এর আগের পর্বটি পাবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপি-৩ঃ আজ বাইরে কোথাও যাচ্ছিনা, তাই ইতিহাস নিয়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাটিঃ
আমরা যখন অস্ট্রেলীয় ভিসার জন্য অপেক্ষমান ছিলাম, তখন হঠাৎ একদিন আমাদের বিয়াই সাহেব (মেজ বৌমার বাবা) আমাদেরকে টেলিফোন করে জানালেন যে ওনারাও নিতান্ত আকস্মিকভাবেই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটা ভাল অফার পেয়ে মেলবোর্নে যাওয়া-আসার টিকেট করে ফেলেছেন। ওনাদের যাত্রার তারিখ ২৭ ডিসেম্বর রাতে, ফেরত আসার তারিখ ১৬ জানুয়ারী ২০২০ রাতে। যদিও আমরা তখনো ভিসা পাইনি, তাই আমাদের অস্ট্রেলিয়া সফর অনিশ্চিত ছিল, তথাপি আমি ওনাদের এ চকিত সিদ্ধান্তের কথা জেনে খুব খুশী হয়েছিলাম, আমরা দুটো পরিবার একত্রে প্রবাসে আমাদের বাচ্চাদের সংসার দেখে আসবো একথা ভেবে। যেদিন ভিসাটা হাতে পেলাম, সেদিন এ আনন্দটা আরেকটু বেড়ে গিয়েছিল।
২৭ তারিখে আমার ছেলে ও বৌমা শহরের একটা শপিং মলে যাচ্ছিল ওনাদের জন্য বালিশ কেনার জন্য। ওদের ছোট সংসারে আলাদা বিছানা থাকলেও বালিশের কমতি ছিল। আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, আমরাও যেতে চাই কিনা। আমরা সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। Chadstone শপিং মলে কিছু কেনাকাটার পর আমরা De Elephant রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাসায় ফিরলাম। রেস্টুরেন্টটি রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়, আমরা সাড়ে নয়টায় গিয়ে কোনমতে শেষ অর্ডারটি দিতে পেরেছিলাম। তবে ডিনার মেন্যুর আইটেমগুলো খুব সুস্বাদু ছিল এবং মূল্যও মোটামুটি সাশ্রয়ী ছিল। তাই লাস্ট কাস্টমার হয়েও ভাল খাবার খেয়েছিলাম।
২৮ তারিখ এমনিতেও ছুটির দিন ছিল, তা না হলে সেদিন বিমানবন্দর থেকে বিয়াই বিয়াইনকে আনার জন্য ছেলেকে আলাদা করে ছুটি নিতে হতো। সকাল থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, ছেলে এবং বৌমা মিলে নানারকমের কি যেন প্ল্যান প্রোগ্রাম করছিল। আমি ভেবেছিলাম, ওদের আলাপ আলোচনা চলছিল বিয়াই-বিয়াইনকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার জন্য কিভাবে যাবে আসবে তা ঠিক করা নিয়ে। বৌমা রাতের খাবার তৈরী করা নিয়েও বিশেষ ব্যস্ত ছিল। পরে বুঝেছিলাম, এটা ছাড়াও ওদের আলোচনার অন্য এজেন্ডা ছিল। আমিও খানিক পরেই বুঝতে পেরে ওদের সেই এজেন্ডায় যোগ দিয়ে সবাই মিলে সাব্যস্ত করলাম, ওরা বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরে আসার পর বিয়াই বিয়াইনসহ গিন্নীর জন্মদিনের কেক কাটা হবে, কেননা ততক্ষণে রাত বারটা পার হয়ে যাবে, এবং তার পরের দিনই ছিল ওর জন্মদিন। কেকটা ওরা দিনের বেলাতেই এক ফাঁকে কিনে এনে লুকিয়ে রেখেছিল। সন্ধ্যা নামার একটু আগেই ছেলে ও বৌমা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল, আমরা ঘরেই থাকলাম। ওরা যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল, কেক কাটা সম্পর্কে মাকে আগে ভাগে কোন কিছু না জানাতে, ওরা ফিরে এসে বাকী সবকিছুর ব্যবস্থা করবে।
বিমান সময়মতই এসেছিল। ওরাও অতিথিদের নিয়ে অনুমিত সময়েই বাসায় এসে পৌঁছালে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়ার পর নানারকমের গল্প-সল্প শুরু হলো। বিয়াই বিয়াইন দু’জনেই ডাক্তার মানুষ, তাই স্বাস্থ্য সচেতন। ওনারা সাধারণতঃ রাত দশটার আগেই ঘুমিয়ে পরেন বলে জানি। আমি ভাবছিলাম, কখন না ওনারা আবার শুভরাত্রি বলে শয্যা নিতে চাইবেন। কিন্তু দেখছিলাম, এ ব্যাপারে ওনাদের কোন তাড়া নেই। তাই বুঝেছিলাম, ওনাদেরকেও জন্মদিন সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। ডিনার শেষ করতে করতে রাত বারটা আগেই বেজে গিয়েছিল। ডিনার শেষে পুনরায় টেবিল প্রস্তুত করে বার্থ ডে বেবীকে ডাকা হলো। তিনি এসব আয়োজন দেখে একাধারে চমকিত এবং অভিভূত হলেন। কেক কাটা, খাওয়া, খাওয়ানো এবং ফটো সেশন শেষ করতে করতে রাত দেড়টা বেজে গেল। সবাই আনন্দের রেশ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
পরেরদিন আমরা দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা শেষে সাব্যস্ত হলো, সবাই মিলে বাজার করতে যাব। বিয়াই সাহেব ভ্রমণ ক্লান্তিজনিত কারণে একটু নিমরাজী ছিলেন। আমরাও তার ইচ্ছেটাকে মেনে নিলাম। আমাদের বিয়াই বিয়াইন এর আগেও কয়েকবার অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন, তাই দেখলাম এখানকার পথঘাট সবই ওনাদের চেনা। কোথায় কী ভাল পাওয়া যায় এবং কোথা থেকে কি কিভাবে সাশ্রয়ে কেনা যায়, এসব ওনাদের ভালই জানা। ঠিক হলো, আমরা ড্যান্ডিনং মার্কেটে যাব। ছেলে কাজে যাবার সময় তার গাড়ীতে করে আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবে, ফেরার সময় উবার ডেকে চলে আসবো।
ড্যান্ডিনং মার্কেটে প্রবেশের আগে পার্কিংস্থলে নির্ভয়ে বিচণরত প্রথমে একটি এবং পরে কয়েক জোড়া সাদা কালো কাক দেখে কিছুটা বিস্মিত হ’লাম, কারণ এতদিন ধরে আমাদের দেশে শুধু ধূসর কালো পাতিকাক এবং ঘন কালো দাঁড়কাক দেখে এসেছি, সাদা কালো কাক কখনো চোখে দেখিনি। কাক ছাড়াও শালিক এবং অন্যান্য কিছু পাখি দেখলাম। এরা মানুষকে দেখে মোটেই ভয় পায় না, কারণ মানুষ কখনো এদেরকে ধরা তো দূরের কথা, এদের কোনপ্রকার ক্ষতি করে না। বরং ওদেরকে কাছে ডেকে খাবার দাবার দেয়। পরে গুগল ঘেটে দেখলাম, সাদা কালো কাকের প্রাপ্তিস্থান বা বলা যায় ওদের আড্ডাখানা এই অস্ট্রেলিয়াতেই এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের অন্যান্য দেশে।
পরেরদিন সন্ধ্যায় (৩০ ডিসেম্বর) আমরা সবাই মিলে একটি জনপ্রিয় আফগান রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে গেলাম। এক গাড়ীতে যেহেতু ছয়জন বসা যাবেনা, সেহেতু আমরা ‘উবার’ এ একটা বড় গাড়ী ডেকে রওনা হ’লাম। গাড়ীতে উঠে বুঝলাম, ওটাকে ৮ আসন বিশিষ্ট ‘বড় গাড়ী’ বলা হলেও পেছনে যারা বসে তারাই বুঝতে পারে সেটা কত বড়। যাবার সময় সবার উচ্চতা, পায়ের দৈর্ঘ্য, হেলথ কন্ডিশন ইত্যাদি বিবেচনা করে আমি আর বৌমা আগে আগে পেছনের আসনে গিয়ে বসলাম। পরে অন্যান্যরাও সামনের আসনগুলোতে উঠে বসলেন। পেছনে আমরা ঠিকমত বসতে পেরেছি কিনা, বিয়াই বিয়াইন উভয়ে তা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম, কোন অসুবিধে হচ্ছেনা। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর আমাদের অস্বস্তিটুকু আমরা আর লুকোতে পারলাম না, কারণ আমাদের পা দুটোকে কোণাকুণি রেখে বসতে হয়েছিল, পায়ের সামনে জায়গার অভাবে। এ নিয়ে বাকীরা সবাই কিছুটা হাসাহাসি করলেও, খানিক পরে তারাও আমাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করতে লাগলেন। ফেরার সময় বিয়াই সাহেবকে আর কিছুতেই আটকে রাখা গেল না। আমাদের অসুবিধের কথাটুকু মনে রেখে ফেরার সময় ‘উবার’ এর অন্য গাড়ীটিতে উনি সবার আগে গিয়ে পেছনের আসনে বসেছিলেন। তবে ভাগ্য ভাল, এবারের গাড়ীটা সত্যিই বড় ছিল, তাই আমার চেয়ে দীর্ঘ মানুষ হয়েও তিনি পা সোজা করে বসতে পেরেছিলেন।
৩১ তারিখে বিয়াই বিয়াইন ওনাদের ছেলের বাসায় চলে গেলেন। আমরা বিকেলে নতুন ইংরেজী বছর ২০২০ বরণ উপলক্ষে আয়োজিত নগর আলোকসজ্জা ও ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে যাব বলে ঠিক করলাম। তখন সূর্যাস্ত হতো পৌণে নয়টায়, অন্ধকার নামতে নামতে সোয়া/সাড়ে নয়টা বেজে যেত। আমরা আটটার আগেই মুরাব্বিন স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে রওনা হ’লাম। কফিল্ড থেকে ট্রেন বদল করে ফুটস্ক্রে স্টেশনে নেমে পড়লাম। এখানে নিয়ম হলো, প্রথমে সন্ধ্যা নামার পরে পরেই ফুটস্ক্রে পার্কে বাচ্চাদের জন্য আতশবাজি করা হয়, পথে আলোকসজ্জা তো থাকেই। প্রায় আধঘন্টা ধরে এ ফায়ার ওয়ার্কস চলে। এ অনুষ্ঠানটি শেষ হবার পর বাবা মায়েরা ঘরে ফিরে তাদের বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজেরা বের হয় মধ্যরাতের ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে। আমরা বাচ্চাদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানটি দেখে ইয়ারা নদীর তীরে চলে এলাম মূল ‘বর্ষবরণ ফায়ার ওয়ার্কস’ দেখতে। ব্যক্তিগতভাবে, ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে আমার তেমন আগ্রহ নেই, তবে এতদুপলক্ষে মানুষ জনের উচ্ছ্বাস এবং আনন্দানুভূতি দেখতে ভালই লাগে। ব্যস্ত জীবন ফেলে রেখে এরা প্রিয়জনদের নিয়ে ছুটে আসে ক্ষণিক আনন্দ লাভের জন্যে। মূল ফায়ার ওয়ার্কসও আগেরটার মতই আধ ঘন্টার মত স্থায়ী ছিল। রাত বারটা বাজার সাথে সাথে শুরু হলো নানা মাত্রার আতশবাজি। সবাই হৈহৈ করে একে অপরকে নতুন বছরের সম্ভাষণ জানাতে থাকলো। চালাক লোকজন (মূলতঃ দক্ষিণ এশীয়) অনুমান করে ফায়ার ওয়ার্কস শেষ হবার কয়েক মিনিট আগে থেকেই ট্রেন/বাস/ট্রাম ধরার জন্য পিছু ফিরতে শুরু করে। আমি চালাক না হলেও তেমনটিই চাচ্ছিলাম। কিন্তু বাকীরা অনুষ্ঠানের শেষ না দেখে ঊঠবে না বলে আমাকেও অগত্যা অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চোখের সামনে দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল। একটু তাড়াহুড়ো করলে ট্রেনটাকে ধরা যেত, কিন্তু আমরা তা করলাম না। পনের/বিশ মিনিট প্লাটফর্মে বসে থেকে পরের ট্রেনে চেপে বাসায় ফিরে এলাম।
আমার কাছে এখানকার ফায়ার ওয়ার্কস তেমন আহামরি কিছু বলে মনে হয়নি। পরেরদিন অনেকের ফেইসবুক পোস্ট দেখে মনে হলো, ঢাকার ফায়ার ওয়ার্কস এর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১০ মার্চ ২০২০
শব্দ সংখ্যাঃ ১১২৫
কালো-সাদা কাক দম্পতি/Black and white crow couple
কালো-সাদা কাক দম্পতি/Black and white crow couple
মুরাব্বিন স্টেশন প্ল্যাটফর্ম- বাঁয়ে বাঁক নেয়া লাইন জোড়া আমাদের সিটি সেন্টারে নিয়ে যায়......
Moorabbin Station Platfom. The lines that take us to the city....
ফুটস্ক্রে পার্কে ফায়ার ওয়ার্কস/Fireworks at Footscray Park
ফুটস্ক্রে পার্কে ফায়ার ওয়ার্কস/Fireworks at Footscray Park
আলোকসজ্জা ও আতশবাজি
Illumination and fireworks
আলোকসজ্জা ও আতশবাজি
Illumination and fireworks
আলোকসজ্জা/Illumination
আলোকসজ্জা/Illumination এর চিত্রধারণের প্রচেষ্টা