আমার কথা - ৫ পড়ুন এইখানেঃ আমার কথা - ৫
দু’দিন বিশ্রাম নেয়ার পর ফের স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। আবার স্কুলের ক্যালেন্ডারের সাথে একাত্ম হ’লাম, ক্যাডেট কলেজের ভাবনা ধীরে ধীরে মাথা থেকে চলে গেলো। একদিন শিক্ষকের অনুপস্থিতির কারণে স্কুলটা এক পিরিয়ড আগে শেষ হলো। আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম, বাসায় গিয়ে বই রেখে পুনরায় স্কুলে আসবো আর দুই দলের মধ্যে একটা কম্পিটিশন ম্যাচ খেলবো। তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরলাম। দরজা খুলতেই আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট বোনটা ঘোষণা দিলো যে আমি পাশ করেছি। কিসে পাস করেছি, সে সম্বন্ধে তার কোনই জ্ঞান ছিলোনা, তবে বড়দের পাশে বসে আলোচনা শুনে সে বুঝতে পেরেছে যে আমি বেশ বড় একটা কিছু করে ফেলেছি। এজন্যই সে বেশ উল্লসিত ছিলো। সন্তর্পনে ঘরে ঢুকলাম। আম্মা কাছে ডেকে আদর করে জানালেন যে আমি ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। টেবিলের উপরে দেখি পত্রিকার পাতা খোলা। যে পাতায় আমার রোল নম্বরটা আছে, সেটা খোলা। যদিও রেজাল্ট আমি সদ্য জেনে গেছি, তবুও চোখ দুটো খুব দ্রুত নম্বরগুলো স্ক্যান করতে লাগলো। ১০৪৮ এ এসে দৃষ্টিটা থেমে গেলো। অনেকক্ষণ ধরে নম্বরটা দেখতে থাকলাম। ফাহিয়ানের রোল নম্বরটাও জানা ছিলো। সেটাও দেখলাম আমারটার পাশেই, ১০৫১। পাশাপাশি এ দুটো নম্বর দেখতে পেয়ে মনটা খুশীতে ভরে গেলো। কম্পিটিশন ম্যাচটার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
দেখতে দেখতে আমার ভাইভা আর মেডিকেল পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। পরপর দু’দিন হবে, প্রথম দিন ভাইভা, সেটাতে টিকে গেলে পরের দিন মেডিকেল। আমার একটা চোয়ালের দাঁতে পোকা ধরেছিলো (যদিও ডেন্টিস্টদের বদৌলতে এখন জানি, দাঁতের পোকা বলতে কিছু নেই)। এ নিয়ে আব্বার নতুন করে চিন্তা শুরু হলো। তিনি তাঁর অফিসের কলীগ আর প্রতিবেশী মুরুব্বীদের সাথে আলোচনা করলেন। সবাই পরামর্শ দিলো দাঁতটাকে তুলে ফেলার। যতদূর মনে পড়ে, তখন ঢাকায় মাত্র একজনই নামকরা ডেন্টিস্ট ছিলেন, তাঁর নাম ডাঃ জামান, বসতেন জিন্নাহ এভিনিউ এ (এখনকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। ভাইভার তিনদিন আগে সেখানে গিয়ে দাঁতটাকে তুলে এলাম। দাঁত তোলার সময় সামান্য ব্যথা পেয়েছিলাম, তবে সেটা সহ্য করার মত। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো বাসায় ফিরে। বাসায় আসতে আসতে প্রচন্ড দাঁতব্যথা শুরু হলো, সাথে রক্তক্ষরণ। কিছুক্ষণ পর ব্যথায় জ্বর এসে গেলো। আব্বা আমাকে নিয়ে পুনরায় ছুটলেন ডাক্তারের চ্যাম্বারে। এবারে তিনি অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে কি যেন একটা স্প্রে করে দিলেন। আর মুখ ভরে তুলো গুঁজে দিলেন। ধীরে ধীরে ব্যথা আর রক্তক্ষরণ দুটোই কমে এলো। তবুও, তিনদিনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কিনা, সে দুশ্চিন্তাটা রয়েই গেলো।
ভাইভার জন্য শুরু হয়ে গেলো ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। সাধারণ জ্ঞান, ইংরেজী কথোপকথন আর পোশাকে আশাকে আমাকে চোস্ত বানানোর এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। একটা কমন কোশ্চেন- তুমি কেন ক্যাডেট কলেজে যেতে চাও- এর উপর মোটামুটি একটা নোট লিখে আমাকে মুখস্থ করতে দেয়া হলো। আমি নিষ্ঠার সাথে মুখস্ত করলাম, যদিও তা করতে মোটেই ভালো লাগছিলোনা। বাসায় ডাকযোগে ইন্টারভিউ কার্ড এলো। সেখানে প্রিন্সিপালের নাম লেখা দেখলাম M W Pitt, MA, Oxon. এই নামটা আমার মনে এক নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দিলো। খবর শোনা আর পেপার পড়া আমার অন্যতম হবি ছিল বিধায় এতদিন ভাইভা সম্পর্কে বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলাম না। কিন্তু ঐ নামটা দেখার পর থেকে খুব অস্থির বোধ করতে লাগলাম, কারণ আমি জীবনে কখনো কোনদিন কোন ইংরেজকে সামনা সামনিই দেখি নাই, তার সাথে কথা বলাতো দূরের কথা। তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবো কিনা, তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো তার প্রশ্নটা ঠিকমত বুঝতে পারবো কিনা। আব্বা শিখিয়ে দিলেন, ভয় নেই, সাহেবরা খুব ভালো মানুষ হয়। যতবার বুঝতে পারবোনা, ততবারই যদি বলি ‘বেগ ইয়োর পার্ডন স্যার’, তবে ইংরেজ সাহেব যে করেই হোক, আমাকে সহজ করে বুঝিয়ে দিবেন। আসলে আমার মনে সাহস সঞ্চার করাই ছিল আব্বার মূল উদ্দেশ্য। এটা শোনার পর থেকে আর সব বাদ দিয়ে শয়নে স্বপনে জাগরণে ‘বেগ ইয়োর পার্ডন স্যার’টাই আওড়াতে শুরু করলাম।
ভাইভার দিন খুব নার্ভাস ফীল করতে লাগলাম। ভয় ঐ একটাই, যা একটু আগেই বলেছি। কলেজের একজন শিক্ষক আমাদের সিরিয়াল ঠিক করে দিলেন। আমার ক্রম সাত নম্বরে। আমাদেরকে বলা হলো প্রিন্সিপাল সাহেব যদি আমাদের হাতে কোন কাগজ দেন, তবে আমরা যেন বাইরে এসে সেটা তাঁর হাতে জমা দেই। প্রথম তিনজন গেল আর খালি হাতে বেরিয়ে এলো। চতুর্থজন একটা কাগজ হাতে বেরিয়ে এলো। বুঝলাম, সে টিকে গেছে। ওর হাতের কাগজ দেখে আমার হৃদকম্পনটা একটু বেড়ে গেলো, যদি আমি কোন কাগজ না পাই? যখন ১০৪৮ ডাকা হলো, তখন মে আই কাম ইন স্যার বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই যন্ত্রচালিতের ন্যায় ভেতরে প্রবেশ করলাম। কারণ, আমার ‘মে আই কাম ইন স্যার’ এর উত্তরে প্রিন্সিপাল স্যার ইয়েস বললেন, না নো বললেন, সেটাও যদি না বুঝি?
ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো। প্রিন্সিপাল স্যারের এক হাসিতে আমার মনে হলো তিনি আমার অনেক দিনের চেনা। যখন আমার নাম, বাবার নাম ইত্যদি জিজ্ঞেস করলেন, ততক্ষণে ভয় ডর দূর হয়ে গেছে। দেখলাম, তিনিতো আমাদের মতই কথা বলেন। বরং মনে হলো আমাদের চেয়েও স্পষ্ট। প্রিন্সিপাল স্যারের চোখের মাঝে স্নেহের আধার খুঁজে পেলাম। আর একদম ভয় রইলোনা। তিনি প্রথমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তর দেয়ার পর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ডু ইউ নো হোয়্যার হি ইজ নাও”? খবর শোনা আর পেপার পড়ার কল্যানে জানতাম যে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ঐ দিন রাজশাহী যাবার কথা। যতটুকু পারলাম, ইংরেজীতে তাই বললাম। তিনি ও তাঁর পাশের জন খুশী হলেন বুঝতে পেরে বুকের সাহস অনেকটা বেড়ে গেলো। তার পর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নঃ “হোয়াই ডু ইউ ওয়ান্ট টু জয়েন ক্যাডেট কলেজ”? কিন্তু কি আশ্চর্য! এতদিনের সেই ঝরঝরে মুখস্থ করা আর রিহার্সেল দেওয়া উত্তরটা মোটেই মুখে এলোনা। তার বদলে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে আমার মুখে চলে এলোঃ “আই ওয়ান্ট টু জয়েন ক্যাডেট কলেজ বিকজ আই লাইক ফ্রেন্ডস। ইন ক্যাডেট কলেজ আই শ্যাল হ্যাভ মেনী ফ্রেন্ডস। আই শ্যাল স্টে উইথ মাই ফ্রেন্ডস টুগেদার।“
কে আমার মুখে এই কথাগুলো তুলে দিয়েছিলো, তা আজও জানিনা। কিন্তু Mr M W Pitt এর মুখে দুইবার গুড গুড শোনার পর মনে হয়েছিলো আমি যেন কোন দৈববাণী শুনতে পাচ্ছি। এই সৌম্যকান্তি, স্নেহপ্রবণ, আলোকবর্তিকাতুল্য ব্যক্তিত্বের সাথে ওটাই ছিলো আমার প্রথম পরিচয়, এবং ওটাই শেষ। কারণ আমরা এমসিসিতে প্রথম যোগদান করে অন্য একজন প্রিন্সিপালকে পেয়েছিলাম। ততদিনে তিনি কর্তব্যপালন শেষে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি একটা কাগজে খস খস করে কিছু একটা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে হাসিমাখা মুখে বললেন, ইউ মে গো নাও। কাগজটা নিয়ে আমি প্রস্থান করলাম, মুখে বিজয়ের হাসি। জমা দেবার আগে হাতের লেখাটা পড়ে দেখলাম, “Selected for Medical Test”.
আমার পরে ১০৫১ এর ডাক পড়লো। পথে ফাহিয়ানের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। ওর মুখ দেখে মনে হলো, ওর চিকণ দুটো কাঁধে যেন পৃ্থিবীর বোঝা।
চলবে...
(ইতোপূর্বে প্রকাশিত)
ঢাকা
০৯ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Mr. M W Pitt, the first Principal of Momenshahi Cadet College - আমার জীবনে দেখা প্রথম ইংরেজ, যার সামনাসামনি বসে জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। তাঁর হাসিমুখ আমার কিশোর মনে সেদিন স্থায়ীভাবে খচিত হয়ে গিয়েছিলো, সে স্মৃতি আজও সমুজ্জ্বল, আপন আলোকে দীপ্যমান।
(ফটো ক্রেডিটঃ মাহবুব শহীদ ভাই, ক্যাডেট নং ৩)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৬