আমাদের রুমের মনিটরে কাবা শরীফে ওমরাহ করতে আসা সারিবদ্ধ হাজীদের নামাজের দৃশ্য। আঘাত পাওয়ার পর হোটেলের রুম বন্দী এমন দৃশ্য দেখে আফসোস হতো
মক্কা আসার আগের রাতে মদীনায় যে অনাকাংখিত ঘটনায় আঘাত পেয়েছিলাম তার ব্যাথাটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে এই লম্বা বাস জার্নিতে।পরদিন উঠে দাড়ানোর মত শক্তি নেই আমার।শরীরের সমস্ত হাড় যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ওমরাহ পালন করার জন্য হুইল চেয়ারই ছিল আমার একমাত্র ভরসা। কিন্তু হুইলচেয়ার চালকদের হোটেলের ভেতরে প্রবেশাধিকার না থাকায় হোটেল কর্মচারী আমাকে রুম থেকে হুইল চেয়ারে করে সিকিউরিটি গেটের কাছে অপেক্ষমান চালকের কাছে পৌছে দিল।
মনটা আমার গভীর বিষন্নতায় ভরে উঠলো, নিজেকে মনে হচ্ছে এক চরম গুনাহগার বান্দা, নাহলে দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো আমি এই পবিত্র আল্লাহর ঘরের সামনে এসে নিজ পায়ে দাড়াতে পারছি না কেন! গভীর অনুতাপে বিদ্ধস্ত আমি পরবর্তীতে অনেক ওমরাহকারীদের দেখলাম যারা হাত পা প্লাষ্টার করে হুইল চেয়ারে বসা, তখন আমি আবার মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করলাম এটা ভেবে যে আমি অন্তত শারিরীকভাবে তাদের মত অতটা পর্যদুস্ত নই।
এই সেই পবিত্র নুর পর্বত আরবী ভাষায় জেবেলে নুর,যার গুহা হেরায় ধ্যানমগ্ন রাসুলের (সাঃ) কাছে আল্লাহ পাক থেকে ওহী নাজিল হয়েছিল
হুইল চেয়ার চালক ছেলেটি ছিল সদ্য দাড়ি গোফ গজানো এক আরব যুবক তার নামটাই আমার জিজ্ঞেস করা হয় নি, যা আমি সচরাচর করে থাকি। হয়তো আমার মানসিক অবস্থা আর ভাষা ছিল অন্তরায়। ওমরাহ পালন করতে গিয়ে ক্ষনিকের জন্য হলেও যে কয়েকজন ভালো, আর বিনয়ী মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম তাদের মাঝে সে ছিল একজন। বাকিদের কথা পরে বলছি। ইশারা আর সহজ ইংরেজীতে তাকে বল্লাম না দৌড়ে সে যেন আস্তে আস্তে ঠেলে নেয় আমাকে। ছেলেটা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলা শুরু করলো। আমাদের হোটেল যেহেতু ক্লক টাওয়ারে যা কাবা ঘরের সীমানার মাঝেই তাই হোটেলের গেটের সামনেই রাস্তাটা পেরিয়ে হারাম শরীফের দোতালায় উঠে গেলাম। রাস্তা জুড়ে অনেক মানুষ বসে আছে ফজরের নামাজ পরে।
ইহরাম নেয়া আমার স্বামী আর সম্পুর্ন কালো বোরখায় আবৃত আমি কাবাঘর তাওয়াফ এর প্রস্ততি নিলাম। আমরা যেহেতু দোতলায় তাই দূর থেকেই হজরে আসওয়াদকে সামনে রেখে ওমরাহর নিয়ত করলাম। পুরো সাতবার কাবাঘর ঘুরে আসতে হবে আমাদের। দোতালা জুড়ে নির্মান কাজ চলছে তার জন্য অনেকটা ঘেরা থাকায় নীচের কাবাঘর চত্বরের অনেক কিছুই নজরে আসছিল না, শুধু কাবাঘরের উপরে অংশটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম । তাই হুইল চালক আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে যে আমরা এখন এই জায়গায় তুমি এই দোয়া পড়ো, বলে দোয়াটিও আমার কানের কাছে উচ্চারন করছিল।
আমি যদি নিচে থেকে তাওয়াফ করতে পারতাম তবে হয়তো কাছে গিয়ে আল্লাহর ঘরকে নিজ হাতে ছুতে পারতাম।অবশ্য নিরাপত্তা রক্ষীরা একে হারাম হারাম বলে নিরুৎসাহিত করে। আমাকে নিয়ে চালক আস্তে আস্তে সাতবার ঘুরতে শুরু করলো।রুকন ই ইয়েমেনী থেকে হজরে আসওয়াদ যেতে যেতে আমার কানের কাছে এসে বল্লো এই মোনাজাতটি করো“রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া্…। ইয়া আজিজু ইয়া গাফফার”। জানা মোনাজাতটি আমি ছেলেটির সাথে তিনবার পড়লাম। এভাবে সাতবার তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের পেছনে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ার পর ছেলেটি পাশে থাকা জমজমের পানি একটি গ্লাসে করে এনে দিল।
কাবা ঘর তাওয়াফর করার জন্য দলে দলে নারী পুরুষ ওমরাহকারীদের প্রবেশ
এরপর সায়ী করার নিয়ম। সায়ী অর্থাৎ দৌড়ানো বা দৌড়ের চেষ্টা করা। কাবা ঘরের পাশেই থাকা দুটো ছোট্ পাহাড় সাফা আর মারওয়া। বিরান মরুভুমিতে ১৪০ ফুট দুরত্বে থাকা পাহাড় দুটি আর আগের রূপে নেই। সৌদি সরকার হাজীদের সুবিধার্থে পুরো এলাকাটি দালান তুলে ঘেরাও করে দিয়েছে, যা পুরোটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, ঝা চকচকে মার্বেলের মেঝে। সেই আরামদায়ক ঘরে আরামের সাথে সায়ী করার সময় খরতাপে খালি পায়ে রুক্ষ কাঁকরের উপর দৌড়ানো বিবি হাজেরার কথা মনে পরতে লাগলো।
আল্লাহর আদেশে আবার কোথাও পড়েছি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার প্রথম স্ত্রীর নির্দেশে দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি হাজেরা ও তার গর্ভজাত সন্তান শিশু ইসমাইল, সুর্য্যের মত যার রোশনাই, কলিজার টুকরা, বুকের ধন মানিককে অনেক দুরের এক দুর্গম পাহাড়ী উপত্যকা সাফা মারওয়ায় ফেলে এসেছিল। সেই নির্জন নির্বান্ধব তপ্ত মরুর বুকে মা ছেলের সম্বল ছিল কিছু খেজুর আর এক মশক পানি। সে আর কদিন ! খাবার ফুরিয়ে আসলে ক্ষুধ পিপাসায় কাতর হাজেরা শিশুপুত্রকে মাটিতে শুইয়ে সেই তপ্ত বালুময় পথে সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে পাগলের মত দৌড়াতে লাগলেন। সাতবার তিনি যখন দৌড়ে আসেন তখন দেখেন তার শায়িত শিশু পুত্রের কাছেই এক পানির উৎস যা জমজম নামে সারা বিশ্বে সুপরিচিত এবং যা আজও প্রবাহমান। অনেকে মনে করেন এটা এক ঐশীপ্রাপ্ত পানির কুয়ো।
ছেলেদের সেই পথে কিছুটা দৌড়ে আর কিছুটা হেটে সায়ী করতে হয়, মেয়েদের না। সায়ীতে কাবাঘর তাওয়াফের মত পুরো ঘুরে আসতে হয় না, এ মাথা থেকে ও মাথা গেলেই এক চক্কর হিসাব হয়। নীচ তালার দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানেও অনেক মানুষ সায়ী করছে তাদের ফাক দিয়ে রুক্ষ কালো সেই সাফা মারওয়া পাহাড়ের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে যা কাচ দিয়ে ঘেরা। সেদিকে তাকিয়ে দোয়া পরছি আর ভাবছি মা হাজেরা খালি পায়ে, মাথার উপর গনগনে সুর্য্য নিয়ে এই কংকরময় পাথুরে পথে কতটা নিরুপায় হয়ে দৌড়েছিলেন! আর আজ আমরা পুরো এসি করা মার্বেল বসানো মসৃন পথে হেটে চলেছি। অবশ্য আমি তো হুইল চেয়ারেই বসে ।
সায়ী শেষে ওমরাহর শেষ কাজ মেয়েদের মাথা থেকে এক আঙ্গুল পরিমান চুল কেটে ফেলা আর ছেলেদের পুরো মাথা কা্মানো লাগে। কাচি নিয়ে না যাবার জন্য আমার চালক সায়ীরতা এক আরবীয় নারীকে আমার সমস্যার কথা জানা্লো। ভদ্রমহিলা হাসিমুখে তার হাত ব্যাগ খুলে কাচি বের করে আমার হিজাব সরিয়ে চুল কেটে দিল। তার আচরনে আমি অবাক হোলাম। এরপর গন্তব্য জমজম টাওয়ারের নীচে সেলুনে আমার স্বামীর জন্য। ছেলেটা বিদায় নিয়ে চলে যেতে যেতে বার বার হাত নাড়ছে হাসিমুখে। ওর ঐ মুখটা আমি চোখ বুঝলেই দেখতে পাই।
মক্কার পথের দৃশ্য
যে পাচ দিন মক্কায় ছিলাম ততদিন আমি হোটেল রুমেই নামাজ আদায় করেছি।যদিও বলা হয় এই ক্লক টাওয়ার হারাম শরীফের অন্তর্গত, রুমে রুমে ট্রান্সমিটার লাগানো, আজান থেকে নামাজ সবই সরাসরি প্রচার হচ্ছে, মনিটরে দেখা যাচ্ছে, তাও আমার মন মানে না। তৃতীয়দিন আমার স্বামীকে বললাম “কাবাঘরের কোলের কাছে এসেছি আর আমি সেখানে যেতে পারছি না এটা কেমন হলো। আমার কথা শুনে সে আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে বল্লো ‘এখানে অনেক হুইল চেয়ার থাকে, কাউকে নিলেই হবে’। কিন্ত দুর্ভাগ্য কাউকে পেলামনা।ঐভাবে তার হাতে ভর দিয়ে হারাম শরীফে হাজির হোলাম। আমাকে দেখেই এক কৃষ্ণকায় যুবক দৌড়ে আসলো, হাতে তার একটি ফোল্ডিং চেয়ার। “বল্লো এদিকে আস্ এদিকে আসো” তারপর একটা গেট যা দুজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছিলো সেটা খুলে (মনে হয় উচ্চপদস্থদের জন্য নির্দিষ্ট)এক এস্কিলেটার দিয়ে দোতালায় নিয়ে গিয়ে তার হাতে রাখা ফোল্ডিং চেয়ারটা পেতে দিল আমাকে। আমার দেখা সাক্ষাৎ ফেরেশতার মত লোকটির জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেছি আমি।
তখন নামাজের ওয়াক্ত ছিল না তাই নফল ইবাদত করলাম বসে বসে।এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে যাবার কথা ভাবতে ভাবতে উল্টোদিকে তাকাতেই দেখি ভেস্ট পরা এক যুবক খালি হুইল চেয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লাঠি ভর দিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কি পারেবে আমাদের ক্লক টাওয়ারের সুইসোটেল মক্কায় পৌছে দিতে। লোকটি মাথা ঝুকিয়ে আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে গেল গন্তব্যে। পৌছে দেয়ার পর আমার স্বামী জানতে চাইলো কত দিতে হবে ? সে ইশারায় না নেয়ার ভঙ্গীতে হাত নেড়ে বুকে হাত রেখে বল্লো “দুয়া দুয়া” অর্থাৎ তার জন্য যেন আমরা শুধু দুয়া করি টাকা না। অবাক হয়ে গেলাম। আর ঢাকা এয়ারপোর্টে ফ্রি হুইল চেয়ার আলারা কিভাবে আমাদের জিম্মি করে ১৫০০ টাকা নিল সে এক লম্বা ইতিহাস।
পরদিন বিকেলে পাশের সাফা টাওয়ারের ফুডকোর্টে বাংলাদেশি এক রেস্তোরায় গেলাম। আগের দিন এই দোকানেই উটের মাংস দিয়ে বিরিয়ানী খেয়েছিলাম। আজ চারটা পরোটা আর ডাল গোস্তের ট্রে হাতে নিয়ে টেবিল খুজছি। সামনে এক বড় টেবিলে স্থানীয় পোশাক পরা অল্প বয়স্ক এক আরব যুবক খাওয়া শেষে বসে আছে। আমাদের ইশারা করলো সেখানে বসার জন্য। আমরা দুজন পাশাপাশি বসা। আমার স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বাংলায় বল্লাম “তুমি কি আরেকটা পরোটা নিবে”? আচমকা ছেলেটা উঠে গিয়ে সামনের খাবারের দোকান থেকে দুটো গরম গরম পরোটা এনে আমাদের সামনে রাখলো।আমরা ভেবেছি তার জন্য হয়তো!আমাদের কথা তার শোনার প্রশ্নই আসে না। সে তখন উঠে প্লেটটা আমাদের প্লেটের আরও কাছে রেখে হাসিমুখে ইশারায় বলছে আমাদের দুজনার জন্য এটা। হাতের ইশারায় না না করলাম, তারপর টাকা সাধলাম, সে শুধু বল্লো “হাজী। হাজী, মেহমান, মেহমান”।
এর মাঝেই মাগরিবের আযান পরলো, আমাদেরও খাওয়া শেষ। তাকিয়ে দেখি আমরা যেই বাংলাদেশী দোকান থেকে মাংস পরোটা কিনেছি সেটা সহ সব দোকান বন্ধ হয়ে গেল। টাকা নেয়ার কেউ নেই, সবাই নামাজের জন্য তৈরী হচ্ছে, আমরা তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে আসলাম, বিল দেয়া হলো না। পরদিন সকালে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সেই দোকানে গিয়ে আগের দিনের বিল দিতে পারিনি বলে অনুতাপ প্রকাশ করে তা দেয়ার জন্য এই লোক সেই লোক করে হতাশ ক্লান্ত আমরা চেয়ারে বসে পরেছি। পর পর দুদিনের কাস্টমারদের সেই রেস্তোরার একটা লোকও যেন চিন্তে পারলো না এমন অবস্থা। অবশেষে ফিরে আসলাম হোটেল রুমে।
পবিত্র ওমরাহ পালন করতে গিয়ে সৌদি আরবে ১৫ দিনের এই সফরে আমরা ক্ষনিকের জন্য যে শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর সান্নিধ্যে এসেছিলাম সফরে তাদের কথাই বলতে চেয়েছি আমি আমার লেখায়।
রাত আটটায় মোয়াল্লেম আমাদের রুমে এসে জানালো কাল বাস আসবে সকাল দশটায়, আমরা যেন তৈরী থাকি মক্কার ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন এলাকাগুলো জিয়ারত করার জন্য।
ভেবেছিলাম এই পর্বে শেষ করবো কিন্ত পারলাম না বলে দুঃখিত । আরেকটা পর্ব থাকবে তবে সেটা মুলত অল্প কিছু কথা আর ছবি ব্লগই হবে।
ছবি আমার মোবাইলে তোলা ।
ছবি ও লেখায় ওমরাহর শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:১২