আমরা আমাদের কামরায় ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। যোহরের নামায পড়েই আধা ঘন্টার মধ্যেই আবার রওনা হ’লাম প্যাহেলগামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য। শাফি জানালো, সে আমাদেরকে প্যাহেলগামের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকবে। সেখান থেকে আমাদেরকে স্থানীয় চালক দ্বারা চালিত ট্যাক্সি বা মিনিবাস ভাড়া করতে হবে। আমরা ফিরে আসার পর আবার আমাদেরকে নিয়ে হোটেলে যাবে। ঐ এলাকায় তার মত প্যাহেলগামের বাইরে থেকে ট্যুরিস্ট নিয়ে আসা চালকদের গাড়ী চালানোর অনুমতি নেই। পরে স্থানীয় চালকের সাথে আলাপ করে জানলাম, এর পেছনে দুটো কারণ রয়েছেঃ এক, স্থানীয় চালকেরা এবং পরিবহণ মালিকেরাও যেন ট্যুরিস্টদের থেকে দুটো পয়সা কামাই করতে পারে, সবই যেন রাজধানী শ্রীনগর থেকে আসা চালক ও মালিকদের পকেটে না যায়, সে জন্যেই এ ব্যবস্থা। এটা না করলে দোকানদারি করা ব্যতীত ওখানকার পাহাড়ী চালকদের রোজগারের আর কোন পথ থাকবে না। দুই, দুর্গম পাহাড়ী পথের প্রতিটি বাঁক স্থানীয়দের মুখস্থ। বাহির থেকে আসা চালকদের পক্ষে এসব পাহাড়ী সরু আঁকাবাঁকা পথে গাড়ী চালানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কারণের সত্যতা আমরা গাড়ী ভাড়া করে চন্দনওয়ারীর পথে যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম।
হোটেল থেকে বের হয়েই রাস্তার পাশে লাল রঙের, বন্ধ দুটো লাল গেইটে লাল পতাকা ওড়ানো দুটো মন্দির আকৃতির একতলা ঘর দেখতে পেলাম। শাফিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ও দুটো এখানকার মন্দির। চন্দনওয়ারীতে প্রাচীন মঠ রয়েছে। সেখানে প্রতি বছর হিন্দু ভক্তেরা “পদযাত্রা” করে। কাশ্মীরে এসে এই প্রথম কোন মন্দির চোখে পড়লো। যাহোক, শাফি যখন আমাদেরকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে একটি মিনিবাস ঠিক করে দিল, তখন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এমনিতেই প্যাহেলগামে উচ্চতার কারণে শ্রীনগরের চেয়ে ঠান্ডা বেশী। তার উপর হাল্কা বৃষ্টি শুরু হওয়াতে বেশ ঠান্ডা অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার আবার গলায় ঠান্ডা লেগে যায় অতি দ্রুত, তাই গলায় একটা কমফোর্টার পেচিয়ে নিলাম। গাড়ী যতই এগোতে থাকলে, রাস্তা ততই সরু হতে থাকলো এবং উঁচুতে উঠতে থাকলো। রাস্তার দু’পাশে এত সুন্দর দৃশ্য, ইচ্ছে হচ্ছিল থেমে কিছু ছবি তুলে নেই। কিন্তু উপায় ছিল না, কারণ থামার মত কোন জায়গা সুবিধামত পাওয়া যাচ্ছিল না, আবার এত থামাথামি করলে এই দুর্গম পথে চালকের কনসেন্ট্রেশনে ব্যাঘাত ঘটবে, এই ভেবে থামতেও চাচ্ছিলাম না।
বেলা সাড়ে চারটার দিকে চন্দনওয়ারীতে পৌঁছলাম। আকাশে তখন মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়েই হিম হয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাসের হল্কা এসে গরম পোষাকের আবরণ ভেদ করে গায়ে কাঁপুনি তুলে যাচ্ছিল। আবার একটু পরেই মেঘ ফুঁড়ে সূর্যের হাসিমুখ উঁঁকি দিচ্ছিল। আবার দেখা শুরু হলো সেই শ্বেতশুভ্র তুষারের বিস্তীর্ণ ঢাল, যা আগে দেখেছিলাম সোনামার্গ এবং গুলমার্গে, তবে সেগুলো ছিল উপত্যকায়, আর এখানে পাহারের প্রায় শীর্ষে। তুষারাবৃত পথ পিচ্ছিল থাকে, তাই অনভ্যস্তদের লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়। আমরাও লাঠি ভাড়া করলাম। আমার ছেলে আফনান সে পথ বেয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল, আমরা পেছনে পড়ে রয়েছি দেখে সে আর বেশী এগোয়নি, পাছে আমাদের যদি কিছু হয়! ফিরে এসে ফটো তোলায় অনিচ্ছুক সে এবারে আমাদের সাথে বেশ কয়েকটি ছবি তুলতে রাজী হলো। প্যাহেলগাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (পিডিএ) চন্দনওয়ারী এলাকা সফরের জন্য পর্যটকদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা সাইনবোর্ড সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, বুঝলাম সেটা না হয় আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু বোধহয় তাদেরই কোন কর্মচারী আরেকটু এগিয়ে বরফাচ্ছাদিত এলাকার পাশে একটা কালো পাথরে সাদা পেইন্ট দিয়ে লিখে রেখেছে “প্লীজ ভিজিট এগেইন” – বুঝলাম, এটা কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়, হৃদয়ের আকুল আহবান!
চলবে....
ঢাকা
১২ জুন ২০১৯
ঝিলাম নদী
বহমান ঝিলাম নদী
“প্লীজ ভিজিট এগেইন” – বুঝলাম, এটা কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়, হৃদয়ের আকুল আহবান!
উপগ্রহ চিত্রের লিঙ্কঃ https://goo.gl/maps/PcMHr6JesGfqQmKL7
এ চিত্রটি গুগল ম্যাপস থেকে নেয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:৩৫