আমার জন্য এক স্মৃতিময় শহরের নাম ময়মনসিংহ। আর মোমেনশাহী নামটা তো গেঁথে আছে একেবারে হৃদয়ের গভীরে। আশৈশব নানাবাড়ী দাদাবাড়ী যেতাম ট্রেনে, সপরিবারে, ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন এর উপর দিয়ে। আমরা ভাই বোনেরা জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখতে থাকতাম হাঁক ডাক করে ঘুরে বেড়ানো ফেরীওয়ালাদের। আম্মা কোন চা ওয়ালাকে ডাকতে বললে খুব খুশী হয়ে আমরা সবাই মিলে সোৎসাহে চা ওয়ালাকে ডাকতাম গলা ছেড়ে।
কৈশোর পরবর্তী জীবনেও বহুবার বাড়ী যেতে হয়েছে ময়মনসিংহ জংশনের উপর দিয়ে। তখন অবশ্য সকালের ১১ আপ "দ্রুতযান এক্সপ্রেস" যোগে নয়, রাতের ৭ আপ "নর্থ বেঙ্গল মেইল" যোগেই বেশী যাওয়া পড়তো। ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে আসার পর জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে টঙ্গী পৌঁছানোর আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাংতো আবার সেই ফেরীওয়ালাদের হাঁক ডাকেই। বুঝতে পারতাম, ময়মনসিংহে এসে গেছি। তখন ট্রেনটা ময়মনসিংহে পৌঁছতো রাত প্রায় দু’টোয়। কান খাড়া রাখতাম ফ্যাসফ্যাসে গলায় এক চা ওয়ালার ডাক শোনার জন্য। বহু বছর ধরে আমি তার "গরম চা... চা গরম" ডাক অবধারিতভাবে শুনতে পেতাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে এক কাপ গরম চা খেয়ে রাতের ব্যস্ত ময়মনসিংহ স্টেশনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় লক্ষ্য করতাম। সেখানে ঢাকা থেকে আসা আমাদের ট্রেনটা দু'ভাগে ভাগ হয়ে যেত। এক ভাগ যেত বাহাদুরাবাদ ঘাটে, আরেক ভাগ জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। বাহাদুরাবাদ ঘাটের ওপাড়ে ছিল তিস্তামুখ ঘাট (বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর আর বগুড়া জেলার যাত্রীদের জন্য), আর জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের ওপাড়ে ছিল সিরাজগঞ্জ ঘাট (বৃহত্তর পাবনা ও রাজশাহী জেলার যাত্রীদের জন্য)।
একবার এই সেপ্টেম্বর মাসেই আমরা তিন বন্ধু মিলে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি'র ফরম সংগ্রহের জন্য। এদের মধ্যে একজন প্রয়াত মেরিন ইঞ্জিনীয়ার আলী মুনীর রানা, আরেকজন শরীফ হাছান, আজকের প্রখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন। আমার বায়োলজী ছিলনা, তাই আমি মেডিক্যালে ভর্তির অযোগ্য ছিলাম। আমি গিয়েছিলাম কেবলই ফাও-নিজের আনন্দের জন্য আর বন্ধুদের সঙ্গ দেয়ার জন্য। ২/৩ দিন ছিলাম, ফিরে এসেছিলাম ০৫ই সেপ্টেম্বর তারিখ বিকেলে। তারিখটা মনে আছে কারণ, যখন ফিরে আসি, তখন ময়মনসিংহ রেল স্টেশনের এক চায়ের দোকানে উচ্চস্বরে এক রেডিও বাজছিল। সেই রেডিওর খবরেই শুনেছিলাম যে প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী আব্দুল আলীম সেদিন সকালে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় এক বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের তীর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরিফ হাছান আমাকে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য "শ্যামা" থেকে অনেকটা অংশ মুখস্ত শুনিয়েছিল। ওর এই ভিন্নমুখী প্রতিভার পরিচয় পেয়ে আমি সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম, যদিও সে মুগ্ধতার কথা কথায় কথায়ও আজ অবধি ওকে বলা হয়নি। সন্ধ্যার আযান পড়াতে পুরোটা শুনতে পারিনি, তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে আসতে হয়েছিল (ঘর মানে ঐ দু'জনের এক জনের চাচার বাসায়, কার সেটা মনে নেই, চরপাড়ার যে বাসায় আমরা তিনদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম, সে বাসায়)।
চাকুরী জীবনে এই একুশ শতকের প্রথম দিকে আবার ময়মনসিংহে তিন বছর কাটিয়েছি। আমার অফিসটা তখন ছিল ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে। যাওয়া আসার পথে বহুদিন গাড়ী থেকে নেমে যেতাম, উদ্দেশ্যহীনভাবে নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠা চরে কাশফুল আর নানারকমের পাখপাখালি দেখার জন্য। ময়মনসিংহের কৃষ্ণা কেবিন আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল। অন্যান্য জায়গার চেয়ে ময়মনসিংহে মিষ্টি বেশ সস্তা ছিল, সুস্বাদুও ছিল। মুক্তাগাছার মন্ডা বহুযুগ ধরে প্রসিদ্ধ ছিল, কিন্তু আমাকে সেটা সেভাবে টানেনি। তবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তাগাছার রাজবাড়ীতে আতিথ্যে থাকাকালীন মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন, সেকথা ঐ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিকের বংশধরেরা আজও বেশ গর্ব ভরে বলে থাকে। ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড়ের একটা চায়ের দোকানের কথাও বেশ মনে পড়ে। সেখানকার গরম সিঙাড়া খুব উপাদেয় ছিল। মুক্তাগাছা রোডে খুবসম্ভবতঃ খাগডহর নামক একটা জায়গার একটা বড় মাসজিদে প্রায় নিয়মিতভাবে জুম্মার নামায পড়তে যেতাম, নয়তো কখনো কখনো কাঁচিঝুলি'র ঈদগাহ মাসজিদে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকমাস কাটিয়েছিলাম। কৃষি প্রকৌশল বিভাগের ডাকসাইটে ডীন মজিবর রহমান বিশ্বাস স্যারের কথা মনে পড়ে। এরতাজুল ইসলাম স্যার রসায়ন পড়াতেন। খুবই ভদ্র, অমায়িক এবং নরম মনের পন্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি। আমরা উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে তার লেখা রসায়ন বই পড়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুন তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা পড়াতেন। উনি ভাল পড়াতেন, তবে ঠিকভাবে ক্লাস সামলাতে পারতেন না। তাঁর প্রথম ক্লাসেই যশোর কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আগত এক শ্মশ্রুমন্ডিত ছাত্র তাঁর প্রতি ক্রাশ খেয়ে হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। তিনি এতে একটু অস্বস্তি বোধ করে তাকে তার হাঁ করা মুখটা বন্ধ করতে বলেছিলেন। ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। পরে সে সহজ সরল ছাত্রটি আমাদেরকে জানিয়েছিল, তিনি ক্লাসে এলে সে তাঁর থেকে চোখ ফিরাতে পারতোনা। এছাড়া ছিলেন স্ট্যাটিস্টিক্সের খোদা দাদ খান স্যার, ওনার লেখা বইও আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করেছিলাম। কৃষি অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র বকুল মামা ছিলেন শরীফ হাছানের আপন মামা, সেই অর্থে আমারও মামা। তিনি ভাল হকি খেলতেন, আমাকে একদিন খেলতে ডেকে নিয়ে গেলেন। খেলা দেখে বলেছিলেন রেগুলার বিকেলে তার সাথে মাঠে নামতে। বিকেল বেলা খেলাধুলা শেষে নিকটবর্তী ব্রহ্মপুত্রের চরে নানা জাতের রংবেরং এর পাখি দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়া সুতিয়াখালী রোডের মোড়ে একটা ভাল চায়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের মালাই (ঘন দুধের সর) এখনো মুখে লেগে আছে। রাতের বেলা বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দ্রুত অপসৃয়মান খোপ খোপ জানালার আলো দেখতে খুব ভাল লাগতো। ভেতরের যাত্রীদের কথা ভাবতাম। একবার এক শীতের রাতে যাত্রাগানের আয়োজন করা হয়েছিল। যাত্রায় তেমন আকৃষ্ট না হলেও, বন্ধুদের সাহচর্য আর গল্পগুজব উপভোগ করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ময়মনসিংহে একবার “সুজন সখী” সিনেমার শুটিং হয়েছিল। সে উপলক্ষে নায়ক ফারুক আর নায়িকা কবরী সেখানে এসেছিলেন। শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ থেকে নায়িকা কবরীর ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ার একটা দৃশ্য ছিল। খুব সম্ভবত একজন স্থানীয় ‘ডামী’ সে দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। এ ছাড়াও ফারুক কবরী ব্রহ্মপুত্র নদে গান গেয়ে নৌকো বেয়েছিলেন বলে মনে পড়ে। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি! স্মৃতিচারণ সতত সুখময়!
(আজই দুপুরে ব্লগার আব্দুল্লাহ আল মামুন এর আমার মোবাইলের চোখে আমার শহর (ময়মনসিংহ শহর, ময়মনসিংহ বিভাগ) শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা পড়ে আমার স্মৃতিময় ময়মনসিংহ শহরের কথা মনে পড়ছিল। সাথে সাথেই মনে পড়া কিছু স্মৃতির কথা লিখে ফেললাম)।
ঢাকা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮