০৬ মে ২০১৯, সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। শ্রীনগরের চেয়ে প্যাহেলগামে শীত অনেক বেশী ছিল। আগের রাতে হোটেলের হাউস কীপিং বিভাগের এক লোক এসে দেখিয়ে দিয়েছিল, বিছানার গদির নীচে লম্বালম্বি রাখা বৈদ্যুতিক দন্ডের তাপ কিভাবে কমাতে বাড়াতে হবে। শোয়ার সময় তাপমাত্রার সুইচটাকে ‘মিডিয়াম’ এ দিয়ে শুয়েছিলাম। মাঝরাতে একবার প্রচন্ড গরমে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে সুইচটাকে ‘অফ’ করে রেখেছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর আলস্যভরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আগের দিনের তোলা ছবিগুলো এডিট করতে থাকলাম, মাঝে মাঝে ফেইসবুকিং ও চলতে থাকলো। বাকী দু’জন তখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। এক সময় উঠে গোসল সেরে এসে বাকী দু’জনকে ডেকে তুললাম। একজন গোসলে গেল, আরেকজন আলস্যভরে আবার চোখ বন্ধ করলো। ধীরে ধীরে সবাই তৈরী হয়ে নেবার পর ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। আগের রাতে যখন ডিনার করেছিলাম, তখনই ব্রেকফাস্টের মেন্যু দিয়ে রেখেছিলাম। যে ছেলেটা মেন্যু জানতে এসেছিল, তার নাম জিজ্ঞেস করাতে সে জানিয়েছিল ‘শিব্বির’। এবারে আর তাকে তার নামের বানান জিজ্ঞেস না করেও বুঝে নিলাম শিব্বির বা SHIBBIR, যা আমাদের ভাষায় হয়ে যায় শাব্বির।
নাস্তার পর ঔষধ ইত্যাদি খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। তখনো হাতে কিছু সময় আছে। আমরা নীচে নেমে হোটেলের ল’নে বসে কিছু ছবি তুললাম। আরও কিছু এটা সেটা করে বেলা ঠিক এগারটায় হাতে প্রচুর সময় নিয়ে শ্রীনগর বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ইচ্ছে ছিল, পথে যদি কোন সুন্দর ফুলবাগান পাই (যা পাওয়া যাবে বলে শাফি আগের দিন ধারণা দিয়েছিল), তবে সেখানে নেমে আমরা কিছু ছবি তুলে নেব। আগে থেকে সাব্যস্ত ছিল যে আমরা প্যাহেলগাম থেকে সরাসরি শ্রীনগর বিমান বন্দরে যাব, কিন্তু গাড়ীতে ওঠার পর শাফি বললো, মানযুর সাহেব তাকে শ্রীনগর শহর হয়ে যেতে বলেছেন, এতে আধা ঘন্টার মত অতিরিক্ত সময় লাগবে। শুনে আমি একটু অবাক হ’লাম, কারণ মানযুর সাহেবের পাওনা টাকা পয়সা সব মিটিয়ে দিয়েই আমরা শ্রীনগর ছেড়ে প্যাহেলগামে এসেছিলাম। যাহোক, হাতে যথেষ্ট সময় থাকাতে আমি কোন আপত্তি করলাম না। পথে বারবার শাফিকে ফুলবাগানের কথা স্মরণ করাতে থাকলাম, সে এটা সেটা বলে এড়িয়ে যেতে থাকলো। আমরাও এ নিয়ে আর খুব একটা জোর বা জেরা করলাম না।
প্যাহেলগাম থেকে ফেরার সময় ১০ নং পর্বে উল্লেখিত সেই “আই লাভ ইউ, হেনা” লেখা প্রস্তর খন্ডটার ছবি তোলার কথাটা বেশ মনে ছিল। তাই গাড়ীতে উঠেই শাফিকে বলেছিলাম, আমি পথের একটি জায়গায় একটি পাথরের ছবি নেব। কোথায় গাড়ী থামাতে হবে বা স্লো করতে হবে, তা আমি আগে থেকেই তাকে জানাবো, সে যেন তদনুযায়ী গাড়ী থামায়, থামানো সম্ভব না হলে অন্ততঃ যেন একটু স্লো করে। কি কারণে আমি একটি পাথরের ছবি তুলতে আগ্রহী ছিলাম, সে অভিপ্রায়টা আমি নিজের কাছেই গোপন রেখেছিলাম। সেটি শাফিও যেমন জানতো না, আমার স্ত্রী পুত্রও তেমন জানতো না। ওরা ভেবেছিল, আমি কোন সুন্দর পাথর ছড়ানো দৃশ্যের চিত্র ধারণ করতে চাই। তাই পথে যেখানে যেখানে ওরা কিংবা শাফি সুন্দর সুন্দর পাথর দেখতে পেয়েছে, তখনই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, গাড়ী থামাবে কি না। অপ্রশস্ত রাস্তায় আমাদের গাড়ীর পেছনে পেছনে অনেকগুলো গাড়ী আসছিল। তাই অস্থিরতার এবং নিরাপত্তার কারণে আমি সেই পাথরটা খোঁজার ব্যাপারে মনযোগ হারিয়ে ফেলেছিলাম। একটা জায়গায় এসে আমি বুঝতে পারলাম যে পাথরটাকে আমি পেছনে ফেলে এসেছি। সেখান থেকে পাথর খোঁজার ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহী দেখে শাফি বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলো, গাড়ী ঘুরাবে কিনা। আমি বললাম, সামনে চলতে থাকো।
ফেরার সময় আবার সেই ঝিলাম নদীর আরো কিছু ছবি তুললাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, গাড়ীটাকে কোথাও পার্ক করে রেখে হেঁটে গিয়ে কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসি, কিন্তু সময় বড় বালাই। পুনরায় সেই সমতল পথের দু’পাশের শ্যামলিমা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। একটা জায়গায় কিছু গাছ দেখিয়ে শাফি বললো, এগুলো উইলো গাছ, এগুলো দিয়ে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেট ব্যাট তৈরী হয়। শ্রীনগর শহরের কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে একটা তোরণ নজরে এলো, যার উপরে লেখা, “WELCOME TO BADAMI BAGH CANTONMENT”। শাফি বললো, এটা সেখানকার সবচেয়ে বড় সেনানিবাস। আবার সেই ডাল লেইকের তীরে এসে শাফি মানযুরকে ফোন দিল। শীঘ্রই মানযুর এসে জানালো, আমার ঢাকার ট্রাভেল এজেন্ট সাঈদ হাসান ওকে অনুরোধ করেছে, আমার মাধ্যমে যেন ওর কাছে সে কিছু নাটস পাঠিয়ে দেয়। আমরা গাড়ীতেই বসে থাকলাম, মানযুর কিছু নাটস কিনে এনে একটা ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর তার সাথে বিদায়ী শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমরা শ্রীনগর বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে গাড়ী ঘুরালাম। এইটুকু রাস্তা ডিট্যুর করাতে আমাদের তেমন কোন অসুবিধে হয়নি, তবে শাফির মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা বলার সময় তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল, কোথা থেকে যেন তার কাঁধে কামানের গোলা এসে পড়ছিল। সেকথা একটু পরে বলছি।
আসার সময় শাফি একবার আমাকে হঠাৎ করে জিজ্ঞ্যেস করে বসলো, স্যার ভাইয়া কাব শা’দী কারেগা? ওর এই প্রশ্নটা শুনে ভাইয়াও যেমন একটু অপ্রস্তুত হলো বলে মনে হলো, আমিও একটু হতচকিত হয়েই নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে বললাম, এখনো দেরী আছে। সে আমার কথাটাকে লুফে নিয়ে বললো, স্যার আমি বিয়ে করবো আগামী ঈদুল আযহা’র দু’সপ্তাহ পর, আপনাদের সবার দাওয়াৎ থাকলো। তখন আমি বুঝতে পারলাম, হঠাৎ করে ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারে তার খোঁজ নেয়ার আসল কারণটা কী ছিল। নিজের খবরটা দিতেই সে অতি উদগ্রীব ছিল। তাকে অভিনন্দন জানানোর কোন ফুরসৎ আমাকে না দিয়ে সে তার হবু বউ এর ব্যাপারে বেশ আগ্রহ সহকারে একটার পর একটা বর্ণনা দিতেই থাকলো। যখন সে তার বউ এর ব্যাপারে কথা বলছিল, তখন তার মুখে এক ধরণের আভা খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার যখন কোন ফোন আসছিল, তখন আবার মনে হচ্ছিল সেই কামানের গোলার কথা। একবার সে কলটা কেটে দিয়ে ব্যাজার মুখে আমাকে বললো, “স্যার কাশ্মীরি আওরাতোঁ কো মিজাজ মার্যি ইধারকা মাওসুম য্যায়সা, কাভি জ্বালতি হ্যায় সুরুজ, কাভি বারিশ!” আমি মনে মনে বললাম, এই বয়সে আর দেখেছো কি, আরো বড় হও বাছা!
চলতে চলতে একটা সময় সে আমাকে মুখ ফুটে জানালো, অনেকদিন পর সে আর তার হবু বউ দু’জনে একসাথে কিছুটা ফ্রী টাইম পেয়েছে, তাই আমাদেরকে বিমান বন্দরে নামিয়ে দিয়ে সে আর তার বাগদত্তা কিছুটা সময় একসাথে ঘুরে ফিরে কাটাবে। বিমান বন্দরের প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছিলাম, সেখান থেকে অল্প একটু পথ সে তার হবু বউকে আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেবে। আমি তার আর্জেন্সীটুকু উপলব্ধি করে আর আপত্তি জানালাম না। সামনের আসনে শাফি’র পাশে সে যেন বসতে পারে, সেজন্য আমি আগে থেকেই পেছনের আসনে এসে বসেছিলাম। একটু পরে সে এক জায়গায় গাড়ীটা থামিয়ে তার বউকে দিক নির্দেশনা দিয়ে চলে আসতে বললো। কিন্তু এবারেও তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আর তার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, গাড়ীটা তার যে জায়গায় থামানোর কথা ছিল, তার থেকে সে কিছুটা দূরে থামিয়েছে, তাই তার বাগদত্তাকে রৌদ্রের মাঝে কিছুটা পথ হেঁটে আসতে হবে, সুতরাং আবারও সেই কামানের গোলা!
একটু পরে তার হবু বউ গাড়ীর কাছে আসলো। আমাদেরকে দেখে সে ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে কোন রকমে একটা সালাম দিয়ে গাড়ীর সামনের সীটে বসে দরজাটা লাগালো। শাফি আবার গাড়ী চালাতে শুরু করলো। মেয়েটির আড়ষ্টতা কমানোর জন্য আমার স্ত্রী তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে এতটাই কাঁচুমাচু করে অত্যন্ত নীচু স্বরে তার নামটা বললো যে আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। তাই আমি এবারে তার নাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম। সে আগের চেয়ে একটু জোরে বললো, “কুলসুম”। শাফিও তাকে কিছুটা নরমাল করার জন্য এটা সেটা বলে হাসাতে চাইলো, কিন্তু সে লাজুকলতা হয়েই বসে রইলো। দেখতে দেখতে বিমান বন্দরের একেবারে সন্নিকটে চলে এলাম। প্রথম চেকপোস্টে এসে শাফি বললো, এখানে সবাইকে নেমে নিরাপত্তা তোরণের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এমনকি লাগেজও সব নামিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে। আমরা তাই করলাম। নিরাপত্তা প্রহরীরা আমাদের টিকেট দেখতে চাইলো না, শুধু আমাদের দেহ আর লাগেজ স্ক্যান করলো। তাদের চেকিং শেষ হবার পর শাফি লাগেজগুলো গাড়ীতে তুললো। হাসতে হাসতে সে তার বউকে দেখিয়ে বললো, ভাগ্যিস প্রহরীরা টিকেট চেক করে নাই, করলে ওকে এখানেই রেখে যেতে হতো! এ কথা শুনে কুলসুম আরও কিছুটা আড়ষ্ট হলো বলে মনে হলো। আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে এখনো পড়াশোনা করছে কি না। সে জানালো, তার নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্স কেবলই শেষ হয়েছে।
বিমান বন্দর এসে গেল। এবারে শাফি আর তার বউ এর কাছ থেকে আমাদের শেষ বিদায় নেয়ার পালা। গাড়ী থেকে নেমে আমার ছেলে একটা ট্রলী নিয়ে আসলো। সে আর শাফি মিলে লাগেজগুলো ট্রলীতে উঠালো। বিমান ছাড়ার তিন ঘন্টা বিশ মিনিট আগে আমরা বিমান বন্দরে পৌঁছেছিলাম। তাই তখনো গাড়ী বা প্যাসেঞ্জারের ভিড় লাগেনি। শাফি অনুমতি চাইলো একটি গ্রুপ সেলফী তোলার। আমরা রাজী হ’লাম, কিন্তু তার বউকে এতে তেমন আগ্রহী বলে মনে হলো না। শাফিকে গত পাঁচদিনে তার সেবার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তার টিপস মিটিয়ে দিলাম। সে খুশী হয়ে কোলাকুলি করার জন্য বুক এগিয়ে দিল। আমিও তাকে বুকে জড়িয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। পারস্পরিক শুভকামনা বিনিময়ের পর ওরা দু’জন গাড়ীতে গিয়ে বসলো। কুলসুমও গাড়ীতে ওঠার আগে এবারেই প্রথম একটা স্বাভাবিক হাসি দিল। বুঝলাম, সেদিনের জন্য তার খুশীর প্রহর শুরু হলো, শাফি’র উপরেও কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বোধকরি। ওরা আগে চলে গেল। আমরা ওদেরকে বাই বাই দিয়ে ট্রলী ঠেলে টার্মিনাল ভবনে প্রবেশের জন্য অগ্রসর হতে থাকলাম।
ঢাকা
০৮ জুলাই ২০১৯
"গোল্ডেন রেসিডেন্স" এর পরিচারক শিব্বির আহমেদ এর সাথে....
With Shibbir Ahmad, a Kashmiri young man who looked after us at "Golden Residence".
গাড়ী থেকে তোলা ঝিলাম নদীর ছবি
Picture of Jhelum River at Pahelgam, taken from our Jeep.
গাড়ী থেকে তোলা ঝিলাম নদীর ছবি
Picture of Jhelum River at Pahelgam, taken from our Jeep.
সমতল রাস্তার পাশে সবুজ শ্যামলিমা
Greenery astride the road
এগুলো উইলো গাছ, এগুলো দিয়ে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেট ব্যাট তৈরী হয়।
Willow trees astride the road. World's best cricket bats are made from these.
শ্রীনগরের "বাদামি বাঘ সেনানিবাস" এর স্বাগত তোরণ।
Welcome arch at the entrance of "Badami Bagh Cantonment" at Srinagar.
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৯