আমার জীবনে বিদেশ ভ্রমণের প্রথম সুযোগ আসে ১৯৮৬ সালে, থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক দিয়ে সে ভ্রমণের যাত্রা শুরু। দু'সপ্তাহের এক ঝটিকা সফরে বের হয়ে ঢাকা-ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর-জাকার্তা-সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক-ঢাকা সফর শেষে মনে হয়েছিল, শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাবে আমরা ওদের চেয়ে কতটা পিছিয়ে আছি! স্পষ্ট মনে পড়ে, আমাদের স্বাধীনতার আগে এবং অব্যবহিত পরেও, ওসব দেশের ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের দেশে আসতো। কারণ, ওদের দেশে তখনো আমাদের মত উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়, কৃ্ষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি ছিলনা। ১৯৭৩ সালেও আমাদের দেশ থেকে মালয়েশিয়া ডাক্তারদের এক বিরাট বহর নিয়োগ করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল। ব্রুনেই দারুস সালাম ও নাইজেরিয়া আমাদের দেশ থেকে স্কুল শিক্ষক নিয়োগ করেছিল। যাহোক, প্রায় ৩১ বছর পর পুনরায় সম্প্রতি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফর করেছি। মাঝখানে ২০০১ সালেও একবার থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর সফরে গিয়েছিলাম। প্রথমটার ১৫ বছর পরে দ্বিতীয়বার এবং দ্বিতীয়টার ১৬ বছর পরে তৃতীবার থাইল্যান্ডে গেলাম, তবে আজ আমি থাইল্যান্ড সম্পর্কে কিছু লিখছিনা, কারণ এ দেশটি নিয়ে এ ব্লগে প্রচুর ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখা আছে। তাছাড়া এ ব্লগের জনপ্রিয় ব্লগার ইবনে বতুতা তথা ‘জুন’ তার ব্লগে থাইল্যান্ড সম্পর্কে যা যা জানার আছে তার সবই প্রায় বলে গেছেন, সচিত্র বর্ণনা সহ। আর কে না জানে, থাইল্যান্ড এর উপর তিনি একজন বিশেষজ্ঞ পর্যটক। পর্যটকদের প্রায় সব সফরেই কিছু না কিছু টুকটাক ঘটনা ঘটে থাকে, যেগুলো কখনো টেনশন, কখনো ভয়ভীতি আবার কখনো সুখের কিংবা বিনোদনের স্মৃতি হয়ে থাকে। আমি সেরকম ঘটনাগুলো নিয়ে লিখতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমার আমেরিকা সফরের সময় এরকম একটি ঘটনা নিয়ে এই ব্লগেই একটা পোস্ট লিখেছিলাম। এবারের সফরে আমার আইফোনের ক্যামেরাটা আমার সাথে বিট্রে করেছিল, তাই তেমন কোন ভাল ছবি তুলতে পারিনি, সেটাও ছবিব্লগ না দেয়ার একটা কারণ।
গত প্রায় ৩১ বছর ধরে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে বেড়ালেও, এখনো যখন কোন সফরে বের হবার পরিকল্পনা নেই, তখন থেকেই বুকটা আমার ঢিব ঢিব করতে থাকে, মনে কিছুটা রোমাঞ্চ অনুভব করতে থাকি, সেই সাথে কিছুটা অস্থিরতাও কাজ করতে থাকে। আগে টিকেট, হোটেল বুকিং, সাইট সীইং ইত্যাদি ট্রাভেল এজেন্টের উপর ছেড়ে দিতাম, কিন্তু এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে নিজেই সব ঘেটে ঘুটে ঠিক করি, প্রয়োজনে ছেলেদের সাহায্য নেই। এবারে আমরা দুই বন্ধু সস্ত্রীক ১০ রাত ১১ দিনের একটা ট্যুরের পরিকল্পনা নেই। আমার মত আমার বন্ধুযুগলেরও থাইল্যান্ডে এটা বহু বছরের ব্যবধানে তৃতীয় সফর ছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সফরটাকে মোট তিনভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম কয়েকটা দিন ফুকেটে, তারপরে কয়েকটা দিন অন্য কোথাও এবং শেষের কয়েকটা দিন ব্যাংককে। কিন্তু একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দিল এই “অন্য কোথাও” যাওয়া নিয়ে। আমার ইচ্ছে ছিল উত্তরে চিয়াং মাই, চিয়াং রাই যাবার, কিন্তু বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সেদিকে যাবার ইচ্ছে নেই, কারণ পাহাড় জঙ্গলের চেয়ে সাগরই ওদের টানে বেশী। তাই, ওরা যেতে চেয়েছিল পাতায়া। আমরা যেহেতু প্রথমেই ফুকেট যাচ্ছি এবং সেখানকার সাগর সৈকত খুবই সুন্দর, তাই আমাদের আর দ্বিতীয় সৈকত পাতায়া দেখার ইচ্ছে ছিলনা। যাহোক, সমঝোতায় আসলাম- মাঝখানে তিনটা রাত আমরা থাকবো চিয়াং মাই এ, ওরা যাবে পাতায়াতে। শেষের তিন রাত আবার ব্যাংককে, একই হোটেলে। সে হিসেবেই হোটেল বুকিং করা হয়েছিল। প্রাথমিক পরিকল্পনায় আমার ইচ্ছে ছিল ব্যাংকক থেকে চিয়াং মাই যাব ট্রেনে করে। কিন্তু বন্ধু ও বন্ধুপত্নী সাথে না যাওয়ায় ভাবলাম, প্রায় দশ ঘন্টার ট্রেন জার্নি আমাদের জন্য বোরিং হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ট্রেনের টিকেট করাও একটা ঝামেলা আর জার্নির ক্লান্তি তো রয়েছেই। তাই পরিকল্পনা কিছুটা বদল করে ব্যাংকক থেকে চিয়াং মাই যাবার জন্য ঢাকা থেকেই “এয়ার এশিয়া”র টিকেট কিনেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল এরকমঃ ০৮ নভেম্বর তারিখে আমরা সকালে “এয়ার এশিয়া”র ফ্লাইটে একসাথে ফুকেট থেকে ব্যাংকক আসবো। ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকেই আমার বন্ধু ও বন্ধুপত্নী ট্যাক্সি করে পাতায়া চলে যাবে, আর আমি ও আমার স্ত্রী “এয়ার এশিয়া”র পরবর্তী কোন এক ফ্লাইটে চিয়াং মাই যাবো। কিন্তু মুশকিলটা হয়েছিল এই “পরবর্তী কোন এক ফ্লাইটে” যাওয়া নিয়ে। আমার ধারণা ছিল যেহেতু ডোমেস্টিক ফ্লাইট এবং একই এয়ারলাইনের, এবং আমরা এয়ারপোর্ট ত্যাগ না করে ভেতরে থেকেই পরবর্তী ফ্লাইট ধরবো, সেহেতু এক দেড় ঘন্টার সময়ের ব্যবধানই যথেষ্ট হবে। সেই হিসেবে আমি দেড় ঘন্টার ব্যবধান রেখে চিয়াং মাই যাবার টিকেট করেছিলাম।
ভ্রমণ শুরুর আগের রাতে আমার ছেলে আমাদের ট্রাভেল আইটিনারারী দেখে মন্তব্য করলো, এয়ার এশিয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকতে। ওরা অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটা বেশী সময় হাতে রেখে চেক ইন কাউন্টার বন্ধ করে দেয় এবং ওজনের ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়না। ও পরামর্শ দিল, ব্যাংকক থেকে ফুকেট যাবার আগেই এয়ারপোর্টের এয়ার এশিয়ার অফিস থেকে নিশ্চিত হয়ে নিতে, দেড় ঘন্টা সময় যথেষ্ট হবে কিনা। ফুকেট যাবার দিনে সেটা করতে গিয়ে শুনি, অন্ততঃ তিন ঘন্টা সময় হাতে রাখতে হবে। শুনে গলদঘর্ম হওয়া শুরু করলাম। কাউন্টারের সুশ্রী মেয়েটি আমার অবস্থা অনুভব করে পরামর্শ দিল, “Sir, the best option for you would be to change the flight, but you have to pay extra for that.” কী আর করা! অগত্যা কিছু বাড়তি মাশুল গুণে আমি কাউন্টারের মেয়েটিকে বললাম ফ্লাইট চেঞ্জ করে তিন ঘন্টা পরের একটা ফ্লাইটে আসনের ব্যবস্থা করতে। মেয়েটি বারে বারে আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। সম্ভবতঃ কপালের দুশ্চিন্তার রেখা বিলীন হতে দেখে স্মিত হেসে সে আমাকে নতুন টিকেট ধরিয়ে দিল। নিশ্চিন্ত হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় নিলাম।
ফুকেট থেকে ফেরার দিন যথাসময়ে ব্যাংককের ডন মুয়াং বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। বন্ধু ও বন্ধুপত্নী সেখান থেকে সড়ক পথে পাতায়া যাবার উদ্দেশ্যে বিদেয় নিল। আমরা ঐ টার্মিনাল থেকেই চিয়াং মাই এর প্লেন ধরবো, হাতে তিন ঘন্টারও বেশী সময়। হাল্কা ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই ভাবলাম ওখানকারই কোন রেস্তোরাঁ থেকে কিছু খেয়ে নেই। বিদেশ ভ্রমণকালে কিছুক্ষণ পর পরই পাসপোর্ট, টিকেট, কারেন্সী, হোটেল বুকিং ইত্যাদির কাগজপত্র সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তা পরখ করে নেয়ার খুঁতখুতে স্বভাব আমার চিরকালের। সে অভ্যাসেরই বশবর্তী হয়ে আবিষ্কার করলাম, হোটেল বুকিং, টিকেট, পরিবর্তিত টিকেট, নিজের পরিচয়পত্রের ফটোকপি, পাসপোর্ট সাইজ ছবি ইত্যাদি সুন্দর করে যে লাল ফোল্ডারটিতে গুছিয়ে রেখেছিলাম, সেটা মিসিং! মনে করতে চেষ্টা করলাম, সেটা কোথায় ফেলে এসেছি! আমি এবং আমার স্ত্রী উভয়ে মনে করতে পারলাম, ফুকেট বিমানবন্দরে সেটা ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিয়েছিলাম। লাগেজ চেক ইন করার পর আমরা কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে গাল গপ্পো করেছিলাম। কোথাও কিছুক্ষণ বসলে ওঠার সময় সবার আসনের আশেপাশে ভালভাবে খেয়াল করে নেয়াটা আমার চিরাচরিত অভ্যাস। কিন্তু সব গ্রামারেরই নিয়মাবলীর নীচে কিছু ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ থাকে। সেদিন হয়তো আমারও নিয়মের পরিবর্তে ব্যতিক্রমটাই ঘটলো। ফলে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, ক্ষুধাও উধাও হলো!
ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোথাও না গিয়ে, অযথা খোঁজাখুজি না করে, তৃতীয় তলায় উঠে এয়ার এশিয়ার অফিসেই যেতে হবে। মনে মনে প্রমাদ গুণতে থাকলাম, না জানি এবারেও আবার কতটা মাশুল গুণতে হয়! ওপরে উঠলাম, সেই চেনা অফিস। কিন্তু এবারে সেখানে প্রচুর ভিড়-ভাট্টা। 'কিউ' এ দাঁড়িয়ে অস্থির লাগছিল। মনে হলো, সেদিন ২ নম্বর কাউন্টার থেকে যে মেয়েটি আমার টিকেট চেঞ্জ করে দিয়েছিল, আজও সে মেয়েটিই একই কাউন্টারে বসে আছে। একদম একই রকম দেখতে। 'কিউ' এর লোকদেরকে টোকেন দেয়ার কাজে ব্যস্ত দুটো মেয়ে কিছুক্ষণ পর পর অপেক্ষমান যাত্রীদের টোকেন দিয়ে যাচ্ছিল। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের একজনকে আমার সমস্যার কথা জানালাম। আঙুল উঁচিয়ে দেখালাম, ঐ যে, ২ নম্বর কাউন্টারটাতে যে মহিলা কাস্টমার এ্যাটেন্ড করছেন, উনিই আমাকে তিনদিন আগে আমার টিকেট পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। উনি সবকিছু জানেন। আমি তার সাথেই দেখা করতে চাই, অন্য কারো সাথে নয়, এটা একটু জোরের সাথেই বললাম। মেয়েটি তার কাছে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে কি যেন বললো। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝলাম, মেয়েটি তাকে বললো, আমি এখন ব্যস্ত, তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলো। মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বললো, তিনি আপনাকে ডেকে নেবেন। শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও, তর সইছিল না। ঠিকই একটু পরে মেয়েটি তার আসন ছেড়ে উঠে এসে আমার সমস্যার কথা জানতে চাইলো। আমি তাকে বললাম, আপনি সেদিন আমায় যে চেঞ্জড টিকেটটি দিয়েছিলেন, তা আমি হারিয়ে ফেলেছি। এদিকে সময়ও ঘনিয়ে আসছে, তাই সমস্যাটার একটু দ্রুত সমাধানের জন্যেই আমি আপনাকে ছাড়া আর কারো সাথে দেখা করতে চাইনি। মেয়েটি তার ভ্রূ কুঁচকে বললো, ”Are you sure, it was me?” তার প্রশ্ন শুনে কিছুটা সন্দেহের দোলাচলে পড়ে গেলেও, ঐ পরিস্থিতিতে কিছুটা জোর দিয়েই বললাম, Yes, I am sure. মেয়েটি তার আসনে ফিরে যাবার আগে বললো, “I’ll call you”.
ঠিকই, ক্ষণিক পরেই মেয়েটি আমায় ইশারায় ডেকে নিল। তার সামনে আমাদের পাসপোর্ট দুটো মেলে ধরলাম। সে মনিটরে কিছুক্ষণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, “But why and how did you remember me?” আমি বললাম, “I don’t know, but may be, because of your smile.” মনিটরে চোখ রেখেই আবারো হেসে মেয়েটি একটু ঢং করেই বললো, “From now on, you must remember me and not my friend, because I am much more prettier than ….. (অমুক, তার সহকর্মীর নাম) who helped you that day“. এটা বলার পর সে একটা প্রিন্ট-অর্ডার দিল, মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো আমাদের নতুন টিকেট, কোন মাশুল ছাড়াই! আবারো সাড়া মুখব্যাপী সেই ভুবন ভোলানো হাসি ছড়িয়ে মেয়েটি প্রিন্ট-আউটটার উপর মার্কার পেন দিয়ে সময়টা আন্ডারলাইন করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “You can relax now, but must check-in before this time (underlined), the counter is just behind you”. আমি খুশী হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যখন বিদেয় নিচ্ছিলাম, সে হাত নেড়ে বললো, “Good bye, Sir! Have a nice flight!” এতক্ষণ পর একটু স্বস্তি পাওয়াতে মেয়েটির দিকে এবারে চোখ তুলে তাকালাম। ভ্রম ভাঙলো। আসলেই সে ছিল এক অনিন্দ্যসুন্দরী, লাস্যময়ী নারী। সেদিনের সেই সুন্দরী মেয়েটার চেয়েও সুন্দরী। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়াতে পুনরায় ক্ষুধার্ত বোধ করতে লাগলাম। দ্রুত প্রস্থান করে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকে লাঞ্চের অর্ডার দিলাম।
ঢাকা
২৫ নভেম্বর ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০৭