আমরা সুখে বা দুঃখে, যেভাবেই থাকিনা কেন, জীবন বয়ে চলে নিরবধি। এই বয়ে চলার বাঁকে বাঁকে আমরা অর্জন করি জীবনের বহু অমূল্য অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এক জীবনে তিন বছর আট মাস খুব বেশী সময় নয়। গত তিন বছর আট মাস ধরে আমি সামহোয়্যারইনব্লগে প্রায় একটানা ব্লগিং করে আসছিলাম। তার বছর খানেক আগে থেকে অবশ্য আমি অন্য আরেকটি ব্লগেও কিছু কিছু লেখালেখি করতাম। ব্লগিং এনে দিয়েছিল আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। কাউকে চিনিনা, জানিনা, কিন্তু তাদের লেখালেখির মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা মনের মধ্যে গেঁথে যেত। তাদের পোস্ট পড়া এবং পোস্টে মন্তব্য করা থেকে সে ধারণা আরো বেশী করে গাঢ় হতো। আটপৌরে জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনাবলী, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, প্রেম-ভালবাসা, নৈশর্গিক শোভা, পোষা প্রাণীর প্রতি মমতা, রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সড়ক দুর্ঘটনা, অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা, বইমেলা, দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সুরক্ষা ইত্যাদি হেন কোন বিষয় নেই, যা নিয়ে ব্লগে লেখা হতো না। যারা অনেকদিন ধরে ব্লগে এখনো লিখে চলেছেন, কিংবা যারা কোন কারণে এখন আর লিখছেন না, এবং নতুন যারা আসছেন, তাদের মধ্যে অনেক মেধাবী ব্লগারের লেখার সাথে পরিচিত হয়েছি। দুই একজন প্রয়াত ব্লগারের লেখা পড়ে মনে কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে এইতো মাত্র কিছুদিন আগেও ওনারা কত সুন্দর সুন্দর পোস্ট এখানে লিখে গেছেন, অথচ আজ তারা সকল যোগাযোগের ঊর্ধ্বে!
ব্লগে দেখেছি, কোন একজন নিয়মিত লেখকের লেখা পোস্ট হঠাৎ করে আসা বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই তার ভাল মন্দের কথা ভেবে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। তার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেন, তাকে নিয়ে পোস্ট লেখেন, ফেইসবুক, ইমেইল ইত্যাদির মাধ্যমে যেভাবেই হোক, তার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে প্রয়াসী হন। এভাবে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ও। অনুপস্থিত ব্লগার হয়তো কোন কারণে সাময়িকভাবে অনুপস্থিত হয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসে পোস্ট দেয়াতে ব্লগের পাঠকেরাও আশ্বস্ত বোধ করেন। এ যেন এক বিনিসূতো মালার বন্ধন। রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু কেমন যেন একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। এমন কি মন্তব্যের মাধ্যমে একে অপরকে ধুয়ে দিলেও, একের অনুপস্থিতিতে অন্যকে উৎকন্ঠিত হতে দেখেছি, খোঁজ খবর নিতে দেখেছি।
গত ফেব্রুয়ারী(২০১৯) এর মাঝামাঝি থেকে সামহোয়্যারইনব্লগের উপর এক অশুভ শক্তির চাপে নিয়ন্ত্রণের খড়গ নেমে আসে। সেই থেকে ব্লগে ব্লগারদের উপস্থিতি অনেকটা কমে যায়, কারণ দেশের অভ্যন্তরে ওয়েব পেইজটিকে ব্লক করা হয়। তাই, প্রবাসীরা ব্লগে নিয়মিত প্রবেশ করতে পারলেও, দেশের ভেতরের ব্লগাররা স্বাভাবিক পন্থায় তা পারছিলেন না। অনেকে বিকল্প পন্থা খুঁজে নিলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্লগারের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। ফলে ব্লগে উপস্থিত ব্লগারের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে আসে। কোন কোন সময়ে সেটা ৫/৭ জনে নেমে আসতেও দেখেছি। এমতাবস্থায়, ব্লগিং করতে ভাল লাগছিল না, কিন্তু তবুও আমি গত ২৫ এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ব্লগিং করে গেছি। তার দু’দিন পরে কিছুদিনের জন্য ভারত সফরে যেতে হয়েছিল একটু পারিবারিক চিকিৎসা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণের জন্য। ডাক্তার রোগীকে দেখে ছাড়পত্র দেয়াতে ৪/৫ দিনের জন্য আমরা তিনজনে মিলে একটু কাশ্মীরেও বেড়িয়ে আসি। ভারত থেকে ফিরে এসে দেখি, ব্লগে আর ঢুকতে পারছিনা। ক্লিক করলেই লেখা আসেঃ This webpage has been blocked.
জানতাম, বিকল্প পন্থায় ব্লগে প্রবেশ করা যাবে, কিন্তু সে বিকল্প পন্থা অনুসন্ধানে আমি মোটেই আগ্রহী ছিলাম না, তাই চুপচাপ ছিলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন ব্লগার আমার সাথে যোগাযোগ করলেন, আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। তাদের কেউ কেউ জানালেন, ব্লগার চাঁদগাজী আমার ব্যাপারে উৎকন্ঠা প্রকাশ করে একটা পোস্টও লিখে ফেলেছেন। অনেকেই বাৎলে দিলেন, বিকল্প পন্থায় কিভাবে ব্লগে প্রবেশ করা যাবে। তাদের এ সহৃদয়তা দেখে আমি অভিভূত ও মুগ্ধ হ’লাম। আর চাঁদগাজী সম্পর্কে আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল যে তিনি এমনকি যাকে মোটেও পছন্দ করেন না, মুখে তিনি তাকে যতই “চাপের মুখে” রাখেন না কেন, তার অনুপস্থিতিতে তিনি উদ্বিগ্ন হন। অনুপস্থিত ব্লগারকে নিয়ে চাঁদগাজীর লেখা পোস্টের সাবজেক্ট আমিই প্রথম নই। এর আগেও তিনি বহুবার অনুপস্থিত ব্লগারদের ভালমন্দ জানতে চেয়ে পোস্ট লিখেছিলেন।
যারা ব্লগে আমার এই চার সপ্তাহের অনুপস্থিতিতে আমাকে নিয়ে ভেবেছেন, আমার অনুপস্থিতি অনুভব করেছেন, উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাদের প্রত্যেকের কাছে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনাদের এ সহমর্মিতার কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম। ভাল থাকুন সবাই, নিরাপদে থাকুন!!!
ঢাকা
২৩ মে ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৭