(আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণ শিরোনামে আমার লেখা এই সিরিজের ১১টি পর্ব ইতোপূর্বে এই ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরে যখন ভূস্বর্গ কাশ্মীর রক্তাক্ত হতে শুরু করলো, তখন আমার বাকী চারটি পর্ব প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আজ আমার তোমাদেরই মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই পোস্টে ব্লগার রাজীব নুর এর মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে মনে হলো, বাকী চারটি পর্বও প্রকাশ করা উচিত।)
আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণ- ১১: প্যাহেলগামের চন্দনওয়ারীতে ঝটিকা সফর
আমাদের হাতে সময় খুবই কম ছিল। এক চন্দনওয়ারী দেখতে দেখতেই বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। ততক্ষণে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা থেমে গেল। এতদিনে শাফি’র সাথে ঘুরতে ঘুরতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে কিছু না জিজ্ঞেস করলেও ও আমাদেরকে গল্পচ্ছলে অনেক কিছু জানাতো। আর কিছুক্ষণ পর পর ও আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো, কাশ্মীর আমাদের কেমন লাগছে? আমি কখনো কখনো নিজেও উচ্ছ্বাসভরে ওকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতাম, আবার কখনো হুঁ হাঁ করে ওর কথার সাথে সায় দিতাম। কিন্তু প্যাহেলগামের এ চালকের সাথে তেমন ভাব জমেনি, এমনকি এতক্ষণ ওর মুখের দিকেও ভালভাবে তাকিয়ে দেখিনি। আমরা আমাদের রেইনকোট ইত্যাদি ফেরত দিয়ে যখন গাড়ী/ড্রাইভারকে খুঁজছি, তখন আমার খেয়াল হলো যে আমি চালকের চেহারাটাও ঠিকমত দেখিনি, তাই এখন ওকে আমার পক্ষে খুঁজে বের করা মুশকিল। আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, সে তাকে দেখলে চিনতে পারবে কিনা। ওর উত্তরে বুঝলাম, সেও ওকে ভাল করে মনে রাখেনি, তবে সে জানালো গাড়ীর নাম্বারটি তার মনে আছে। আমার উদ্বেগ লক্ষ্য করে সে সামনে একটু হেঁটে গিয়ে চালকসহ গাড়ী সনাক্ত করলো। আমরাও তখন হেঁটে গিয়ে গাড়ীতে উঠলাম।
এবারে গাড়ীতে উঠে আমি চালকের চেহারাটা ভাল করে দেখে নিলাম। বয়স হয়তো হবে বড় জোর বছর চব্বিশ পঁচিশেক, চেহারায় একটা ইনোসেন্সের ছাপ আছে। বেশভূষায়ও সে শাফির মত পরিপাটি ছিল না, দারিদ্র্যের না বলে বলবো একটা মলিনতার ছাপ ছিল। ওকে বললাম, পরবর্তী গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে। এতক্ষণ ওর নামটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি, তাই ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, রীহান। এতদিনে যত কাশ্মীরিদের নামের কথা শুনেছি, দোকানের সাইনবোর্ডে দেখেছি (ওখানে প্রায় সব ধরণের দোকানের সাইনবোর্ডেই প্রোপ্রাইটর বা মালিকের নাম উর্দু’র পাশাপাশি ইংরেজীতেও লেখা থাকে), তার সবই আমাদের চেনাশোনা মুসলিম নাম। এ নামটাকে একটু অন্যরকম মনে হওয়ায় আমি ওকে ওর নামটা ইংরেজীতে বানান করতে বললাম। সে বানান করে বললো REIHAN। আমি বুঝে নিলাম, এটা আমাদের রায়হান। রায়হান আর রীহান এর মাঝামাঝি আমি তাকে রেহান বলে সম্বোধন করতে থাকলাম। লক্ষ্য করলাম, সে আমার প্রতিটি কথার উত্তর দেয়ার সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। আমি ওকে বললাম, রেহান, এই পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে তুমি যখন সামনে না তাকিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাও, আমার তখন বড্ডো ভয় করে। আমি ওকে সামনে তাকিয়েই আমার কথার উত্তর দিতে বললাম। সে বললো, স্যার এটাই আমাদের আদব, জ্যেষ্ঠ কারো সাথে কথা বলতে হলে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। যাহোক, আমি পুনরায় নিষেধ করার ফলে সে এর পর থেকে সরাসরি না তাকিয়ে কোণাকুণি তাকিয়ে কথা বলতে থাকলো।
রেহান আমাকে এক সময় জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনার দেশে প্রাইভেট ড্রাইভাররা কত টাকা বেতন পায়? আমি আমার চালককে যত বেতন দেই, সেটাই ওদের মুদ্রায় কনভার্ট করে ওকে বললাম। ও একটু আফসোসের সাথে বললো, আমি মাঝে মাঝে বাইরে কোথাও যেতে চাই, কিন্তু আমার উপর সংসারের যা বোঝা, তাতে সেটা কখনো সম্ভব নয়। তারপরে সে তার বোঝার যে বিবরণ দিল, তা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তার বাবা মা উভয়ে এখন এতটা বৃদ্ধ, যে ওনারা এখন তেমন কোন কাজ করতে পারেননা। ওরা দশ ভাই বোন, তার মধ্যে ও সবার ছোট এবং একমাত্র ভাই। বড় নয় বোনের মধ্যে অনেকগুলোর এখনো বিয়ে দিতে পারেনি। আমি ওকে বললাম, তুমি তো খুব ভাল গাড়ী চালাও। তুমি অন্যান্য ভারতীয়দের মত কাউকে ধরে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাও না কেন? এর উত্তরে সে বোনদের কথা বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে বললো, স্যার আমার বোনেরা আমাকে খুব ভালবাসে। আমার বড় বোন আমাকে মায়ের মত ভালবাসে। এই বোনদেরকে ছেড়ে আমি কোনদিন কোথাও যেতে পারবো না। ওর কথা শুনতে শুনতে আমার নিজেরও প্রয়াত বড় বোনের কথা মনে পড়ে আমারও মনটা আর্দ্র হয়ে উঠলো। আমার বড় বোনও আমাকে বড় ভালবাসতেন।
চলতে চলতে নীচে বহমান একটি নদীর দিকে তাকিয়ে আমি রেহানকে নদীটির নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, “শীষনাগ”। নামটা শুনে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে অনেক সাপ টাপ আছে নাকি? সে বললো সে তার জীবনে একটাও সাপ দেখেনি। শুনে আমি অবাক হ’লাম। দেখতে দেখতে বেতাব উপত্যকায় চলে এলাম। রেহান জানালো, ভারতীয় ছবি বেতাব এর শুটিং এখানেই হয়েছিল। মনে পড়ে গেল, ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বেতাব ছবিটা ১৯৮৭ সালে আমরা যখন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলাম, তখন ভিসিআর এ আমরা স্বামী স্ত্রী মিলে দেখেছিলাম। ছবিটি সে সময়ে হিট ছিল, সানী ডিওল আর অমৃতা সিং এর ডেব্যু ফিল্ম ছিল সেটা। অবশ্য নায়ক-নায়িকা হিসেবে ওদের দু’জনের কেউই আমার খুব একটা পছন্দের ছিল না। যাহোক, সেদিনের সেই পড়ন্ত বিকেলে বেতাব উপত্যকায় নেমে পড়লাম, দ্রুত এলাকাটিকে দেখে নেয়ার জন্যে। এবারে গাড়ী থেকে নেমে আমরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। স্ত্রী ও ছেলে তাড়াতাড়ি তাড়াহুড়ো করে দেখে নেয়ার জন্য প্রস্থান করলো, আমি ধীরে সুস্থে চারিদিকে দেখছি আর বিমোহিত হচ্ছি। চন্দনওয়ারীতে যখন ছিলাম, তখন ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। মাত্র আধা ঘন্টা পরে বেতাবে যখন নামলাম, তখন আকাশ পরিষ্কার, সূর্য বেশ খানিকটা হেলে পড়ে পাহাড়, উপত্যকা ও বহমান নদী ও জলধারাকে এক সোনালী আভায় উদ্দীপ্ত করে রেখেছে। তাপমাত্রা উপভোগ্য। আমার ওযু ছিল, তাই এক নিরিবিলি জায়গায় বসে আসর এর নামায আগে পড়ে নিলাম। তারপর বহমান স্রোতস্বিনীর (বেতাব নদীর) পাশে এক বিশাল প্রস্তরখন্ডের উপর কিছুক্ষণ বসে আনমনা কল্লোলিনীর বয়ে চলা দেখলাম। অগভীর নদীবক্ষে ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটানো বিশাল বিশাল শিলাখন্ডের সাথে আঘাতে আঘাতে নদীর স্রোতধারা মাঝে মাঝে রুদ্রমূর্তি ধারণ করছিল বটে, তবে পরক্ষণেই আবার মিলিয়ে গিয়ে তিরতির করে সরু সরু নালায় বিভক্ত হয়ে আপন পথ খুঁজে নিচ্ছিল।
আমি এগিয়ে চললাম, আর ছবি তুলতে থাকলাম। একেক স্থানে একেক রকমের সৌন্দর্য। আফসোস হচ্ছিল, কেন আরেকটু আগে এলাম না। যাহোক, পরে আসাতে আরেক রকমের সুবিধে পেলাম, সেটা হলো নিরিবিলি পরিবেশ। ততক্ষণে পর্যটকদের ঢল প্রস্থানরত, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পর (ভেজা মাটি দেখে বুঝলাম) আকাশ পরিষ্কার। উপার্জন প্রত্যাশী ‘গাইড’দের সংখ্যা কমে গেছে, নেই বললেই চলে। আমরা একা একাই স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেরাতে থাকলাম। ততক্ষণে আমার স্ত্রী ও ছেলে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।
নদীটাই আমাকে বেশী করে আকর্ষণ করছিল। তাই ঘুরে ফিরে ঐ নদীটার পাশে পাথরে বসে, নদীর উপরে বেইলী ব্রীজে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে ভাল লাগছিল। এক সময় আমিও হাঁটা শুরু করলাম। পশ্চিমের সূর্যটা পূবের পাহাড়ের পাদদেশে এক অদ্ভূত মায়াবী সোনালী চাদর বিছিয়ে রেখেছিল। ছবি তুলতে গিয়ে দেখি, স্বয়ং আমার ছায়াটাকেও বড় সুন্দর লাগছে। ঘন সবুজ কার্পেটের মত ঘাসের উপর দিয়ে এক জোড়া কাক খুঁটে খুঁটে পোকা মাকড় খাচ্ছিল। বৃত্তাকার পথে এসব দেখতে দেখতে একসময় আবার প্রধান ফটকের সামনে এসে দেখতে পেলাম, আমার স্ত্রী ও ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ইতোমধ্যে ওরা রেহানকে একবার পাঠিয়েছেও, আমার খোঁজে। বেতাব ত্যাগের আগে আমার স্ত্রী কল্লোলিনী নদীটির পাশে পাথরে বসা আমার একটা স্বল্পক্ষণিক ভিডিও ক্লিপ ধারণ করেছিল, কিন্তু সেটা আমার ক্যামেরায় নয় বলে এখানে দিতে পারলাম না।
ঢাকা
১৬ জুন ২০১৯
Pahalgam Development Authority কর্তৃক স্থাপিত স্বাগত বাণী
Welcome post by Pahalgam Development Authority
একা
In solitude
এক টুকরো নিরিবিলি শান্তির আশ্রয়, যেখানে সময় থেমে থাক বলে মন চায়।
A serene place, where time seemed to stop!
উপরে পাহাড়ের চূড়ায় তখনো আলোর খেলা, নীচে প্রলম্বিত তরুছায়া।
Sunlight is there, still on top. Shades spreading out beneath.
আবার আসিব ফিরে, এই নদীটির তীরে, কোন একদিন.....
I want to be there, again!
জলের বুকে কার ছায়া পড়েছে?
Whose shade is that?
ঐ বেঞ্চিটাতে বসেই আমি একা একা আসর এর নামায পড়ে নিলাম, বেঞ্চিটা ছিল প্রায় ক্বিবলামুখী।
Offered my Asr prayers, sitting on that bench, as it was almost facing Qibla.
প্রশান্তি
Serenity
কোন এক নির্জন এলাকায়, যেখানে শুধু পানির কুলুকুলু বয়ে যাওয়া ধ্বনি শোনা যায়.....
At a quiet place, only the sound of the flowing water was audible.
জলের গান কান পেতে শুনি....
Lost in the music of silence....
বিদায়ী আলোর শেষ ছটা
The last sunshine
অপসৃয়মান সূর্যালোক, দীর্ঘায়িত ছায়া
Twilight approaching, shadows lengthening!
রৌদ্রছায়ার খেলা......
A beautiful contrast of sun and shade!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪০