যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন ও জানেন, তারা নিঃসন্দেহে ওপরের ঐ শিরোনামটা দেখে চমকে উঠবেন। কারণ, আমি সারাজীবনে কখনো রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। তবে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ডে জড়িত না থাকলেও, দেশের এবং বহির্বিশ্বের রাজনীতির গতি প্রকৃ্তির উপর একটা নির্মোহ ও নিরাসক্ত দৃষ্টি সব সময়েই রেখেছি। আর মাত্র তিন দিন পরে অনুষ্ঠিত হবে আমাদের দেশের একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে ব্লগারদের ভাবনাগুলো কেমন, বা তারা প্রার্থীদের কাছ থেক কী প্রত্যাশা করেন, সেটা একটি ইশতিহার আকারে প্রকাশ করার জন্য কাল্পনিক_ভালবাসা একটি পোস্টের মাধ্যমে আহবান জানিয়েছেন। সেই থেকে আমারও মনে ভাবনা এলো, আমি যদি রাজনীতি করতাম, তা’হলে নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি যে নির্বাচনী ইশতিহার তৈরী করতাম, তাতে কী কী কথা থাকতো? মোটা দাগে সেসব ভাবনা নিয়েই আমার আজকের এ পোস্ট।
কাল্পনিক_ভালবাসা এর এতদসংক্রান্ত পোস্টটা পড়ার পর এ ব্লগে বহু ইশতেহার এসেছে, কিন্তু আমি তার কোনটাই পড়িনি, প্রভাবিত হয়ে যেতে পারি এই ভেবে। তারপরেও, অনেকের ভাবনার সাথে আমার ভাবনাগুলোও মিলে যেতেই পারে, এবং সেই সাথে ইশতিহারের পয়েন্টগুলোও। এই পোস্ট দেয়ার পরে আমি ইশতিহার নিয়ে লেখা অন্যদের পোস্টগুলোও যত বেশী পারি, পড়ে দেখবো বলে আশা করছি।
আমার সে ইশিতিহারে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের উল্লেখ থাকতোঃ
১। আইন ও আদালত সংস্কারঃ যারা জীবনে কখনো কোন মামলা মোকদ্দমার মুখোমুখী হন নি, তারা হয়তো এটা বুঝবেন না, কিন্তু যাদের এ দুঃসহ অভিজ্ঞতা একবার হয়েছে, তারা ঠিকই বুঝবেন যে এ সমস্যাটা কতটা মারাত্মক! দেশে অসংখ্য মামলা যুগের পর যুগ ধরে ঝুলে আছে, মামলা চালাতে গিয়ে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও আদালতের আনাচে কানাচে যে দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে সেটাও অভিযুক্তদেরকে অক্টোপাসের মতই জড়িয়ে ধরে। তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আসে সরকার পরিবর্তন বা নির্বাচনের সময় রুজুকৃত অসংখ্য রাজনৈতিক মামলা, যার ফলে মামলার ভারে ন্যুব্জ আদালত কোন কূল কিনারা খুঁজে পায় না, জেলখানাগুলোতেও যেন “তিল ঠাঁই আর নাহি রে” অবস্থা! তাই আমরা (মানে আমার কল্পিত দল) একটা আইন ও আদালত সংস্কার কমিশন গঠন করে আইন এবং আদালতের যেখানে যেখানে সংস্কার প্রয়োজন, তা করবো। ঝুলন্ত মামলার সংখ্যা যতটা সম্ভব, দ্রুতহারে নামিয়ে আনা হবে। দরিদ্র এবং নিম্নবিত্ত ব্যক্তিদের কাছে সুবিচার যেন সহজলভ্য হয়, সেজন্য আইনে প্রয়োজনীয় বিধান রাখা হবে।
২। বিশ্বের অন্যান্য সভ্য দেশগুলোতে যেভাবে অভিযুক্তরা সহজে জামিন লাভ করে, এ দেশেও সেরকম সম্মানজনক ব্যবস্থাই করবো। আদালত কর্তৃক দন্ডিত হবার আগে পর্যন্ত কোন অভিযুক্তের সাথে অপরাধী হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা। আর, পুলিশের রিমান্ড প্রথা থাকবে না।
৩। আদালতের বাইরে আপোষনামা বা সালিশনামার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিকে (Out of Court Settlement) উৎসাহিত করা হবে। এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মরহুম কামাল উদ্দিন মহোদয় বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। তার সুপারিশগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৪। বিচারকগণের এবং সাংবিধানিক পদ সমূহে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন বা অসদাচরণের কোন অভিযোগ উল্থাপিত হলে দ্রুত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সর্বাবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত এবং অনৈতিকতামুক্ত রাখা হবে। সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক খবরদারির আওতামুক্ত রাখা হবে।
৫। প্রশাসনঃ একইভাবে একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন করে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে যেন প্রশাসন গণমুখী ও জনবান্ধব হয়। নিজে গণবিরোধী কিংবা গণস্বার্থ বুঝতে অক্ষম, এমন প্রশাসকদেরকে খুঁজে বের করে তাদেরকে মাঠ প্রশাসনের বাইরে অন্যত্র বদলি করা হবে এবং তার আগে তারা কোন গণবিরোধী কাজে ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকলে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
৬। পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা উঠিয়ে দিয়ে জন প্রতিনিধিদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হবে। পুলিশের কাছ থেকে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি(দে)র বিরুদ্ধে কোন মামলা থাকলে ধারা উল্লেখ পূর্বক তার লিখিত বিবরণী চাওয়া হবে।
৭। আমাদের দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামো অত্যন্ত মাথাভারী। একটি আলাদা কমিটি করে প্রশাসনিক অবকাঠামো পুনর্গঠিত করা হবে। অফিসে কোন পিয়ন আর্দালি রাখা হবেনা, যারা বেশীরভাগ সময় চা নাস্তা আয়োজনের বাইরে শুধু টুলে বসে ঘুমায়।
৮। রেল প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করে যাত্রীবান্ধব করা হবে। রেলখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করে নতুন নতুন লাইন তৈরী করা হবে এবং জরাজীর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো লাইনগুলো সংস্কার করে পুনরায় চালু করা হবে। সড়ক যানবাহনের মালিক, শ্রমিক ও দালালদের সমিতিগুলোকে কঠোর আইনের মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে এবং যানবাহন চলাচল ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সকল দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা হবে। রেলওয়ের দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করে দক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে রেলের রাজস্ব আয় বৃ্দ্ধি করা হবে।
৯। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের ছাঁটাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের স্ত্রীদেরকে ফ্রী পাস দেয়া হবে যেটা প্রদর্শন করে তাঁরা সরকারী/বেসরকারী যেকোন বাহনে বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন। স্ত্রী মারা গেলে কিংবা স্ত্রীর অবর্তমানে যে কোন একজন সন্তান এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারবেন। বিমান ভ্রমণের জন্য তাঁরা ৫০% মূল্যহ্রাস পাবেন। চিকিৎসার জন্য সরকারী হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে তারা আজীবন অগ্রাধিকার পাবেন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন। বেসরকারী হাসপাতালেও অন্ততঃ ৫০% ছাড় পাবেন।
১০। সকল প্রশাসনিক নিয়োগ কেবলমাত্র মেধাভিত্তিক হবে এবং প্রশাসনিক পদে নিয়োগের জন্য সকল কোটা প্রথা বিলোপ করা হবে।
১১। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমতি কঠোর স্ক্রীনিং এর মাধ্যমে পুনঃপরীক্ষা করা হবে এবং নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উঠিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে প্রয়োজনবোধে সরকারী সহায়তায় ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করা হবে।
১২। মেয়েদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ফ্রী করা ছাড়াও দরিদ্র ছাত্রীদেরকে শিক্ষাব্যয় নির্বাহের জন্য বৃত্তি প্রদান করা হবে। বিদেশে গৃহসেবিকা হিসেবে নারীদের নিয়োগ বন্ধ করে তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে যথোপযুক্ত পেশায় নিয়োগলাভে উৎসাহিত করা হবে।
১৩। আইন পাশ করে প্রাইভেট কোচিং বন্ধ করে দেয়া হবে। শিক্ষকদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে শ্রেণিকক্ষেই পর্যাপ্ত শিক্ষাদানে বাধ্য করা হবে। ছাত্রছাত্রীদের অকৃতকার্যতার দায় কিছুটা হলেও শিক্ষকদেরকে বহন করতে বাধ্য করা হবে।
১৪। রাজধানী ঢাকার এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরের যান চলাচল ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার এনে যানজটকে সহনীয় পর্যায়ে আনা হবে। রাস্তার মোড়গুলোতে হাস্যকরভাবে অসভ্য দেশের মত দড়ি দিয়ে যান নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে বহু ব্যয়ে স্থাপিত ট্রাফিক লাইট ব্যবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হবে। রাজধানীতে ভিভিআইপিদের চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে, যেন তাদের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীগণ আপামোর জনসাধারণকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে রাস্তার উপর আটকে না রাখে।
১৫। দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হবে এবং বিদ্যমান জরাজীর্ণ স্টেডিয়ামগুলোর সংস্কার করে সাড়া বছর জুড়ে এগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হবে। এখনকার মত শুধু বছরের কিছু নির্দ্দিষ্ট সময় ছাড়া স্টেডিয়ামগুলোকে অব্যবহৃত রাখা হবে না। আন্তঃ স্কুল, আন্তঃ কলেজ খেলাধুলা, শরীর চর্চা এবং এ্যাথেলেটিক্স প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোতে বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হবে। ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে সরকারী ভূমি উদ্ধার করে সেখানে ব্যায়ামাগার এবং শরীর চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। জলদস্যুদের থেকে জলাধার উদ্ধার করে মৎস্যজীবিদের মাঝে সমবায় সমিতির মাধ্যমে ইজারা দেয়া হবে এবং তাদের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলে জলপথগুলো জলযান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
১৬। দ্বীপাঞ্চলের অধিবাসীদেরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করার জন্য উন্নত বিশ্বের সহযোগিতা কামনা করে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
১৭। সংসদীয় সংস্কারঃ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের বয়স সীমা নির্বাচনের তারিখে ৩৫ থেকে ৭৫ এর মধ্যে সীমিত করা হবে। একজন ব্যক্তি অনধিক দুইবার সরকার প্রধান হতে পারবেন, এমন বিধান রাখা হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এমনভাবে বৃ্দ্ধি করা হবে যেন তা শুধুই সরকারের আনুমোদনিক না হয়ে কিছুটা রাষ্ট্রের অভিভাবকসুলভও হয়।
১৮। সাংসদদেরকে শুল্কমুক্ত যানবাহন প্রদান প্রথা বাতিল করা হবে। বিনিময়ে তাদেরকে ফ্রী পাস দেয়া যেতে পারে।
১৯। সংসদে কোন ভোটাভুটির সময় সাংসদদের ফ্লোর ক্রসিং এর উপর আরোপিত সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা হবে, যেন তারা নিজ বিবেক এবং মুক্তচিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রয়োজনবোধে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও তাদের মত প্রকাশ করতে পারে্ন।
২০। সংস্কারের লক্ষ্যে উপরে যেসব কমিশন/কমিটির কথা বলা হয়েছে, তার সদস্য সংখ্যা হবে ১৫। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জন কোন আলোচনাসভায় উপস্থিত থাকলেই কোরাম পূর্ণ হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। ১৫ জনের মধ্যে ১ জন হবেন সভাপতি, যিনি সাধারণ ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নিজের ভোট প্রয়োগ করবেন না। কিন্তু কখনো যদি সমান সমান ভোটের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা দেখা দেয়, তখন তিনি নিজের ভোটটি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন।
সবাইকে ইংরেজী নতুন বছর - ২০১৯ এর অগ্রিম শুভেচ্ছা!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১৯