somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা - ১৮

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার কথা - ১৭ পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

এমসিসি’র তৃতীয় (আমাদের দেখা দ্বিতীয়) প্রিন্সিপাল উইং কমান্ডার সুলেমান হায়দার কীয়ানিঃ

১৯৬৯ সালের শেষের দিকে কর্ণেল আনসারী আমাদের কলেজে চাকুরী শেষ করে পাকিস্তানে ফিরে যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ (আরসিসি) এর তৎকালীন অধ্যক্ষ উইং কমান্ডার সুলেমান হায়দার কীয়ানি। আমাদের পাড়ার একজন সিনিয়র ভাই তখন আরসিসিতে পড়তেন। কলেজ ছুটির সময়ে আমরা কখনো কখনো একত্র হয়ে গল্পগুজব করতাম। তার মুখে তাদের কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ উইং কমান্ডার সুলেমান হায়দার কীয়ানি এর স্মার্টনেস সম্পর্কে অনেক কাহিনী উপাখ্যান শুনেছিলাম। ছুটির সময় তিনিই আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন যে তাদের প্রিন্সিপাল আমাদের কলেজে বদলী হয়েছেন। তাঁর মত একজন ভালো ও জনপ্রিয় প্রিন্সিপালকে হারিয়ে আরসিসি’র ক্যাডেটরা দুঃখবোধ করছিলো বলে মনে হলো। ছুটি শেষে কলেজে ফিরে শুনি তথ্যটি সঠিক। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন প্রিন্সিপাল আমাদের মাঝে সশরীরে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দেহাবয়ব প্রথম দর্শনেই ইমপ্রেস করার মত ছিলো। স্লিম, লম্বা গড়নের, ব্যাকব্রাশ করা আধাপাকা চুল। সদা সর্বদা স্মিতহাসি, স্মার্ট, পরিপাটি পরিচ্ছদ পরিহিত থাকতেন। প্রথম যেদিন তিনি মুখ খুললেন, আমি সত্যিই একেবারে থ’ বনে গিয়েছিলাম! মানুষ এত সুন্দর উচ্চারণে ইংরেজী ভাষায় কথা বলে কিভাবে, যে ভাষা তার নিজ মাতৃভাষা নয়? তিনি ইংরেজী ফনেটিক্সে প্রশিক্ষিত ছিলেন হয়তো বা, নইলে তাঁর কথা একেবারে বিদেশীদের কথার মত শোনাতো কী করে? ইংরেজী think শব্দটির উচ্চারণ যে ঠিক থিঙ্ক নয়, বরং অনেকটা সিঙ্ক এর কাছাকাছি, সেটা তাঁর কাছেই প্রথম শিখেছিলাম। যদিও সেটা ঐ শেখা পর্যন্তই সীমিত, আমার মুখ দিয়ে কস্মিনকালেও ও ধরণের উচ্চারণ বেড়োয়নি, আর বেড়োবেও না। আমার ব্যাচমেট জামালউদ্দিন খুব তাড়াতাড়ি তাঁর এ নিখুঁত উচ্চারণগুলো রপ্ত করে ফেলেছিলো এবং সে মাঝে মাঝে ঐরকম উচ্চারণে আমাদের সাথেও কথা বলতো।

প্রিন্সিপাল কীয়ানি খুবই চটপটে স্বভাবের একজন ডায়নামিক লোক ছিলেন। সবকিছুতেই তাঁর প্রেজেন্টেশন গুলো বেশ পরিচ্ছন্ন ছিলো। তিনি রেডী উইটের অধিকারী ছিলেন, আপাদমস্তক একজন কৌতুকপ্রিয় মানুষ। তিনি কাজের লোক ছিলেন, কাজপাগল লোকদেরকে তাঁর আশেপাশে রাখতেন। তিনি এসেই প্রথম প্যারেন্টস’ ডে তে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেছিলেন একজন উচ্চপদস্থ পিএএফ অফিসারকে। সম্ভবতঃ তিনি তখন ঢাকার বেস কমান্ডার ছিলেন, অথবা পাকিস্তানের বিমান সদর থেকে আগত কোন মাননীয় অতিথি। তাঁর নামধাম আজ কিছু মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে তিনি প্যারেড রিভিউ এর পরে এক চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতার শেষে তিনি আমাদের সকলের জন্য জীবনে যেন “many soft landings” পেতে পারি, সেটা উইশ করেছিলেন। তখনই প্রথম জেনেছিলাম, কাউকে ঝঞ্ঝাহীন, বিপদমুক্ত জীবন উইশ করতে হলে এয়ারফোর্সের পরিভাষায় “soft landings” উইশ করা হয়ে থাকে।

প্রিন্সিপাল কীয়ানি এমসিসিতে পদার্পণ করার সাথে সাথে চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। কলেজ একাডেমিক ব্লকের সামনে একটা উঁচু গোলচক্কর ছিলো। তিনি ওটাকে ভেঙ্গে সমান করে একটা মনোরম বাগান বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই বদলী হয়ে যাবার কারণে তিনি সেটা শেষ করে যেতে পারেন নাই। পরবর্তীতে বাঙালী প্রিন্সিপাল উইং কমান্ডার এ কে এম বদিউর রহমানের আমলে বাকী কাজটুকু শেষ করা হয়। তাঁর সময়েই আরো বেশ কয়েকটা নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিলো, যেমন কলেজ মাসজিদ আর ২৫ মিটার ফায়ারিং রেঞ্জ, যদিও রেঞ্জটা কোনদিন ব্যবহৃত হয়েছিলো বলে শুনিনি। তাঁর সময়েই প্রথম কলেজের অবস্ট্যাকল কোর্সটাও নির্মিত হয়। আগে আমাদের হাউসগুলোতে কোন ফ্লাইপ্রুফ নেটিং ছিলোনা। তিনি এসে সব হাউসের বারান্দা ও দরজা জানালাগুলোকে ফ্লাইপ্রুফ নেটিং করেছিলেন। আমাদের বেডগুলো আগে ছিলো কাঠের ফ্রেমের উপর ‘টেপ নেওয়ার’ এর ফিতে দিয়ে তৈরী, তার উপর একটা পাতলা তোষক থাকতো। তিনি এসে বেডগুলোকে উন্নত করলেন। ফিতের পরিবর্তে কাঠ লাগলো, পাতলা তোষকের জায়গায় মোটা জাজিম এলো। পাতলা সাদা বেডশীটের বদলে স্ট্রাইপড শীট দেয়া হলো, সাথে হাউস কালারের সাথে মিলিয়ে মোটা গুলটেক্সের বেড কভার। সাধারণ মানের পিটি সু এর বদলে দেয়া হলো উন্নত মানের বাটার পিটি সু, সাথে উন্নত মানের মোজা। খুব দ্রুত এ ধরণের উন্নয়নে সকলের মনোবল খুব চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকলো এবং কলেজটা অনেকটা অফিসার্স মেস এর ন্যায় একটা উন্নত মানের আবাসিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেল। এসব উন্নয়নের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন শিক্ষক, ছাত্র, স্টাফ, বেয়ারা, বাবুর্চি সবার চলনে বলনে একটা সপ্রতিভ ভাব লক্ষ্য করা গেলো। ঘানিটানা জীবনেও যে কৌতুক ও হাস্যরস একটা অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হতে পারে, তা অনেকেই প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলো। সেনাবাহিনীর রাফ এন্ড টাফ কিন্তু আটপৌরে জীবন প্রণালীর তুলনায় এয়ারফোর্সের শৈল্পিক ও পরিশীলিত মনোভঙ্গী আমার মত লোকের আনাড়ি চোখকেও এড়াতে পারে নাই। আমি ক্রমেই মুগ্ধ হতে থাকলাম।

প্রিন্সিপাল কীয়ানি আসার পর কলেজে আরেকটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসলো। সেটা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। তিনি বেশ কিছু ক্লাব করে দিয়েছিলেন, যেমন ডিবেটিং ক্লাব, ড্রামা ক্লাব, ফটোগ্রাফী ক্লাব, হিচ হাইকিং ক্লাব ইত্যাদি। আন্তঃ হাউস ক্রস কান্ট্রি দৌড় প্রতিযোগিতাও তাঁর সময়েই প্রথম চালু হয়। তিনি আসার পর কলেজে বেশী করে নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করে। তিনি কিছু নতুন নতুন প্রতিযোগিতার প্রচলন করেন, যার কথা আমরা আগে কখনো শুনিনি। যেমন আন্তঃ হাউস স্পেলিং বী (Spelling Bee) প্রতিযোগিতা, বাংলা ও ইংরেজীতে উপস্থিত বক্তৃতা (Extempore Speech) প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর আরেকটা গুণ আমাকে খুব আকৃষ্ট করতো, সেটা হচ্ছে তাঁর সময়ানুবর্তিতা। কলেজে কখনো কোন অনুষ্ঠান প্রিন্সিপালের বিলম্বে উপস্থিতির কারণে দেরীতে শুরু হয়নি। তাঁর আমলেই প্রথম দেখেছিলাম, কোন অনুষ্ঠানের সময়সূচী একেবারে মিনিটের কাঁটা ধরে প্রণয়ন করা হতো। উদাহরণ স্বরূপঃ অভ্যাগত অতিথিদের আসন গ্রহণঃ ১১ টা ৫৩ মিনিটে। আমাদের কলেজ থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে মির্জাপুরে অবস্থিত “ভারতেশ্বরী হোমস” নামে আমাদেরটার মতই আবাসিক এক নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো। সেখানকার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রিন্সিপাল কীয়ানির মতই একজন স্মার্ট, প্রথিতযশা, চল্লিশোর্ধ্ব অবিবাহিতা (তখনো পর্যন্ত) নারী, তাঁর নাম মিস জয়া পতী। তিনি একজন অত্যন্ত বিদুষী ও মহিয়সী নারী ছিলেন। এছাড়া তাঁর বংশগত পরিচয়, তিনি ছিলেন কুমুদীনি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা নামে অধিক পরিচিত) এর সুযোগ্যা কন্যা। প্রিন্সিপাল কীয়ানি তাঁর সাথে যোগাযোগ করে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে এক সেতুবন্ধন গড়ে দিলেন। শুরু হলো দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, সেই সাথে হয়তোবা কারো কারো মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মিক যোগাযোগও বটে। আমরা তাদের নাটক দেখতে গেলাম, তারাও একবার আমাদের এখানে এলো। ক্যাডেট কলেজের পরিবেশটা দিনে দিনে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠতে লাগলো। সেই সাথে ক্যাডেটদের মনোবলও বেশ চাঙ্গা হতে শুরু করলো। অবশ্য সিনিয়র ক্লাসের ভাইদের, বিশেষ করে তৎকালীন স্মার্ট কলেজ ক্যাপ্টেন শফিক চৌধুরী ভাইয়ের এবং ব্যাচেলর এ্যডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিক এর মনোবল চাঙ্গা হবার আরেকটা কারণ ছিলো, সেকথা নাহয় আরেকদিন বলা যাবে!

চলবে….

(ইতোপূর্বে প্রকাশিত)

ঢাকা
০৭ অগাস্ট ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ রাত ১০:৫০
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×