইতোমধ্যে সবাই বেশ আপন আপন হয়ে গেছে। কেউ চেয়ারে, কেউ মাটিতে বসে খোশগল্প করছে। আমিও ওদের সাথে যোগ দিলাম। কিয়ালের কাছে কথা শুরু করলাম, করোনা নিয়ে ওদের সরকারের ভূমিকা নিয়ে। ওর কথা শুনে বুঝলাম, ওদের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এর উপর ও খুবই নাখোশ। আমি ওর দেশ থেকে সদ্য প্রত্যাগত। আমার কিছুটা ধারণা আছে, ওদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে রাজনীতি সচেতন জনগণের একটা বড় অংশের কতটা অসন্তোষ রয়েছে। করোনা নিয়ে কথা বলতে বলতে স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক দাবানল নিয়ে কথা উঠলো। এ ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ ওরা, কিয়ালের চেয়ে ইমা বেশী। ইমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর দেখা মতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী কে? ও বললো, আমার জন্মের সময় যিনি ছিলেন, তিনি অর্থাৎ বব হক। তাকে যাচাই করার মত বয়স আমার হয়নি, কারণ আমার জন্মের পরপরই তিনি পদত্যাগ করেন, কিন্তু আমার পরিবারের কাছ থেকে জেনেছি যে উনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন এবং জনপ্রিয় ছিলেন। উনি পরপর চারবার নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং একটানা প্রায় নয় বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
আমি যখন কিয়াল এবং ইমার সাথে কথা বলছিলাম, তখন দেখি তার ল্যাপটপটা নিয়ে সেই লস এঞ্জেলিসগামী মহিলাদ্বয় ব্যস্ত। ঘন্টাখানেক পর সেটা রোযালী নিয়ে বসলো। কিয়াল আমার কানের কাছে এসে বললো, সে আমার সাথে ছেলেদের সেলফোনে কথোপকথন শুনে বুঝেছে যে আমরা তাদের নিয়ে এবং তারা আমাদের নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন। সে তার ল্যাপটপে একটা বিকল্প পদ্ধতিতে ভিপিএন দিয়ে ফেইসবুক চালু করতে পেরেছে। আমি সবার শেষে যাব বলে সে সবার শেষে আমাকে এ অফারটা দিচ্ছে, যে আগে যাবে তাকে আগে দিয়েছে। রোযালী’র পর আমরা ইচ্ছে করলে সন্ধ্যে পর্যন্ত তার ল্যাপটপে ফ্যামিলীর সাথে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাট করতে পারি। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে এ সুযোগটা নিতে রাজী হ’লাম। এর আগে সে বলেছিল যে সে আগামীতে বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চায়। এবারেই সে চেয়েছিল, ফেরার সময় মিয়ানমার ও ঢাকা হয়ে সিডনী যেতে। কিন্তু সময়াভাবে তা হলোনা। আমি তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগতম জানালাম এবং আমার একটি নেইম কার্ড দিয়ে ঢাকা আসার আগে আমাকে জানিয়ে আসতে বললাম। ওর সাথে কথা বলে মনে হলো যে ও আমাদের পার্বত্য জেলাগুলোর নৈসর্গিক শোভা সৌন্দর্য সম্বন্ধে অবগত। একটু পরে রোযালী এসে কিয়ালের ল্যাপটপটা আমার হাতে দিয়ে গেল। আমি ফেইসবুকে লগ-ইন করার সাথে সাথে প্রথমে ছোট ছেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা তুমি চীনে বসে ফেইসবুকে লগ-ইন করতে পারলে’? আমি বললাম, হ্যাঁ পারলাম এবং কি করে পারলাম, তা ব্যাখ্যা করলাম। এরপর একে একে বাকী দু’জন ছেলেও বৌমা সহ চ্যাট শুরু করলো। জরুরী কথাগুলো আগে সেরে নিলাম, পরের দিকে কিছু হাল্কা কথাবার্তাও হলো।
ঢাকা
০৬ এপিল ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ২২৩৩
চায়না সাউদার্ন এর সুস্বাদু ভেজিটারিয়ান লাঞ্চবক্স
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:০০