গাড়ীচালক মোহাম্মাদ শাফি শাহ সালাম জানিয়ে তড়িঘড়ি করে আমাদের লাগেজগুলো তার সুপরিসর জীপে তুলে নিল। আমরা গাড়ীতে ওঠার পর অনুমতি নিয়ে গাড়ী স্টার্ট দিল। প্রথমে অনেকক্ষণ চুপ করেই গাড়ী চালাচ্ছিল, কিন্তু বেশীক্ষণ চুপ থাকার মানুষ সে নয়। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে উঠলো, “স্যার, আপকো ক্যায়সা লাগতা হ্যায় কাশ্মীর?” মনে মনে ভাবলাম, ব্যাটা বলে কী? জীবনে এই প্রথম কাশ্মীরে আসার তো কেবল দশ-পনের মিনিট হলো, এর মধ্যে আবার কেমন লাগবে? উর্দু বা হিন্দী কথোপকথনে আমি ততটা স্বচ্ছন্দ নই, তাই বেশী কথা না বলে মাত্র দুটো শব্দে উত্তর দিলাম, ‘বহুত আচ্ছা’। তারপরেই সে জিজ্ঞেস করলো, এই প্রথম আমি কাশ্মীরে আসছি কি না। আমি বললাম, ‘হুঁ’। সে জানালো, কোন চিন্তা নেই। এই চার পাঁচ দিনে কাশ্মীরে যা যা কিছু দেখার মত আছে, সবই সে দেখাবে। একটু পর পর সে জানাচ্ছিল, কাশ্মীরের লোকজন খুবই ভাল, এখানে কোন চুরি ডাকাতি বা অন্যান্য অপরাধ ঘটে না। পর্যটকরা এখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে পুরোপুরি নিরাপদ। আমি মাথা নাড়ালাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মানযুর (ওর বস) ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা, আমরা গাড়ীতে উঠেছি কিনা এবং রওনা হয়েছি কিনা, ইত্যাদি। এর পর সে ফোনটা আমাকে দিল। মানযুর আমাদেরকে কাশ্মীরে স্বাগতম জানিয়ে জানতে চাইলো কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, কোন অসুবিধে হচ্ছেনা। ও বললো, ‘আজ আপনারা হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিন, তারপরে শ্রীনগরের মধ্যেই কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে নিন। আগামী কাল সকালে আপনারা সোনামার্গ যাবেন, সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবেন’। আমি বললাম, তথাস্তু।
শাফি জিজ্ঞেস করলো আমরা লাঞ্চ করতে চাই কিনা। শ্রীনগরে পৌঁছার আগে দিল্লী বিমান বন্দরের ১ ও ২ নং টার্মিনালের মধ্যে ছোটাছুটির যে মহাযজ্ঞ অতিক্রম করে এসেছি, তাতে এমনিতেই খিদে পাবার কথা, আর তা ছাড়া লাঞ্চের সময়ও হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি বললাম, হ্যাঁ করবো, এবং একটু তাগাদার সাথেই বললাম, হোটেলে যাবার আগেই পথে যদি কোথাও লাঞ্চ করা যায় তবে সেখানেই করবো। শাফি বললো, আমি আপনাদেরকে লাঞ্চের জন্য খুব ভাল একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সে আরো জানালো, এ কয়দিন সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার আমাদের প্যাকেজের ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (যা আমার আগে থেকেই জানা ছিল), শুধু দুপুরের খাবারটা আমাদের নিজ ব্যবস্থায় করে নিতে হবে। আমি বললাম, কোন সমস্যা নেই। সে আমাদেরকে নিয়ে “দরবার-এ-মুঘল” এর সামনে গাড়ী থামিয়ে বললো, আপনারা ভেতরে গিয়ে এখানেই লাঞ্চ করেন, আমি গাড়ী পার্ক করে আশে পাশেই থাকবো।
আমরা সেখানে ওদের একটা স্পেশাল আইটেম দিয়ে লাঞ্চ করলাম, কিন্তু এতটা রিচ ফুড খেয়ে স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভয় হচ্ছিল। হোটেলে প্রবেশের সময় বেশ কিছু মহিলা ভিক্ষুক বাচ্চা কোলে নিয়ে হাত পেতে কিছু সাহায্য চাইছিল, আমি দু’জনকে দিয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে প্রবেশ করলাম। বের হবার সময় আবার কয়েকজন মহিলা ভিক্ষুক ঘিরে ধরেছিল এবং ভিক্ষার জন্য মিনতি করছিল। এবারে শাফি বিরক্ত হয়ে তাদেরকে সরে যেতে বললো। গাড়ী চলতে শুরু করার পর ও আমাকে বললো, “স্যার, ইয়ে সব আদমী কাশ্মীরি নেহি হ্যায়, ইয়ে সব বিহারসে আয়া”। বুঝলাম, ওদের ভিক্ষাবৃত্তি শাফি’র আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। ভেবে দেখলাম, তাই তো। ভিক্ষুকদের একটারও চেহারা তো কাশ্মীরিদের মত নয়। বরং ওদের চেহারা তো বিহারীদের মতই।
হোটেলে পৌঁছে আমরা যোহরের নামায পড়ে নিয়ে ঝটপট তৈরী হয়ে নিলাম। হোটেলটিকে বেশ পছন্দও হয়েছিল। খুবই নিরিবিলি, ছিমছাম। আমার স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল টিউলিপ গার্ডেন দেখার। কিন্তু মানযুর আমাদেরকে আগেই জানিয়েছিল যে ২৯ এপ্রিলের পর আর টিউলিপ গার্ডেন দেখা যাবে না। অর্থাৎ আমরা মাত্র ৩ দিনের জন্য সেটা মিস করলাম। সেটা জানা থাকা সত্তেও ফের শাফিকে জিজ্ঞেস করলাম, টিউলিপ গার্ডেনটা একটু দেখা যাবে কিনা। সে বললো, টিউলিপ এখন দেখতে পাবেন কিনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নই, তবে আমি চেষ্টা করবো আপনাদেরকে গার্ডেনের ভেতরে ঢোকাতে, অতি অবশ্যই। আমার স্ত্রী বলে উঠলো, তাই সই!
বিকেল সোয়া চারটার দিকে আমরা টিউলিপ গার্ডেনে পৌঁছ্লাম। পৌঁছে দেখি গেইট বন্ধ। শাফি দারোয়ানের সাথে কিছু কথা বললো। এরই মধ্যে আরেকটি ভারতীয় পরিবার সেখানে এসে পৌঁছলো। নিমরাজী দারোয়ান অবশেষে অনুরোধে ঢেঁকি গিললো। আমরা সবাই ভেতরে প্রবেশ করলাম, আমাদের দেশের মত কোন ‘উপরি’ পরিশোধ না করেই। ভেতরে গিয়ে দেখি টিউলিপ গাছের সারি সেই আগের মতই তখনো লাগানো আছে, শুধু ফুলগুলো তুলে ফেলা হয়েছে। কয়েকটি শালিক ঘুরে ঘুরে সেখানে অন্ন সন্ধান করছে। টিউলিপ ফুটে না থাকলেও, সবুজ গাছের সারিগুলো দেখেও ভাল লাগলো। টিউলিপ না পেয়ে আমার স্ত্রী সেখানে ফুটে থাকা অন্যান্য ফুলগুলোকে দেখতে থাকলো। আমি আমার সেলফোন বের করে ছবি তুলতে থাকলাম। তারপর আমরা আরো দুটো বাগান দেখতে গিয়েছিলাম। চশমেশাহী গার্ডেন এবং শালিমার বাগ। বৃষ্টি ঝরা শুরু হবার কারণে অবশ্য শালিমারবাগে ঢুকেই বের হয়ে আসতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম, শ্রীনগরেই যেহেতু আরো দু’রাত থাকবো, পরে না হয় এখানে আরেকবার আসা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সে সময়টুকু বের করা সম্ভব হয়নি। এর পরে আমরা ‘ডাল লেইক’ এ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিলাম। চশমেশাহী গার্ডেনে একটি প্রবহমান ঝর্নাধারা রয়েছে। জনৈক গাইড জানালো সেই ঝর্নাটা থেকে প্রতিদিন ‘পনি’তে করে পন্ডিত জাওয়াহারলাল নেহেরুর জন্য সুপেয় পানি দিল্লীতে পাঠানো হতো। কথাটার সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
সেখানে অনেক দর্শনার্থীকে দেখলাম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের ধরে ছবি তুলছে। কয়েকজন ফটোগ্রাফার আমাদের দিকেও এগিয়ে এলো, কিন্তু আমরা আগ্রহ দেখালাম না। একটু প্রাইভেসীতে আমরা তিনজন নিজেরাই ঘুরে ফিরে দেখতে এবং কখনো কখনো ছবি তুলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম। তবে আমাদের ছেলে ছবি তুলতে মোটেই আগ্রহী ছিল না। তবুও, জোর করে কিছু কিছু জায়গায় ওকে নিয়ে ছবি তুলেছি। পড়ন্ত বিকেলে ‘ডাল লেইক’ এ এসে কিছুক্ষণ বসে বসে শুধুই চারিদিকে দেখলাম আর ছবি তুললাম। তারপরে একটা বোট ভাড়া করলাম লেইকে নৌকোয় করে কিছুক্ষণ ঘোরার জন্য। সেই বোটগুলোর আবার কি বাহারী নাম! ‘মায়ূরপাঞ্ছী’, ‘লেইক পাল্কী’, ‘দিল কা রাজা’ ইত্যাদি। এখানে আমাদের একটি রাত ‘বোট হাউস’ এ থাকার প্রোগ্রাম নির্ধারিত ছিল, তাই আমরা সেদিন অল্প কিছুক্ষণ বোটে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। বোটের মাঝি আব্দুল বাসিত বারে বারে আমাদের কাছে দোয়া চাচ্ছিল যেন ওরা দৈনন্দিন যে নির্যাতন এবং বঞ্চনার শিকার হয়, তা থেকে যেন আশু মুক্তি পায়। আমাদের ছেলেরা বড় হয়ে যাবার পর আমাদের সাথে একসাথে ঘুরতে চায় না। সর্বশেষ পুরো পরিবার একসাথে ঘুরেছিলাম সেই ২০০৯ সালে, বান্দরবানের নীলগিরি, রাঙামাটির পেদা টিং টিং, কাপ্তাই লেইক, এবং বন্ধু আশরাফের চন্দ্রঘোনার কাছে সদ্য কেনা একটি বাগান এলাকা। এর পরে এই প্রথম ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে বের হয়েছি। খুব ভাল লাগছিল তিনজনে একসাথে ঘুরতে।
চলবে....
ঢাকা
১৪ মে ২০১৯
আমাদের শ্রীনগর সফরের পুরোটাই এই মোহাম্মদ শাফি শাহ আমাদেরকে গাড়ী চালিয়ে এখানে সেখানে নিয়ে গেছে।
With Mr Mohammad Shafi Shah, who drove us to various places during our four days' tour of Kashmir.
ফুল তুলে ফেলার পর টিউলিপ গার্ডেন
At the Tulip Garden at Srinagar, without the tulips.
টিউলিপ গার্ডেনের অন্যান্য ফুল
Non tulips at the tulip garden, Srinagar
টিউলিপ গার্ডেনের অন্যান্য ফুল
Non tulips at the tulip garden, Srinagar
আমরা যখন চশমেশাহী গার্ডেনে, আকাশে তখন কালো মেঘের আনাগোনা চলছে
The clouds getting darker at the Chashmeshahi garden, Srinagar
শান্ত, স্নিগ্ধ "ডাল লেইক"
The quiet, beautiful Dal Lake
"ডাল" বক্ষে নৌকোর জানালা দিয়ে দেখা
Through the window of the boat carriage
নৌকোর মাঝি আব্দুল বাসিত এর সাথে
With our boatman Mr Abdul Basit
নীচে শান্ত হ্রদ, উপরে কালো মেঘের আনাগোনা
Clouds gathering... at Dal Lake, Srinagar
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৯ সকাল ৭:৪৯